কেনিংটন ওভালে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল তখন জমে উঠেছে। পঞ্চম দিনে ভারতের আশার অন্যতম প্রতীক হয়ে ছিলেন ৪৪ রানে অপরাজিত থাকা বিরাট কোহলি। বিরাট তরীতে চেপে ভারত বিশ্ব রেকর্ড গড়ে জয়ের দিকেই চোখ রাখছিল। কিন্তু ভারতের সে আশার পালে ধাক্কা দেন স্কট বোল্যান্ড।
পঞ্চম দিনের সপ্তম ওভারে বোল্যান্ডের করা অফ স্ট্যাম্পের বাইরের ফুল লেংথের বলে ড্রাইভ করতে গিয়ে স্লিপে ক্যাচ তোলেন ৪৯ রান করা কোহলি। দ্বিতীয় স্লিপে ডাইভ দিয়ে দারুণ এক ক্যাচ নেন স্মিথ। ফলাফল, ভারতের সব আশা নিঃশেষ করে দেন বোল্যান্ড।
ঐ ওভারেই এক বল বাদেই বোল্যান্ডের শিকার হন রবীন্দ্র জাদেজাও। ব্যাস। ভারতের ম্যাচ থেকে ছিটকে যাওয়া নিশ্চিত হয় তখনই। বোল্যান্ডের ঐ ওভারেই নিশ্চিত পরাজয়ের দিকে পতিত হয় ভারত। শেষ পর্যন্ত হয়েছেও তাই। বোল্যান্ডের ঐ আক্রমণের পর আর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি ভারত। ২০৯ রানের বড় পরাজয়ের স্বাদ নিতে হয় হয় রোহিত শর্মার দলকে।
টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে দুই ইনিংস মিলিয়ে ৫ উইকেট নিয়েছেন স্কট বোল্যান্ড। তবে দলের প্রয়োজনে বড় ব্রেক থ্রু টা এসেছে এ পেসারের মাধ্যমেই। ৩৪ বছর বয়সী স্কট বোল্যান্ডের টেস্ট ক্রিকেটের শুরুটা খুব বেশিদিনের নয়। বছর দেড়েক আগে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অ্যাশেজ সিরিজের মাধ্যমে লাল বলের ক্রিকেটে পা রাখেন বোল্যান্ড।
অবশ্য বোল্যান্ডের অনন্যতা অন্য জায়গায়। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে টেস্ট খেলা চতুর্থ আদিবাসী ক্রিকেটার হচ্ছেন বোল্যান্ড। পশ্চিম ভিক্টোরিয়া রাজ্যের গুলিদজান উপজাতি থেকে উঠে এসেছেন এ পেসার।
অবশ্য ২০২১ এ এসে টেস্ট অভিষেক হলেও ২০১৬ সালে এক দিনের ক্রিকেটে অভিষেক হয় বোল্যান্ডের। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ১৪ টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলার পাশাপাশি ৩ টি টি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিক ম্যাচও খেলেছেন তিনি।
৩২ বছর বয়সে এসে টেস্ট ক্রিকেটে পা রেখেই স্কট বোল্যান্ড গড়েছিলেন ইতিহাস। মেলবোর্নে অ্যাশেজের তৃতীয় টেস্টে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় ইনিংসের মাত্র ৭ রানেই ৬ উইকেট নিয়েছিলেন বোল্যান্ড। টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে এত কম রান খরচায় এর আগে ফাইফার নিতে পারেননি আর কোনো বোলার।
মূলত ঐ ইনিংসে বোল্যান্ডের বোলিং তোপেই সে ইনিংসে ৬৮ রানে অলআউট হয়েছিল ইংল্যান্ড। একই সাথে টানা তিন ম্যাচ জিতে ঐ টেস্ট দিয়েই সেবারে অ্যাশেজ নিজেদের করে নিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া।
তবে মেলবোর্নের সে টেস্টে ফাইফার পাশাপাশি আরেকটি রেকর্ডও গড়েছিলেন বোল্যান্ড। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঐ ইনিংসে ৬ উইকেট নেওয়ার যাত্রায় নিজের ১৯ তম বলে পঞ্চম উইকেট পেয়েছিলেন বোল্যান্ড। যা ত্রিশ বছর বয়সের পর কোনো পেসারের নেওয়া সবচেয়ে কম বলের ব্যবধানে পাঁচ উইকেট প্রাপ্তির কীর্তি গড়েছিল।
এর আগে, ১৯৪৭ সালে ভারতের বিপক্ষে ব্রিসবেন টেস্টে অস্ট্রেলিয়ান বোলার আর্নি তোশাক মাত্র ১৯ বলে ৫ উইকেট নিয়েছিলেন। তোশাকের গড়া সে রেকর্ডটি অবশ্য বোল্যান্ডের আগে ছুঁয়েছিলেন স্টুয়ার্ট ব্রড। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ট্রেন্ট ব্রিজ টেস্টে ১৯ বলে ৫ উইকেট নিয়েছিলেন ইংলিশ এ পেসার।
অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাস বলে, বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে সত্তর দশক পর্যন্ত আদিবাসীরা এক প্রকার অবহেলিতই ছিল। এমনকি তাদের অ-আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যেও অন্তর্ভূক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তবে আস্তে আস্তে সময় বদলে। বদলেছে অস্ট্রেলিয়ার সংস্কৃতিও।
এক দিক দিয়ে সেই সংস্কৃতি পাল্টানোর নেপথ্যের কারিগর বলা যায় বোল্যান্ডকেও। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী ক্রিকেটাররাও যে পিছিয়ে নেই, তাঁরাও যে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে পারফর্ম করতে পারেন, তার প্রমাণ দিয়েছেন স্কট বোল্যান্ড। গুলিদজান উপজাতি থেকে উঠে আসা এ পেসার জিতেছেন অ্যাশেজ।
শুধু দলগত সাফল্যে ব্যক্তিগত অর্জন সমৃদ্ধ করেছেন, এমনও নয়। অ্যাশেজ জয়ের ক্ষেত্রে রেখেছেন অবদান। গড়েছেন ইতিহাস। সেই ধারাবাহিকতায় এবার অস্ট্রেলিয়াকে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ শিরোপাও জেতালেন। মোক্ষম সময়ে দলের ব্রেক থ্রু এনে দিলেন। তাতে জিতল অস্ট্রেলিয়া, জিতলেন বোল্যান্ডও। আর সেই জয়ে মন কেঁড়ে নিল আদিবাসীদের হৃদয়ও।