না পাওয়া এক সূর্যের স্বপ্ন

হ্যাঁ, আফতাব আহমেদ এক নস্টালজিয়ার নাম। বাংলাদেশের হয়ে বুক চিতিয়ে লড়তে পারা এক ক্রিকেটারের নাম।

গ্রায়েম সোয়ানের বল ফ্লিক করে ফাইন লেগে পাঠালেন।

ত্রিশ গজের ভেতর থাকা ফিল্ডার বল থ্রো করে কিপারের কাছে পাঠানোর আগেই অপরপ্রান্তে থাকা মুশফিকের সাথে ভুল বোঝাবুঝিতে ক্রিজের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বুঝে নিলেন শেষ। ফেরত যাওয়ার নেই কোনো সুযোগ। সাজঘরে ফেরত যাওয়ার পথে মৃদ্যু হাসিমুখে আক্ষেপ করে কি যেন বলেছিলেন অপরপ্রান্তে থাকা মুশফিককে। সেদিন-ই অঘোষিতভাবে শেষবারের মত ওডিআই তে লাল-সবুজের  জার্সি গায়ে  মাঠে নেমেছিলেন আফতাব আহমেদ।

৬ ম্যাচ রান খরায় থাকার পর সেদিন-ই ফিরেছিলেন রানে। পঞ্চাশের আশায় থাকা আফতাব থামলেন ৬০ বলে ৪৬ রান করে ভুল বোঝাবুঝিতে রান আউট হয়ে। হেলমেট খোলা অবস্থায়  মাথায় জাতীয় পতাকা পেঁচানো মানুষটির মুখ। ক্যামেরার লেন্সে সেদিন-ই শেষবার ধরা পড়েছিল বাংলাদেশের আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটের প্রথম দিককার তারকা আফতাব আহমেদের।

হ্যাঁ, আফতাব আহমেদ এক নস্টালজিয়ার নাম। বাংলাদেশের হয়ে বুক চিতিয়ে লড়তে পারা এক ক্রিকেটারের নাম।

আফতাবের শুরুটা হয়েছিল বিরাট সম্ভাবনা জাগিয়ে। দেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ কান্ডারী হিসেবে যাকে ভাবা হচ্ছিল। ব্যাটিংয়ের তিন নম্বর পজিশনে হয়ে উঠেছিলেন নির্ভরতার প্রতীক। প্রথমদিকে কিছুটা সময় লাগলেও ধীরেধীরে পরিপক্ব হয়ে, আস্থার প্রতিদান নিয়মিতভাবেই দিয়ে যাচ্ছিলেন।

পয়েন্টে ফিল্ডিং করতেই যাকে বেশীরভাগ সময় দেখা যেত। আসলে মাঠের যেকোনো জায়গায় ছিলেন এক দুর্দান্ত ফিল্ডার। ২০০০ পরবর্তী দেশের ক্রিকেটে হাতেগোনা কয়েকজন মারকুটে ব্যাটসম্যানদের  একজন আফতাব। প্রথম বল থেকেই ব্যাট চালানোয় দক্ষ ছিলেন। দেশের ক্রিকেটের অদম্য সাহসী এই ব্যাটসম্যানের যেকোনো বোলার কেই বাউন্ডারি ছাড়া করতে বুক কাঁপতো না। উল্টো কাঁপুনি ধরিয়ে দিতেন বোলারের বুকে।

শুরুর সময়টা ২০০২। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৭৯ রানের ইনিংস দিয়ে। দেশের নির্বাচকদের নজর কেড়েছিলেন এই এক ইনিংস দিয়েই। তারপর আর বেশীদিন লাগেনি জাতীয় দলের ক্যাম্পে যোগ দিতে। পরের বছর ইংল্যান্ড জাতীয় দলের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে অতিরিক্ত শট খেলার প্রবণতা দেখিয়ে রান করতে ব্যর্থ হন। তারপর গণমাধ্যম তাকে টেস্টের উপযোগী ব্যাটসম্যান নয় বলে প্রচার করতে শুরু করে।

মূলত টেস্ট মেজাজে ব্যাটিং তার ক্যারিয়ার জুড়ে খুব একটা দেখা যায়নি আফতাবের কাছ থেকে। সব সময় চেয়েছেন দ্রুত রান তুলতে। মাঠের চারপাশে চার-ছক্কার ফুলঝুরি তে স্টেডিয়াম ভর্তি দর্শক মাতিয়ে সচল রাখতেন রানের গতি।

২০০৪ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে এজবাস্টনে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৫০ ওভারের অন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় আফতাব আহমেদের। অভিষেকে ১৩ বল মোকাবেলা করেও রানের খাতা খুলতে ব্যর্থ হন আফতাব। শক্তিশালী দক্ষিণ আফ্রিকার বিধ্বংসী বোলিং লাইন-আপের কাছে পরাস্ত সেদিন গোটা বাংলাদেশ দল। বাংলাদেশের দলীয় স্কোর একশোর আগেই থেমে যায়।

জাতীয় দলের ক্যারিয়ারে অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হবে তা ক্যারিয়ারের শুরুর ম্যাচেই বুঝে গিয়েছিলেন আফতাব। বন্ধুর পরিবেশে মানিয়ে নিতে না পারলে ক্যারিয়ার রাঙাতে ব্যর্থ হবেন, বুঝতে আর বাকি রইলো না। সময় পেরিয়েছে, আফতাব দেখেছেন, আফতাব শিখেছেন, ক্যারিয়ার গড়েছেন, রান করেছেন আর পাশাপাশি জয়ও করেছেন কোটি ভক্তের হৃদয়।

তবে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি পরবর্তী ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ড সিরিজেও ব্যাট হাতে ব্যর্থ আফতাব। তিন ম্যাচ মিলে করেছিলেন মাত্র ১৬ রান। তবে এই সিরিজেই এক অসাধারণ কীর্তি গড়েছিলেন বল হাতে। ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় ওডিআইতে ব্যাটিং ব্যর্থতায় মাত্র ১৪৭ রানের টার্গেট দিয়েছিল স্বাগতিক বাংলাদেশ। ক্ষুদ্র এই লক্ষ্য পার করতে কচ্ছপ গতির ব্যাটিং করলেও সমস্যা হওয়ার কথা ছিল না নিউজিল্যান্ডের।

জবাব দিতে গিয়ে ৭৪ রানে প্রথম উইকেট হারায় সফরকারী নিউজিল্যান্ড। পরাজয়ের পথে ছিল বাংলাদেশ। তাই বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামেও বিরাজ করছিল পিনপতন নীরবতা। সবাইকে অবাক করে দিয়ে বল হাতে প্রথমবারের মত আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে বোলিং করতে এসে, পাঁচ উইকেট নিয়ে আফতাব বিপদে ফেলে দিয়েছিলেন সফরকারীদের।

সেটা ছিল আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে প্রথম কোনো বাংলাদেশির ৫ উইকেট শিকার।

নীরব থাকা স্টেডিয়াম আফতাবের বোলিং পারফরম্যান্সে পুনরায় উল্লাসে ফেটে পড়ে। এক পর্যায়ে দর্শকরা বিশ্বাস করতে শুরু করে বাংলাদেশ জিতে যাবে। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ তিন উইকেটে পরাজিত হলেও আফতাব তার বোলিং দক্ষতা জানান দিয়েছিল সেদিন। ম্যাচ হারলেও আফতাবের বোলিংয়ের মাধ্যমে নিউজিল্যান্ড ব্যাটসম্যানদের নাস্তানাবুদ হওয়া দেখে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন দর্শকরা।

একই বছর ভারতের বিপক্ষে হোম সিরিজের দ্বিতীয় ও নিজের ৭ম ওডিআই ম্যাচে প্রথম অর্ধ-শতকের দেখা পান। কিন্তু তখনও আফতাব নিজের ব্যাটিং দিয়ে পুরোপুরি সবার আস্থা অর্জন করতে পারেননি।

২২৯ রানের পুঁজি নিয়ে ভারতের বিপক্ষে ১৫ রানের জয় পায় বাংলাদেশ। বল হাতে ৯ ওভারে ৩৬ রানে ৪ উইকেট নিয়ে মাশরাফি সবচেয়ে বেশী প্রশংসা পেলেও, ব্যাট হাতে আফতাবের করা ৬৭ রান ম্যাচে বাংলাদেশের দলীয় সংগ্রহের ভিত্তি স্থাপন করে দিয়েছিল।

একই বছর ইংল্যান্ডের মাঠে ন্যাটয়েস্ট ত্রিদেশীয় সিরিজে ইতিহাস গড়ে বাংলাদেশ। সেই ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে ছিলেন আফতাব আহমেদ। আশরাফুলের সেঞ্চুরীতে কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেনে অস্ট্রেলিয়া কে পরাজিত করে বাংলাদেশ। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয় দিয়েই বাংলাদেশ দল তাদের প্রাপ্য সম্মান আদায় করে নিয়েছিল। পুরো কৃতিত্ব আশরাফুল কে দেওয়া হলেও অস্ট্রেলিয়ার কফিনে শেষ পেরেকটি মেরেছিলেন আফতাব আহমেদ। জেসন গিলেস্পির বলে শাফল করে লেগ সাইডে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসের সবচেয়ে দামী ছয়টি মেরে বিশ্ব ক্রিকেট জানান দেয় আফতাব — ‘আমরাও পারি।’

ব্যাট হাতে আফতাব সবচেয়ে সেরা সময় পার করেছেন ২০০৬ সালে। সে বছর ২৭ টি ওডিআই ৩৪.০৯ গড়ে ৭৮৪ রান করেন আফতাব। সে বছর আটটি ফিফটিও করেন তিনি। পরের বছর ২৩ ম্যাচে ২২.৫৭ গড়ে করেছিলেন  ৫১৯ রান। ক্যারিয়ার সেরা ৯২ রান করেন সে বছর-ই।

২০০৬ সালে বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে শ্রীলঙ্কাকে প্রথমবারের মত হারায় বাংলাদেশ ৪ উইকেটের ব্যবধানে। খালেদ মাসুদ পাইলটকে সঙ্গী করে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়েন আফতাব। পরিস্থিতি বিবেচনায় ২১ বলে ৩২ করে অপরাজিত থাকেন আফতাব। এভাবেই দলের প্রয়োজনে ফিনিশারের ভূমিকায় ত্রাণকর্তা হিসেবেও আবির্ভূত হয়েছিলেন আফতাব আহমেদ।

২০০৭ সালে ৫০ ওভার বিশ্বকাপ ও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকা ও উইন্ডিজদের বিপক্ষে আফতাব-আশরাফুলের সেই ম্যাচ জেতানো দুই ঐতিহাসিক পার্টনারশিপ বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। ইতিহাস ঘাঁটলে তাই এখনও পাওয়া যাবে বাংলাদেশ ক্রিকেটে আফতাবের অসামান্য অবদান।

কিন্তু পরের বছর তথা ২০০৮ সালে ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় ভুলটা করে বসেন আফতাব। ভারতের বিদ্রোহী লিগ আইসিএলে যোগ দিয়ে এক প্রকার শেষ-ই করে দেন নিজের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। দেশের ক্রিকেটে তখন অপরিহার্য একজন সদস্য হয়ে উঠেছিলেন আফতাব।

লিগ শেষে দেশে ফেরত আসার পর ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিলেন আফতাব সহ আইসিএল খেলে দেশে ফেরা বাকি ক্রিকেটাররাও। পরবর্তীতে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হলেও আর স্বরূপে ফেরা হয়নি আফতাবের বাইশ গজে। দেশের হয়ে আর আগের মত চড়াও হতে পারেননি ক্রিকেটীয় পরাশক্তির বোলারদের উপর। পয়েন্টে কিংবা মাঠের যেকোনো জায়গায় ফিল্ডিং করে আর দেখা যায়নি দুর্দান্ত কোনো রান আউট করতে।

অথচ এই আফতাব ২০১০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আর মেলে ধরতে পারেননি নিজেকে। দেশের হয়ে একটি ৫০ ওভারের ও দুটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলেছেন আফতাব। তিন নম্বরে নেমে দুর্দান্ত ব্যাটিং করে আফতাব নিজেকে পরিচিত করেছিলেন একজন নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান হিসেবে।

আফতাব নিজেও জানেন ক্যারিয়ারের শেষ সময়ে নিজের প্রতি নিজের অবহেলাই সবচেয়ে বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায় তার হারিয়ে যাওয়ার পেছনে। যে বয়সে তার বন্ধুরা দিব্যি খেলে যাচ্ছিলেন বা এখনও যাচ্ছেন, সে বয়সে আকস্মিক একদিন ২০১৪ সালে অসময়ে সকল ধরণের ক্রিকেট থেকে অবসর নেনে ব্যাটিং অর্ডারের স্তম্ভ আফতাব।  তাই অবদানের খাতায় স্মৃতি হিসেবে চির অম্লান থাকলেও চিরকাল আক্ষেপের খাতায়ও তার নামটা যে থাকবে অনেক উপরে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link