তাঁকে বলাই হতো সাহসের প্রতীক। বুক চিতিয়ে লড়াই করে ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের অন্যতম সেরা দলটির নেতৃত্ব দিয়েছেন। প্রথম দুটি বিশ্বকাপ জিতেছেন এবং তিনটি বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলেছেন অধিনায়ক।
সেই ক্লাইভ লয়েডের কাছ থেকে এবার সাহস জোগানোর খোলা চিঠি পেলো বাংলাদেশ সফররত ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল।
তিন ম্যাচের ওয়ানডে ও দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ খেলতে বাংলাদেশে এসেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। করোনা ইস্যুতে সিরিজ থেকে নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম সারির ক্রিকেটাররা। বাধ্য হয়েই বাংলাদেশ সফরে অনভিজ্ঞ দল পাঠিয়েছে সফরকারীরা। অনভিজ্ঞ এই দলটাকে সাহস যোগাতে দূরদেশ থেকে খোলা চিঠি পাঠিয়েছেন সাবেক উইন্ডিজ অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েড।
খোলা চিঠিতে লয়েড বলেন, ‘আমি ভেবেছি তোমাদেরকে আমার এই বার্তাটা পাঠানো উচিত। কারণ আমি জানি, তোমরা এমন একটা সফরে গিয়েছে যেটার জন্য হয়তো তোমরা প্রস্তুত ছিলে না। তোমাদের মনে হতে পারে তোমাদেরকে গভীর সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়েছে এবং সেখান থেকেই তোমাদের কাছে খুব ভালো কিছু আশা করা হচ্ছে। তোমাকে এটা বুঝতে হবে যে এই সুযোগের মাধ্যমে তুমি ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করতে পারবে বরং এমন নয় যে অন্যের পরিবর্তে জায়গা পূরণ করবে। তোমার মেধার ভিত্তিতেই তোমাকে নির্বাচন করা হয়েছে। এটাই তোমার গন্তব্য। এই তোমার সুযোগ। তোমার প্রতিভা ও দক্ষতা বিশ্বকে দেখানোর এটাই উপযুক্ত সময় এবং এটাও প্রমাণ করার যে তুমি দ্বিতীয় সারির ক্রিকেটার নও। এই সুযোগে তোমাকে দায়িত্বের প্রমাণ দিতে হবে।’
শিমুর নার্সের চোটে ১৯৬৬ সালে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট শুরুর এক ঘন্টা আগে লয়েড জেনেছিলেন তাঁর অভিষেক হবে। টার্নিং উইকেটে ভারতের স্পিন আক্রমণ সামলে ৮২ ও অপরাজিত ৭৮ রানের দুটি চমৎকার ইনিংসে দলের জয়ে বড় অবদান রাখেন লয়েড। হঠাৎ পাওয়া সুযোগ দারুণভাবে কাজে লাগিয়ে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান ও দাপুটে অধিনায়ক হিসেবে।
নিজের অভিজ্ঞতা টেনে তরুণদের উদ্দেশ্যে লয়েড বলেন, ‘১৯৬৬ সালে আমি মূল টেস্ট দলে জায়গা পেয়েছিলাম না। অকস্মাৎ, সেইমর নার্স চোটে পড়েছিল এবং প্রথম টেস্ট ম্যাচের মাত্র ৪৫ মিনিট আগে আমি জেনেছিলাম যে আমি ম্যাচটি খেলব। তারপরে আমি টানা ৩৫টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছিলাম কারণ আমি ভালো পারফর্ম করেছিলাম। আমরা সিরিজটি জিতেছিলাম। দেখো, সেখানে আমি সুযোগ পেয়েছিলাম নিজের প্রতিভা ও সামর্থ্য দেখানোর এবং সেটাকে আমি দুহাতে আঁকড়ে ধরেছিলাম। তাছাড়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে খেলা এই এলাকার নাগরিকের জন্য সর্বোচ্চ একটি সম্মানের কাজ। এটা আমি তখনও বিশ্বাস করতাম আর এখনও করি।’
তিন ম্যাচের ওয়ানডে ও দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজের জন্য ১৫ সদস্যের স্কোয়াড নিয়ে বাংলাদেশে এসেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ওয়ানডে স্কোয়াডের ৯ জন ক্রিকেটার এবং টেস্ট স্কোয়াডের ৪ জন ক্রিকেটার রয়েছে অভিষেকের অপেক্ষায়। অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশের থেকে অনেক পিছিয়ে ক্যারিবিয়ানরা। অভিজ্ঞতায় পিছিয়ে থাকলেও লয়েড মনে করেন তরুণদের প্রমাণ করার এটাই সুযোগ।
তিনি বলেন, ‘তোমরাও ঠিক এই অবস্থায় আছো। এটাই সুযোগ নিজেকে প্রমাণ করে দলের জন্য নির্বাচিত হওয়ার এবং গর্বের সাথে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্লেজার ও কাপ পরার। তুমি বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্রিকেট দলের প্রতিনিধিত্ব করছো যাদের রেকর্ড গর্ব করার মতো। মনে রাখবে, আমরা মাত্র পাঁচ মিলিয়ন মানুষের দেশ। আমরা টানা ২৯টি টেস্ট অপরাজিত ছিলাম। টানা ১১টি জয় পেয়েছিলাম। টানা ১৭ বছর আমরা কোনো টেস্ট ম্যাচ হেরেছিলাম না।’
অতীতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই সফলতা এসেছিলো কঠোর পরিশ্রম থেকে। লয়েড তরুণদের পরামর্শ দিয়েছেন কৌশল ও দক্ষতাকে উন্নত করার চেষ্টা করে ক্যারিবিয়ানদের গৌরব ফিরিয়ে আনার।
তিনি বলেন, ‘এটা কেবলই আমাদের অতীতের কিছু রেকর্ড ও অর্জন। কঠোর পরিশ্রম, প্রতিজ্ঞা ও নিজেকে বুঝতে পারার সক্ষমতা থেকেই এই সফলতা এসেছিল। তাছাড়া আমি তোমাদেরকে উপদেশ দিবো যে নিজের ফিটনেস আরও ভালো করো এবং ব্যাটসম্যান ও বোলার সবাই নিজেদের কৌশল ও দক্ষতাকে উন্নত করার চেষ্টা করো। আমার দল এটাই করেছিল এবং আমি নিশ্চিত তোমরাও তাই পারবে। তোমাদের হাতে এখন সুযোগ আমাদের টেস্ট ম্যাচের রেটিং বৃদ্ধি করার এবং গৌরব ফিরিয়ে আনার। শুধু আমারই নয়, এটা পুরো ক্যারিবীয় অঞ্চলের প্রত্যাশা। তোমাদের জয় মানে তাদেরও জয়।’
নিজেদের প্রমাণ করে বাংলাদেশ সফরে ভালো করা অসম্ভব কিছু না বলে মনে করেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিশ্বকাপ জয়ী এই অধিনায়ক। লয়েড বিশ্বাস করেন এদের হাত ধরেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের টেস্ট ক্রিকেটের নতুন দিগন্ত উন্মোচন হবে।
লয়েড বলেন, ‘তোমাদের কাছে বাংলাদেশ সফর ভীতিকর মনে হতে পারে কিন্তু সেখানে ভালো করা তো অসম্ভবও না। এটাই উপযুক্ত সুযোগ। ক্রেইগ ব্রাথওয়েটের অধীনে তোমাদের দৃঢ়তা, পেশাদারিত্ব, তারুণ্য ও ত্যাগের বিনিময়েই টেস্ট ক্রিকেটে আমাদের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে। আমি কিন্তু তোমাদের মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছি না,নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। আমি অধিনায়ক হওয়ার আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল ২০টিরও বেশি টেস্ট ম্যাচ হেরেছিল এবং নতুনভাবে শুরু করার একটা স্পষ্ট বার্তা ছিল। আমার দলেও অনেক অনভিজ্ঞ ক্রিকেটার ছিল, যেমন তোমাদের আছে। তবুও আমার দল চ্যালেঞ্জ নিয়ে খুব ভালো করেছিল। আমি নিশ্চিত তোমরাও দলটাকে নতুন করে গড়ে তুলবে। আমরা পেরেছিলাম কারণ আমরা নিজেদের ওপর বিশ্বাস রেখেছিলাম। তোমরাও পারবে। নিজেদের ওপর বিশ্বাস রাখা হবে তোমাদের সাফল্যের প্রথম ধাপ।’
তরুণদের শুভকামনা জানিয়ে লয়েড বলেন, ‘আমি তোমাদেরকে মনে করিয়ে দিতে চাই যে, উঁচুতে উঠতে হলে তোমার মানসিকতাও উঁচু হতে হবে। ইতিবাচক মনোভাব তোমাকে কঠিন সময়েও সাহায্য করবে এবং আমি নিশ্চিত এই সফরে তোমরা ঘুরে দাঁড়াবে। পরিশেষে, অভিধানেও কিন্তু সাফল্য শব্দটা পরিশ্রমের আগেই আসে। তোমাদের প্রতি আমার শুভকামনা রইলো। দয়া করে মনে রাখবে, বেশির ভাগ মানুষকে মনে রাখা হয় তারা কতটা বাধা পার করে বড় হয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করে।’