বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের সবচাইতে প্রতিভাবান ব্যাটার বিবেচনা করা হতো তাঁকে। কিন্তু সেই গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে এসে ঠিক সাফল্যের দেখা পাচ্ছিলেন না একটা লম্বা সময় ধরে। স্বাভাবিকভাবেই নির্মম ঠাট্টার কশাঘাতে জর্জরিত হয়েছেন দীর্ঘ সময় ধরে।
তবে ২০২৩ সালে এসে যেন জ্বেলে দিলেন সাফল্যের রোশনাই। আসন্ন বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ব্যাটিং অর্ডারে তাঁকে রীতিমত ভাবা হচ্ছে হৃৎপিণ্ড। শূন্য থেকে শিখরে ওঠার গল্পটা এভাবেই লিখেছেন নাজমুল হোসেন শান্ত। যার দিকে গোটা বাংলাদেশ তাকিয়ে থাকবে ভারত বিশ্বকাপে।
চলতি বছরে চেমসফোর্ডে আইরিশদের বিপক্ষে ৩ ম্যাচে ওয়ানডে খেলতে গিয়েছিল বাংলাদেশ। সেই সিরিজে দ্বিতীয় ম্যাচেই দারুণ এক সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন শান্ত। তো সেই ম্যাচের ব্যাটিং দেখে ধারাভাষ্য কক্ষে থাকা অ্যালান উইলকিনস খানিকটা বিস্ময় প্রকাশই করেছিলেন- এত ভালো ব্যাটিং করছে, অথচ ছেলেটার ব্যাটিং গড় ২২/২৩-এর আশপাশে!
একদিনের ক্রিকেটে শান্তর ব্যাটিং গড় অবশ্য এখন ২২/২৩ নয়। ক্যারিয়ারের শুরুর ব্যর্থতা ঝেড়ে তিনি এখন এগিয়ে চলেছেন তরতর গতিতে। বিশ্বকাপের বছরে শান্ত যেন আরো অশান্ত। এখন পর্যন্ত ১৪ ইনিংসের ৭ টিতে পেরিয়েছেন পঞ্চাশ। ৫ ফিফটির পাশাপাশি সেঞ্চুরি করেছেন দুটি। তাতে ৪৯.৮৬ গড়ে তাঁর রান ৬৯৮।
তবে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শুরুটা মোটেই এতটা দুর্দান্ত ছিল শান্তর। ২০১৭ সালে টেস্ট দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক। এর পরের বছর ওয়ানডেতে এবং ২০১৯ সালে অভিষেক হয় টি-টোয়েন্টিতে। দারুণ প্রতিভাবান মানদণ্ডে টিম ম্যানেজমেন্ট শান্তর উপর আস্থা রেখেছিল বহু দিন ধরে।
তবে ২০১৭ সালে অভিষেক হওয়া শান্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পায়ের তলায় মাঠি খুঁজে পান ২০২১ সালে। সে বছর টেস্টে ২ টি সেঞ্চুরি পান তিনি। তবে ঠিক ধারাবাহিক হয়ে উঠতে পারছিলেন না। ক্রমেই তাঁর ব্যাটিং হয়ে উঠেছিল অনেকের কাছে বিরক্তির কারণ।
তবে সমর্থকদের সেই বিরক্তি এখন ডুবে গিয়েছে শান্তর ব্যাটিং সৌন্দর্য্যের ভুবনে। একদম মোক্ষম সময়ে এসে শান্ত হয়ে উঠেছেন পরিণত। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের হয়ে ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলবেন। শান্তর বিশ্বকাপ ইতিহাস আবার দুর্দান্ত।
ক্রিকেট ক্যারিয়ারে এর আগে একবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলেছিলেন। ২০২২ সালের সেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দলের হয়ে সর্বোচ্চ রান এসেছিল তাঁর ব্যাট থেকে। বয়স ভিত্তিক ক্রিকেট একবার যুব বিশ্বকাপও খেলেছেন। ২০১৬ সালের সেই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ ২৫৯ রান করেছিলেন শান্ত।
এবার বড়দের বিশ্বকাপ। ক্রিকেটের সবচেয়ে কূলীন বৈশ্বিক টুর্নামেণ্টে। ভারতে আসন্ন সেই বিশ্বকাপে নিশ্চয়ই দুর্দান্ত কিছু করার ব্রত নিয়েই এগোবেন শান্ত। অবশ্য তার ইঙ্গিত মিলেছে আগেই। ভারতগামী প্লেনে ওঠার আগের তিন ম্যাচে শান্তর ব্যাট থেকে এসেছে ৮৯, ১০৪ আর ৭৬ রান।
শুধু তাই নয়, নতুন এক রেকর্ডে নাম লিখিয়েই বিশ্বকাপের মঞ্চে পা রাখতে যাচ্ছেন নাজমুল হোসেন শান্ত। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সবশেষ সিরিজের শেষ ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বাঁ-হাতি এ ব্যাটার। আর এখানেই তিনি ছাপিয়ে গিয়েছেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল, হাবিবুল বাশার, সাকিবদের।
১৯৯৮ সালে ভারতের বিপক্ষে মোহালিতে ওয়ানডে অধিনায়ক হিসেবে অভিষেকে ৭০ রানের ইনিংস খেলেছিলেন আমিনুল ইসলাম। এর ৬ বছর পর ২০০৪ সালে হারারেতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অধিনায়ক হিসেবে অভিষেকেই ফিফটি তুলে নেন হাবিবুল বাশার। খেলেন ৬১ রানের ইনিংস। অধিনায়কত্বের অভিষেকে ফিফটি হাঁকান সাকিবও। ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে খেলেন ৫৪ রানের ইনিংস।
অধিনায়ক হিসেবে অভিষেক শান্তও পেয়েছেন ফিফটি। তবে ছাপিয়ে গিয়েছেন আগের তিনজনকেও। বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক হিসেবে অভিষেকে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস এখন নাজমুল হোসেন শান্তর।নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ ম্যাচে তাঁর ব্যাট থেকে এসেছে ৮৪ বলে ৭৬ রান।
নাজমুল হোসেন শান্ত কেবল ছাপিয়ে যেতে শুরু করেছেন। তবে সেটিতে শুধু তিনি দেশের গণ্ডিতেই আটকে থাকতে চান না। নাজমুলের ব্যাট যেভাবে কথা বলছে, তাতে বিশ্বকাপে বহু ইনিংসের গল্পের স্বাক্ষী হতেই পারে দেশের ক্রিকেট সমর্থকরা।
সমর্থকরা শান্তর ব্যাটিং নিয়ে দারুণ প্রত্যাশী—বছর খানেক আগেও তো এমনটা ট্রল টিপ্পনীর মধ্যেই আটকে থাকতো। নাজমুল হোসেন শান্ত সেখান থেকে উতরে তো বেরিয়েছেনই, সাথে সবার মাঝে তাঁকে নিয়ে একটা প্রত্যাশার গল্প লিখেছেন। এটাই বা কম কীসে। তবে তৃপ্ততা এখানেই আটকে না থাকুক। অতৃপ্ত শান্তর ব্যাটে সব সময় থাকুক রানতৃষ্ণা।