পাঁচশ বছর আগে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা ‘মোনালিসা’ই সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত চিত্রকর্ম। ফ্রান্সের ল্যুভ মিউজিয়ামে এখনো প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ শুধু মোনালিসার রহস্যময় হাসি দেখতে আসেন। ‘মোনালিসা’কে নিয়ে মানুষের উদ্দীপনার এখানেই শেষ নয়। যে কোনো শৈল্পিক ব্যাপার কিংবা চোখের সৌন্দর্য্যদায়ক জিনিসকেই মানুষ মোনালিসা চিত্রকর্মের সাথে সাদৃশ্যতায় বসিয়ে।
ক্রিকেটের ব্যাটিং এলিগেন্সের সাথেও শৈল্পিক ব্যাপারটা অনেকটা জড়িত। শচীন টেন্ডুলকারের স্ট্রেইট ড্রাইভ, রিকি পন্টিংয়ের পুল শট কিংবা ব্রায়ান লারার স্কোয়ার কাটকে এখনো ক্রিকেট অনুরাগীদের চোখে একটা সৌন্দর্য্য আর শৈল্পিক তৃপ্ততার আবহ তৈরি করে।
বাংলাদেশ ক্রিকেটে ‘মোনালিসা’র সাথে সাদৃশ্যতায় সবচেয়ে বেশি প্রশংসা কুড়িয়েছেন লিটন দাস। লিটন দাস যখন ছন্দে থাকে তখন যেন মনে হয় লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি বাইশ গজে একটা তুলির আঁচড় দিচ্ছেন। এমন তুল্য প্রশংসায় লিটন দাসের দুর্দান্ত সব স্ট্রোক যেমন বাংলাদেশের সমর্থকদের আনন্দে ভাসিয়েছে, ঠিক তেমনি তাঁর ব্যাটিং অনেক আক্ষেপের উপলক্ষ্যও তৈরি করেছেন।
২০২২ এবং ২০২৩, এই দুই বছরে লিটন দাস যেন হেঁটেছেন দুই মেরুতে। ২০২২ এ যেখানে ওয়ানডেতে তাঁর ব্যাটিং গড় ছিল ৫২.৪৫, সেখানে এ বছরে তা নেমে গিয়েছে ২৪.১৪ তে। আগের বছরে দারুণ ফর্মে থাকা লিটন যেন এ বছর নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন।
শঙ্কার বিষয়টা এখানেই। সামনেই যে বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপের বছরে এসে ব্যাট হাতে ছন্দ হারানো তো কোনো ভাল লক্ষণ নয়। তবে লিটনের জন্য পূর্ব অভিজ্ঞতায় আবার বেশ সুলক্ষণ বটে। ২০১৯ বিশ্বকাপের আগে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে ৩ ম্যাচে মোটে ৩ রান করেছিলেন লিটন। তারপরও সেবারের বিশ্বকাপে তাঁর উপরেই আস্থা রেখেছিল বাংলাদেশ।
লিটন সেই আস্থার প্রতিদান দিয়েছিলেন দারুণভাবে। ৫ ইনিংসের ৪৬ গড়ে করেছিলেন ১৮৪ রান। যার মধ্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচে ৩২২ রান তাড়া করতে নেমে খেলেছিলেন ৬৯ বলে অপরাজিত ৯৪ রানের ইনিংস।
২০১৯ বিশ্বকাপের লিটন এখন বেশ পরিণত। ৪ বছরের ব্যবধানে হয়ে উঠেছেন দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তামিম দলে না থাকায় এবার ইনিংস শুরুর গুরুদায়িত্বটা পড়বে তাঁরই কাঁধে। তবে আশার বিপরীতে শঙ্কা জাগানিয়া ব্যাপার তো থাকছেই। বড় প্রতিপক্ষ আসলেই যে ব্যাট হাসে না লিটনের।
লিটন দাসে ব্যাট যেন এখানেও দারুণ রহস্যময়। সামগ্রিকভাবে বড় দলের বিপক্ষে লিটন দাস ব্যর্থ হলেও ২০১৮ এশিয়া কাপের ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে খেলেছিলেন ১২১ রানের ইনিংস। ভারতের বিপক্ষে গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও খেলেছিলেন বিধ্বংসী ইনিংস। তবে ব্যাট হাতে দুর্দান্ত লিটন ঐ দুই ম্যাচেই ছিলেন পরাজিতদের দলে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৮ বছর পার করে ফেলেছেন লিটন দাস। তবে এখনো যেন ধারাবাহিকতা শিকলে নিজেকে আটকাতে পারেননি এ ব্যাটার। তবে ঐ যে ক্রিকেটের কূলীন বাক্যটাই যেন লিটনের ক্ষেত্রে সত্য- ফর্ম ইজ টেম্পোরারি, ক্লাস ইজ পার্মানেন্ট।
লিটন দাসের সক্ষমতা কিংবা প্রতিভা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। তবে সেই প্রতিভার পরিস্ফূরণটা যেন ঘটে এবারের বিশ্বকাপে। মোক্ষম সময়ে লিটনের ফেরায় যে তাতে বদলে যে বাংলাদেশ দলের চেহারাও। লিটনও নিশ্চয়ই আগের বিশ্বকাপের অর্জনকেও ছাপিয়ে যেতে চাইবে তাঁর ব্যাটিং মুনশিয়ানা দিয়ে।
২০২২ সালের লিটন যে এক বছর বাদে এখনই অস্তমিত হয়ে যায় নি, সেটি প্রমাণের মঞ্চ এই বিশ্বকাপও। পারফর্ম কিংবা প্রত্যাশার চাপ, সবটা জয় করতে পারবেন তো লিটন দাস? চাপ জয়ের গল্পে বাইশ গজে লিটনের তুলির আঁচড়ের দেখা মিলবে তো? সব কিছুর উত্তর দিবে ভারত বিশ্বকাপ।