জনগনমণের অধিনায়ক

সুনীল গাভাস্কার বলেছিলেন, ‘রোহিত শর্মার উচিত কয়েকদিন বিশ্রাম নেওয়া।’ বুধ সন্ধ্যার অরুণ জেটলি স্টেডিয়ামে পেল্লাই ছক্কা কি সেই সমালোচনারই জবাব?

বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে হতশ্রী হারের পরে ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছিলেন, ‘রোহিতের কাছ থেকে আরও বেশি আশা করছিলাম।’ বিরাট কোহলির ঘরের মাঠে আরও একটা বিশাল ছক্কা আছড়ে পড়ল গ্যালারিতে। গোটা দেশের সমালোচনাকেই কি উড়িয়ে দিলেন রোহিত গুরুনাথ শর্মা?

বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে পা নড়ল না, আউট হয়ে গেলেন। আবার বিষ দাঁত বের করলেন নিন্দুকরা। সমালোচনা ধেয়ে এল। বেচারি রোহিত শর্মা ক্ষতবিক্ষত। রক্তাক্ত।

বেছে নিলেন রাজধানী শহর। উড়ে গেল ছক্কা। ভেঙে গেল ক্রিস গেইলের সবচেয়ে বেশি ছয় মারার রেকর্ড। বিশ্বকাপে শচীন টেন্ডুলকারের ৬ টি সেঞ্চুরিও টপকে গেলেন। রোহিত শর্মা এখন আগে। ওড়াচ্ছেন দেশের পতাকা। বিজয়কেতন।

কে যেন জয়ের আনন্দ বলে উঠল, একটা দুরন্ত ছয় মারল ছেলেটা। জ্যোৎস্না পার হয়ে বলটা গিয়ে পড়ল আসামের জঙ্গলে, সেখানে তিনজন টেররিস্ট বসে আছে সাইনাইড খাবে বলে
তিনজনই লাফিয়ে উঠল, আ! মৃত্যু! দাঁড়াও!

আর একটা ছয় দেখে যেতে চাই

জ্যোৎস্না পার হয়ে, পার হয়ে, বল এসে পড়ল এবার

বম্বের ধারাভিতে-এশিয়ার সবচেয়ে বড় বস্তি

তিনজন মারামারি করছিল রুটি তরকা নিয়ে,

থেমে গেল। জোয়ারের মত বেরিয়ে গেল গোটা ঝোপড়ি

খেতে-না-পাওয়া জ্যোৎস্নায় থমকে দাঁড়ানো ভারতবর্ষ।

জ্যোৎস্না পার হয়ে বল এসে পড়ল আহমেদাবাদে।

আহমেদাবাদ! এখানেই তো শনিবার ভারত-পাক মহারণ। সেদিন আবার মহালয়া। পাক শিবির তৈরি তো? রোহিত শর্মা কিন্তু তৈরি। শাহীন আফ্রিদি আপনি রেডি?

বেশ কয়েকবছর আগের কথা। মাঝেরহাটে রোহিতের গুরু দীনেশ লাড এসেছেন। আমি আর আমার বন্ধু ছুটলাম দ্রোণাচার্যের কাছে। দীনেশ লাড গল্প করছিলেন আমাদের সঙ্গে। বলছিলেন, কোচিং জীবনে দুবার মেরেছিলেন তাঁর শিষ্যদের। একবার রোহিতকে। আর দ্বিতীয়বার তাঁর ছেলে সিদ্ধেশ লাডকে।

দীনেশ গল্প বলে চলেন, ‘জানেন তো, মুম্বইয়ের ক্রিকেটমহলে প্রচলিত রয়েছে, উইকেট ছুড়ে দিয়ে আসা একেবারেই চলবে না। ভাল ডেলিভারিতে আউট হলে অন্য কথা। কিন্তু, খারাপ বলে আউট হওয়া মহা অপরাধ। রোহিত তখন স্কুলের ছাত্র। এগারো-বারো বছর বয়স হবে। একটা ম্যাচে নিজের উইকেট ছুড়ে দিয়ে এল। ম্যাচটা ছিল কোয়ার্টার ফাইনাল। রোহিতের স্কুল স্বামী বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলও জয়ের দোরগোড়া থেকে ফিরে এল। ম্যাচটা হারতে হয়েছিল। রোহিতের আউট হওয়ার ধরন দেখে আমি নিজেকে স্থির রাখতে পারিনি। রোহিতের কানের পাশে কষিয়ে একটা চড় মেরে বসলাম।’

রোহিতের শর্মার কি মনে পড়ে যাচ্ছিল গুরুর ওই চড়ের কথা? রশিদ খানের গুগলিটা ঠিকমতো পড়তে পারলেন না। মারমুখী মেজাজের রোহিত গ্যালারিতে ফেলতে গেলেন রশিদকে। বল ফাঁকি দিয়ে গেল ব্যাট। তার পরের দৃশ্য–কোহলি সান্ত্বনা দিচ্ছেন রোহিতকে। ১৩১ রান করার পরেও রোহিতের মুখে হাসি নেই। কারা যেন সেই হাসি শুষে নিয়েছেন তাঁর মুখ থেকে! কারা? সমালোচকরা?

বারবার পিছনে ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন। হিসেব মেলানোর চেষ্টা হয়তো করছিলেন। কোথায় ভুল হল? কেন মারতে গেলাম শটটা? সাতপাঁচ চিন্তা করতে করতে রোহিত ঢুকে গেলেন প্যাভিলিয়নে। অপসৃয়মান রোহিতের ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে উঠল। বিশ্বকাপেও আপনি ছায়া দিন রোহিত। আব্বাসউদ্দিন যেভাবে গান, ‘আল্লাহ মেঘ দে পানি দে ছায়া দেরে তুই আল্লাহ মেঘ দে…।’ ঠিক সেই ভাবেই আমাদের আর্তি, বিশ্বকাপেও ছায়া দিয়ে যান। রোহিত ছায়ায় আরও বেড়ে উঠুক দেশের ক্রিকেট।

রোহিত শর্মা আপনি কি ভারতীয় ক্রিকেটের কর্ণ? হয়তো তাই। হয়তো নয়। আপনার প্রতিভা প্রশ্নাতীত। অথচ বীরপুজো তো আপনাকে নিয়ে হয় না! আপনি রেকর্ড গড়বেন, রেকর্ড ভাঙবেন, ম্যাচ জিতবেন, ম্যাচ জেতাবেন, সেঞ্চুরি করবেন, ছক্কা মারবেন, ফর্ম দেখাবেন…কিন্তু ব্যাট-প্যাডের ফাঁক দিয়ে বল গলে গেলেই গোটা ভারতবর্ষ চিৎকার করে বলবে, ‘রোহিত শর্মা, আপনার থেকে যে আরও অনেককিছু আশা করেছিলাম।’

প্রত্যাশা মেটে না। রোহিত পারবেন না দেশের এই অনন্ত প্রত্যাশার খিদে মেটাতে? পারতে আপনাকে যে হবেই।

প্রতিভা তো অনেকেরই থাকে। আপনার মতো ক’জনের আছে? মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো প্রতিভা আপনার। বিরাট কোহলি একবার আপনার নাম-ডাক শুনে বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন, ‘কে এই রোহিত শর্মা? একবার দেখতে হয় তো?’

আপনার ব্যাটিং দেখার পরে বলেছিলেন, ‘ওর ব্যাটিং দেখে আমি সোফায় বসে পড়েছিলাম। ঘোর আর কাটছিল না।’ দেশের রাজধানীতে অকাল দিওয়ালি এনে দিলেন। বিরাট কোহলিকেও ম্লান দেখাল আপনার কাছে।

২০১১ সালের ফাইনালের আগের রাতের কথা মনে পড়ছে। সেবার আপনি দলে সুযোগ পেলেন না। আমার এক বন্ধু সাংবাদিককে বললেন, ‘ঠিক সোয়া ন’টায় ফোন করবে। আমি ইন্টারভিউ দেব।’

আমার সেই বন্ধু সাংবাদিক গদগদ। আমরা তাঁকে শাপশাপান্ত করছি। ফাইনালের আগেরদিন এত রাতে ইন্টারভিউ। পাতায় কীভাবে বসাবো? সেই সাংবাদিক বললেন, ‘রোহিত কথা যখন দিয়েছে, ইন্টারভিউ দেবে।’ রোহিত আপনি বলেছিলেন, ‘জ্যাক (জাহির খান) বল হাতে দৌড়ও। বিশ্বকাপটা আমাদের চাই।’ সেদিন নাকি হৃদয় মুচড়ে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন আমার বন্ধুকে।

আপনার স্যার দীনেশ লাড বলেছিলেন, ‘২০০৯ থেকে ২০১১ পর্যন্ত খুবই খারাপ সময় গিয়েছে রোহিতের। ক্রিকেটের প্রতি মন ছিল না। কয়েকটা সিরিজে ভাল পারফর্ম করতে পারেনি। তার উপরে ২০১১ বিশ্বকাপ দলে জায়গা পায়নি। বিরাট কোহালি ঢুকে গেল বিশ্বকাপ দলে। মাঠের বাইরে থেকে রোহিতকে বসে দেখতে হল ভারত বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে গেল। এটা প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়েছিল রোহিতকে।’

স্নেহশীল বাবার মতো দীনেশ পুত্রসম শিষ্যকে বুঝিয়েছিলেন, ‘ক্রিকেটের জন্যই আজ তোর যত নাম ডাক। সেই ক্রিকেটকে অবহেলা করছিস কেন?’ রোহিত শর্মা এবার সুযোগ আপনার সামনে। প্রায়শ্চিত্ত করে যান আপনি।

রোহিত শর্মা আপনাকে নিয়ে কত গল্প! আপনি নাকি ভোলেভালা স্বভাবের। ইনিংসের শুরুতে ঢিলেঢালা ব্যাটিং করেন। সুযোগ নিয়ে নেয় প্রতিপক্ষ। অঙ্কুরে বিনষ্ট কর রোহিতকে। নইলে রক্ষে নেই।

ব্যবহারিক জীবনেও আপনি নাকি ভুলো মনের। ফোন হারিয়ে ফেলেন। পাসপোর্টও নাকি দু-একবার কোথায় ফেলে এসেছিলেন। এয়ারপোর্টে এসে খেয়াল পড়ে হোটেলের রুমে রয়ে গিয়েছে পাসপোর্ট। এখন ভারতীয় দলের সদস্যরা সতর্ক হয়ে গিয়েছেন।

– রোহিত সব নিয়ে এসেছো তো?

-ফেলে আসোনি তো কিছু?

-এবার তাহলে আমরা বাস ছাড়ছি?

আপনাকে জিজ্ঞাসা করে তবেই টিম বাস নাকি রওনা দেয়। বিরাট কোহলি বলেন, ‘রোহিত সব ভুলে ফেলে আসতে পারে। কিন্তু ব্যাট আর গ্লাভস ফেলবে না।’ ওই ব্যাটই যে রোহিতের গাণ্ডীব। ওই ব্যাটই জবাব দেবে তাঁর হয়ে। আপনি ব্যাট হাতে যতটা সপ্রতিভ, সাংবাদিক বৈঠকে ততটা নন। এবারের বিশ্বকাপে আপনি-ই আমার দেশের মুখ।

আমি ধর্ম, আমি অধর্ম, আমি ব্রাহ্মণ, আমি মেথর,

আমি রাস্তা ঝাঁট দিই, আমি ইটভাটায় ইট তুলি

আমি কলেজে পড়ি, আমি জেলখানায়

আমি মাঠে, আমি বস্তিতে, আমি বারোতলায়

আমাকে চিনলে না?

আমি ভারতবর্ষ।

রোহিত শর্মা আমার অধিনায়ক। তোমার অধিনায়ক। জনগনমণের অধিনায়ক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link