চেনা দু:খ চেনা ‍সুখ ও একজন বিরাট

গভীর রাতে বাবা চলে গেলেন তারাদের দেশে। বাবাই যে ছিলেন বিরাট কোহলির ফ্রেন্ড, ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড। এখনও বাবার কথা বললে গম্ভীর হয়ে যান তিনি, চ্যাম্পিয়নের চোয়াল হয়ে যায় শক্ত। মনের কোণে দু:খ যে এখনও জমাট বেঁধে আছে।

সেই ভোরের স্মৃতি কখনও ভোলার নয়। জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের অবিস্মরণীয় গানের এক লাইন দিয়েই বোঝানো যায় সেই বিরাট-ব্যথার অনুভূতি। এ কোন সকাল রাতের চেয়েও অন্ধকার।

গভীর রাতে বাবা চলে গেলেন তারাদের দেশে। বাবাই যে ছিলেন বিরাট কোহলির ফ্রেন্ড, ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড। এখনও বাবার কথা বললে গম্ভীর হয়ে যান তিনি, চ্যাম্পিয়নের চোয়াল হয়ে যায় শক্ত। মনের কোণে দু:খ যে এখনও জমাট বেঁধে আছে।

কাল ঘরের মাঠে বিরাট নামবেন। আগেও নেমেছেন। আবারও নামবেন। এবারের নামা বড্ড স্পেশাল। বিশ্বযুদ্ধের মঞ্চে হোমকামিং। ঘরে ফিরলেন ঘরের ছেলে। চেনা দুঃখগুলো আরও বেশি যেন জীবন্ত হয়ে উঠবে!

চেনা সুখগুলোও সুখপাখি হয়ে উড়বে ওই সবুজ মাঠের আনাচকানাচে।

সুখের মুহূর্তও তো কম নেই রাজধানীতে। প্রথম যখন দেশের অধিনায়ক হলেন, আবেগতাড়িত শিষ্য তাঁর গুরুর পা ছুঁয়ে বললেন, ‘আমি সাইকেলের সামনে কিট ব্যাগ নিয়ে আপনার অ্যাকাডেমিতে আসতাম। সেই ছেলে আজ দেশের অধিনায়ক। মনে পড়ে আপনার?’

চোখে জল ছাত্রের। নিজের অজান্তে গুরুর চোখ দিয়েও নেমে আসছে জলের ধারা। এই শহর বিরাট কোহলির বড় আপন। এই শহর জানে তাঁর প্রথম সবকিছু।

চেনা চেনা হাসি মুখ।

বিরাট কোহলির কি মনে আছে সেই দুধওয়ালাকে! প্রতি রবিবার রাজকুমার শর্মা তাঁর অ্যাকাডেমির ছাত্রদের মাইলের পর মাইল দৌড় করাতেন। স্যারের কথামতো ছাত্ররা দৌড়ত। দুষ্টু বিরাট ওই দুধওয়ালাকে বলত, ‘ভাইয়া, আমাকে একটু সাইকেলে করে নিয়ে যাবেন।’

যে ছেলেটা সবার আগে দৌড়চ্ছে, দুধওয়ালার সাইকেলে চেপে ছোট্ট বিরাট তাকেও অতিক্রম করে নামত। তার পরে শুরু করত দৌড়।

দ্রোণাচার্য রাজকুমার শর্মা এসব কিছুই জানতেন না। তিনি স্কুটার করে এসে দেখতেন বিরাট কোহলি সবার আগে দৌড়চ্ছেন। গুরুর মুখে হাসি খেলে যেত। অস্ফুটে বলতেন, ‘বাহ বিরাট সবার আগে দৌড়চ্ছে।’

বিরাট কোহলি দৌড়ে চলেছেন। স্বপ্নকে ধাওয়া করছেন এখনও। দেশ বলছে, বিরাট কোহলির দৌড় যেন না থামে। ঘরে ফিরেছেন বিরাট। খেলতে নামবেন আফগানদের বিরুদ্ধে। চেনা শহরের অলিগলিতে দাঁড়িয়ে চেনাপরিচিতরা মুখে হাসি ঝুলিয়ে বিরাট-স্মৃতিতে ডুব দিচ্ছেন।

চেনা আলো চেনা অন্ধকার।

অন্ধকার সেই রাতের কথাই বলি আরও একবার। জীবন বদলে দেওয়া এক রাত।

রঞ্জি ট্রফির ম্যাচ চলছিল। চল্লিশ রানে অপরাজিত ছেলেটা। পরের দিন দলকে বাঁচাতে হবে। সারাদিনের পরিশ্রমে ঘুমিয়ে পড়েন বিরাট।

এদিকে রাত বাড়লে বাবার অসুস্থতাও বাড়ে। গভীর রাতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন বাবা। কী করবেন বিরাট কোহলি! বুঝে উঠতে পারেন না। একদিকে পিতৃবিয়োগ। অন্যদিকে দল ঝুলছে ট্রাপিজের সুতোয়। মনের ডাকে সাড়া দিয়ে কোহলি বেরিয়ে পড়লেন খেলতে।

দিল্লির নির্দিষ্ট এক জায়গা থেকে ঈশান্ত শর্মাকে রোজ তুলতেন। হাসি ঠাট্টা করতে করতে মাঠে পৌঁছতেন। সেদিন কোহলি গম্ভীর। ঈশান্ত জিজ্ঞাসা করলেন, ‘দোস্ত এত চুপচাপ কেন?’

কোহলির কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে যান ঈশান্ত। ড্রেসিং রুমে গিয়ে ঈশান্তই জানালেন কোহলির বিপর্যয়ের কথা। ৯০ রান করল ছেলেটা। সেখান থেকে ছুটলেন শ্মশানে। জীবনের আলো অন্ধকারে মেশানো ওই রাস্তাই কোহলিকে আজ বিরাট বানিয়েছে। বাবার নিথর দেহের পাশে দাঁড়িয়ে শপথ নিয়েছিলেন দেশের হয়ে খেলতে হবে। বড় ক্রিকেটার হতে হবে। বাকিটা বিচার করবেন দেশের মানুষ।

চেনা মাটি চেনা পাড়া চেনা পথে কড়া নাড়া চেনা রাতে চেনা চিৎকার।

ওই মহল্লার দিনগুলো নিশ্চয় মনে পড়ে বিরাট কোহলির। সপাটে বল মারলেন। পড়শির জানালার কাঁচ ভেঙে গেল। বকুনি দেওয়ার জন্য গোটা পাড়া যখন রাস্তায় নেমে এল তখন দেখা গেল সবাই পালিয়েছে।

ছোট্ট এক বিরাট কোহলি ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে। পালিয়ে যাওয়ার বান্দা নন তিনি। দেশ যখন বিপন্ন, কোহলি তখন বিরাট হয়ে ওঠেন।

যখন ওই ফিরোজ শাহ কোটলায় থুড়ি অরুণ জেটলি স্টেডিয়ামে কোহলিয়ানায় মজে থাকবেন সবাই, তখন কি নস্ট্যালজিক হয়ে পড়বেন না স্বয়ং বিরাট?

চেনা মাটির চেনা স্টেডিয়ামে নামার আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, নিজের নামাঙ্কিত প্যাভিলিয়নের সামনে খেলতে অস্বস্তি বোধ হয় তাঁর।

কাল দিন গড়িয়ে রাত নামলে চেনা চিৎকার শুনবেন কোহলি। দিল্লির ওই স্টেডিয়ামে শব্দব্রহ্ম উঠবে বি-রা-ট, বি-রা-ট। এই চিৎকার, এই শব্দ যে তাঁর বড় পরিচিত।

চেনা চোখ চেনা ঠোঁট।

মদনলাল অ্যাকাডেমির ওই কাট আউট কি মনে আছে বিরাট কোহলির? বিরাটের এক বন্ধুর মা স্মৃতি উস্কে বলছিলেন, ‘মদনলাল অ্যাকাডেমির মাঠের সামনে কোনও এক সিনেমা আর্টিস্টের কাট আউট ঝুলছিল। বিরাট সেই কাট আউটের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, “একদিন আমিও অনেক বড় হব। আর কোনও এক নামী অভিনেত্রীকে বিয়ে করবো।’

বিরাটের সেই বন্ধুর মা আজ স্মৃতিরোমন্থন করে বলেন, ‘মন থেকে যদি কিছু চাওয়া যায় তাহলে তা সত্যি সত্যিই ফলে যায়।’

বিরাট কোহলি একটুও বদলাননি। সেই বন্ধুর মাকে আজও দেখলে জড়িয়ে ধরেন। আদর করে বলেন, ‘আন্টি আপনার রান্না তো বেশ ভালো। আমার জন্য রুটি আর ছোট আলুর তরকারি করে আনতেন।’

বিরাটের সেই আন্টি বলেন, ‘ওর চোখ দুটো দেখলে সেই ছোটবেলার বিরাটের কথা মনে পড়ে যায়।’ সেই স্বপ্ন মাখা দুটো চোখ আজও খোঁজে ফেলে আসা মুহূর্তগুলোকে। সেই মুহূর্তগুলো জানে বিরাট কোহলি হয়ে ওঠার গল্প।

চেনা ছেলেদের জোট।

ছেলেবেলার বন্ধুরা বিরাট ব্যাটিংয়ের কথা ভোলেননি। এক বন্ধু বলছিলেন, ‘বিরাট ১৯০ রানে ব্যাট করছে। এদিকে একের পর এক উইকেট পড়ছে আমাদের। আমি ব্যাট করতে নামলাম। বিরাট এসে আমাকে বলল, তোকে কিছু করতে হবে না। কেবল ক্রিজে দাঁত কামড়ে পড়ে থাক। বাকিটা আমি দেখছি।’

ম্যাচে আড়াইশো রান করেছিলেন বিরাট কোহলি। সেই পরম্পরা এখনও চলছে। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে পর পর উইকেট হারিয়ে দেশ যখন নাভিশ্বাস তুলছে, তখন লোকেশ রাহুলকে পরামর্শ দিয়ে বহু যুদ্ধের সৈনিক বলেন, ‘টেস্ট ম্যাচের মতো খেলে যা। হড়বড় করবি না।’

চেনা মোড়ে চেনা দঙ্গল।

রাজকুমার শর্মার সেই অ্যাকাডেমির মোড়, দিল্লীর গলিঘুজি, আন্ডারগ্রাউন্ড বাজার সব এখনও কড়া নেড়ে যায় কোহলির মনে। হাতে ট্যাটু এঁকে গরমের মধ্যে ফুল হাতা জামা পড়ে ঘুরতেন। গুরু দেখে ফেললে আর রক্ষে নেই। ছেলেদের দঙ্গলের সামনে শুরু হয়ে যাবে বকাঝকা। মাথায় পড়তেও পারে দু-একটা চাঁটি।

একদিন আশঙ্কা সত্যি হল। কোচ জেনে গেলেন সব। মারাত্মক রেগে গিয়ে গুরু বললেন, ‘এই সব কী হচ্ছে? ক্রিকেটটা যাবে এবার।’

শান্ত কণ্ঠে বিরাট বললেন, ‘আরও একটা বানাবো।’গুরু তিরিক্ষি মেজাজে ঝাঁঝিয়ে উঠে বললেন, ‘সামনে খেলা আছে বাইরে। রান করতে পারলে আরেকটা ট্যাটু বানিয়ে নিও।’

রান করলেন প্রিয় শিষ্য। ট্যাটুও বানালেন। একসময়ে গুরুকেই বললেন, ‘এই ট্যাটু হাত থেকে এবার তুলে ফেলি।” তিনি নিষেধ করে বললেন, ”এই ট্যাটু পরেই রান পেয়েছো। হাত থেকে মুছে ফেলো না ট্যাটু।’

মন থেকে কিছুই মোছেননি বিরাট। না তাঁর ছেলেবেলা, না প্রিয় শহরের স্মৃতি। ভেসে আসছে পরিচিত গান, চেনা দুঃখ চেনা সুখ, চেনা চেনা হাসিমুখ, চেনা আলো চেনা অন্ধকার।

এ গান আমার, এ গান তোমার, এ গান সবার। এ গান বিরাট কোহলিরও।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...