‘কৌশিক তুই আগে ঘুমা, আমি বাতি নিভিয়ে ঘুমাবো’

আজ স্মৃতির পাতা ঘাঁটতে গেলে ভেসে উঠে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বল হাতে মাত্র ১৯ বছর বয়সে মাইকেল ভনকে বোকা বানানোর স্মৃতি। ভেসে উঠে টেস্ট ক্রিকেটে শন আরভিনকে আউট করে সেলিব্রেশন করার দৃশ্যটি। মনে পড়ে ধীরে ধীরে একজন পারফেক্ট অলরাউন্ডার হওয়ার দিকে ধাবিত হওয়া জার্সি নাম্বার ‘৯৬’-এর স্মৃতি। মনে পড়ে, তৎকালীন বাংলাদেশ দলে রফিককে সাপোর্ট দেবার মত একজন কার্যকরী বাঁহাতি স্পিনার এবং একই সাথে লেট অর্ডারে প্রয়োজনের সময় দ্রুত রান তোলার দক্ষতা দেখানো একজন দুরন্ত তরুণ স্মৃতি। যিনি মন জয় করেছিলেন কোচ ডেভ হোয়াটমোরের! এমন অনেক স্মৃতি লুকিয়ে আছে সেই মানুষটির নামের সাথে।

অন্য কয়েকটি দিনের মতো সেদিনও সবকিছু ঠিকঠাক চলছিলো মাশরাফির। বিশ্বকাপ খেলতে বাংলাদেশ দল তখন ক্যারিবিয়ান দীপপুঞ্জে। ম্যাশের প্রিয় বন্ধু তখন দেশে, যাওয়া হয়নি বিশ্বকাপ খেলতে। বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন পূরণ না হলেও একজন মানুষ জয় করেছিলো মাশরাফির মন।

তিনি ছিলেন ম্যাশ-রাসেলদের প্রিয় বন্ধু। বিশ্বমঞ্চে যাবার আগে প্রিয় বন্ধুর থেকে ম্যাশ হয়তো দোয়া চেয়েছিলো! কিন্তু ম্যাশ কি জানতেন, দেশে ফিরে প্রিয় বন্ধুটিকে আর কখনো দেখার সৌভাগ্য হবে না! জানা তো দূরের কথা, এমন কিছু তো স্বপ্নেও কল্পনা করেনি প্রিয় ম্যাশ। কিন্তু তাকে কি? বিধাতা যে এমন কিছুই লিখে রেখেছিলো সেদিন।

দিনটি ছিল ১৬ মার্চ ২০০৭, ঠিক একদিন পরেই বিশ্বকাপ মঞ্চে লাল-সবুজের পতিপক্ষ শক্তিশালী ভারত। ভারত বধের নেশাটা তখনো কৌশিককে হয়তো ঘিরে ধরেনি! বিগত কয়েকটা দিনের মতো সেদিন ছিলো না ম্যাশ। জ্বর নিয়েও একপ্রকার ফুরফুরে মেজাজেই অনুশীলন চালিয়ে গেলেন। একটা সময় খবর এলো ম্যাশের প্রিয় বন্ধুটি দুনিয়ায় মায়া ত্যাগ করেছেন। এ যেনো মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়ার মতো মূহুর্ত! এতো হৃদয়বিদারক! প্রিয় বন্ধুর হঠাৎ চলে যাওয়ার খবর শুনেই ফুরফুরে মেজাজের মাশরাফির রূপটা ক্ষণিকের মধ্যেই বদলে গেলো।

এমন হৃদয়বিদারক মূহুর্তে ম্যাশ হয়তো একটু পিছনে ফিরে যেতে চাইলেন! কান্নাভেজা চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে করতে থাকলেন পুরোনো স্মৃতি। ভেসে উঠলো ২২ গজের সবুজ গালিচায় মাতিয়ে বেড়ানো সেই আনন্দের স্মৃতি, ভেসে উঠলো হঠাৎ পিঠে চড়ে বসা এক দুরন্ত তরুণের কথা। চোখের সামনে বন্ধুর মায়াবী চেহারাটা যেনো আরো একবার ভেসে উঠলো। ভেসে উঠলো সারাক্ষন হাসি লেগে থাকা প্রিয় সঙ্গীর সাথে কাটানো স্মৃতি। এভাবেই কিছুটা সময় কেটে গেলো।

হঠাৎ করে বদলে গেলো বাংলাদেশের ড্রেসিং রুমের মূহুর্ত! একটু আগেও যেখানে সবাই হাসি আড্ডায় মেতে ছিলো এখন সবাই একজন মাশরাফির নিরব কান্নায় স্তম্ভিত হয়ে পড়লো। কিন্তু ম্যাশ যে ভেঙ্গে পড়ার পাত্র নয়! হঠাৎ করে উঠে দাঁড়ালেন। প্রবল জ্বর নিয়ে মাশরাফি বলে উঠলেন ‘ধরে দিবানি’। সবার মাঝে ঘোষণা দিলো আগামীকাল ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে আমাদের জিততেই হবে! আর সেই জয় উৎসর্গ করা হবে আমাদের প্রিয় বন্ধুকে।

যেই বলা সেই কাজ! পরেরদিন শক্তিশালী ভারতের বিপক্ষে মাঠে নামার আগে ১ মিনিট নিরবতা পালন করা হলো ম্যাশের প্রিয় বন্ধুর জন্য। এরপর রচিত হলো নতুন অধ্যায়, তৈরি হলো ‘ধরে দিবানি’র ইতিহাস! আগের রাতের কথা অনুযায়ী জয়টি উৎসর্গ করা হলো, এরপরে আর কখনো তাকে নিয়ে ইতিহাস তৈরি হয়নি। তবে সেই মানুষটি এখনো সবার হৃদয় মাঝে জায়গা করে বেঁচে আছে প্রিয় ম্যাশ-রাসেলদের অন্তরে।

সময় গড়িয়েছে, বাংলাদেশ ক্রিকেট অনেকটা এগিয়েছে, হঠাৎ চলে যাওয়া মানুষটির প্রিয় বন্ধুটি এখন দেশসেরা পেসার, সাকিব এখন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। হয়তো অনেকে ভুলে গেছে সেই মানুষটিকে! যেই মানুষটি হতে পারতো একজন সেরা অলরাউন্ডার। তিনি আজ নেই। তবে, অন্য সবার মাঝ থেকে বিদায় নিলেও পেরেছেন কি মাশরাফির স্মৃতির আড়াল হতে! মাশরাফির কি মনে পড়েনা প্রিয় বন্ধুর কথা?

আচ্ছা ম্যাশ না হয় রানাকে ভুলে গেছে, কিন্তু ১৬ মার্চ ২০০৭ সালে রানার কি প্রিয় ম্যাশের কথাটি একবারো মনে পড়েনি? স্মৃতিতে কি একবারো ভেসে উঠেনি প্রিয় মায়ের কথা! হয়তো এইসব চিন্তা করেনি রানা। কারণ বিধাতা যে তাকে কাছে পেতে চেয়েছিলো। যদি বিধাতা তাকে কাছে না টানতেন তাহলে রানা সেদিন সাই সাই করে বাইক না চালিয়ে প্রিয় ম্যাশের কথাটি ‘একটু সাবধানে চালাস রানা’ একবার হলেও চিন্তা করতেন!

এইসব নিয়ে না হয় অন্য একদিন গল্প শোনাবো। আজ ম্যাশের প্রিয় বন্ধুর কিছু স্মৃতি মনে করা যাক!

সময়টা ৪ মে, ১৯৮৪ সাল! খুলনায় মা-বাবার কোলে আলো হয়ে এসেছিলেন তিনি। ছোট বেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি ছিলো বাড়তি নেশা। স্বপ্ন দেখতেন একদিন দেশের হয়ে ২২ গজ মাতাবেন! উঁচিয়ে ধরবে লাল-সবুজের পতাকা। হ্যা, কিছু স্বপ্ন পূরণ হয়েছিলো, পূরণ হয়েছিলো লাল-সবুজের জার্সি গায়ে দেবার। পূরণ হয়েছিলো লাল-সবুজের জার্সিটিকে প্রমাণ করার। কিন্তু সে যে বড্ড অভিমানী! তাইতো অনেক স্মৃতির জন্ম দিয়েও আজ নেই ক্রিকেটপ্রেমীদের মাঝে, নেই প্রিয় বন্ধুর সংস্পর্শে!

আজ স্মৃতির পাতা ঘাঁটতে গেলে ভেসে উঠে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বল হাতে মাত্র ১৯ বছর বয়সে মাইকেল ভনকে বোকা বানানোর স্মৃতি। ভেসে উঠে টেস্ট ক্রিকেটে শন আরভিনকে আউট করে সেলিব্রেশন করার দৃশ্যটি। মনে পড়ে ধীরে ধীরে একজন পারফেক্ট অলরাউন্ডার হওয়ার দিকে ধাবিত হওয়া জার্সি নাম্বার ‘৯৬’-এর স্মৃতি। মনে পড়ে, তৎকালীন বাংলাদেশ দলে রফিককে সাপোর্ট দেবার মত একজন কার্যকরী বাঁহাতি স্পিনার এবং একই সাথে লেট অর্ডারে প্রয়োজনের সময় দ্রুত রান তোলার দক্ষতা দেখানো একজন দুরন্ত তরুণ স্মৃতি। যিনি মন জয় করেছিলেন কোচ ডেভ হোয়াটমোরের! এমন অনেক স্মৃতি লুকিয়ে আছে সেই মানুষটির নামের সাথে।

এতক্ষণে বুঝে গেছেন মাশরাফির প্রিয় বন্ধুটি কে ছিলো! হ্যা সে আর কেউ নয়, রাসেলের খুনসুটির সাথী, রফিকের সহযোগী, হতে পারতেন সাকিব আল হাসানের মতো বড় তারকা! এতোকিছু না হতে পারলেও তিনি হয়েছেন মাশরাফির প্রিয় বন্ধু। নাম কাজী মানজারুল ইসলাম রানা। যিনি হতে পারতেন সেরা তারকাদের একজন, হতে পারতেন অনেক রেকর্ডের সাক্ষী, কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠেনি। খুব অল্প বয়সে বিদায় নিয়েছেন আমাদের মাঝ থেকে।

এই অল্প সময়ে আমাদের মন যতটা জয় করেছে তার থেকে বেশি কষ্ট দিয়েছে প্রিয় পরিবারকে। মায়ের আদরের রানা মায়ের স্মৃতির পাতায় রয়েছেন প্রতিটি মূহুর্তে। আজো রূপসা পাড়ে ক্রিকেট আনন্দের রেণু ছড়ালেই এক মায়ের হৃদয়ে হাহাকার করে ওঠে। ছেলের স্মৃতি হানা দেয় মায়ের মানসপটে, আর সেই হাহাকারের কারণ ঐ রানা।

এখনো রানার বাড়িতে গেলে দেখতে পাওয়া যায়, দোতলা বাড়ির প্রবেশ মুখে সাজানো রয়েছে রানার পাওয়া পুরস্কারগুলো। দোতলায় রানার ঘরটি মা সব সময় পরিচ্ছন্ন রাখেন। ঘরে অন্য কারও প্রবেশাধিকার যে এখনো নেই। ঘরটি বেশ পরিপাটি। দেখে মনে হয় যেন রানা এখনও ঐ বাড়িতেই থাকেন!

এমন স্মৃতি আঁকড়ে ধরে এখনো এগিয়ে যায় রানার পরিবার। দিনের পর দিন পার হলেও মাশরাফি হয়তো অবসরে এখনো অনুভব করে প্রিয় বন্ধুর অনুপস্থিতি। হাজারো কষ্ট বুকে চাপিয়ে দূর আকাশে তাকিয়ে হয়তো বলে ‘রানা নেই, আমার বন্ধু নেই।’ এখনো হয়তো রাতে ঘুমাতে গেলে মনে পড়ে রানার সেই কথাটি, ‘কৌশিক তুই আগে ঘুমা, আমি বাতি নিভিয়ে ঘুমাবো!’

হ্যাঁ, সেই ১৬ মার্চের পর ম্যাশকে বাতি নেভানোর কাজটি একা একাই করতে হয়েছে। প্রিয় বন্ধুটি যে দুনিয়ার আলো বন্ধ করে চলে গেছেন পরপারে।

রানাকে নিয়ে আজকের গল্পটা হয়তো অন্যরকম হতে পারতো, হতে পারতো কোনো ইতিহাস, কোনো গৌরবময় রচনা নিয়ে। কিন্তু সেটা লেখার সৌভাগ্য হলো না। সবশেষে ক্রিকেট মাঠে তার পারফরম্যান্স গুলো দেখে নেওয়া যাক:

  • টেস্ট ক্রিকেট: বাংলাদেশের হয়ে ৬ টি টেস্ট খেলার সৌভাগ্য হয় তার। ক্রিকেটের এই রাজকীয় ফরম্যাটে ব্যাট হাতে ২৫.৭০ গড়ে ২৫৭ রানের পাশাপাশি বল হাতে ৮০.২০ গড়ে ৫ উইকেট!
  • ওয়ানডে: লাল-সবুজের জার্সিতে ২৫ ম্যাচ প্রিয় ব্যাটটি হাতে নেওয়ার সুযোগ পান রানা। এই ফরম্যাটে ব্যাট হাতে ২০.৬৮ গড়ে ৩৩১ রানের পাশাপাশি বল হাতে ২৯.৯৫ গড়ে ২৩ উইকেট!
  • প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেট: ক্রিকেটের এই ফরম্যাটে ৪৬ ম্যাচে ৩৬.২৬ গড়ে সর্ব্বোচ ১৫১ রানে ২৪৬৬ রানের পাশাপাশি বল হাতে সর্ব্বোচ্চ ৮২/৭ উইকেটে মোট ১২৭ উইকেট শিকার করেন।
  • লিস্ট এ: ৬৫ ম্যাচে ১৯.৭৫ গড়ে ৮৬৯ রানের পাশাপাশি বল হাতে ৮৫ উইকেট শিকার করেন।

উপরের এই পরিসংখ্যান গুলো আজ শুধুই স্মৃতি হয়ে আছে।তবে, বাংলাদেশ ক্রিকেটে সোনার অক্ষরে লেখা আছে সেই রানার নাম। কিন্তু নেই সেই টগবগে রানা।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...