মোড় ঘুরানো অমর নায়ক

ইনিংসের চতুর্থ ওভারের কথা। বল করছিলেন ভারতীয় দলের সবচেয়ে অপরিচিত বোলার, বেশিরভাগ বলই আউটসুইং করে বেরিয়ে যাচ্ছে। সে বলটাও বেরিয়ে যাবে ভেবেই ছেড়ে দিয়েছিলেন গর্ডন গ্রিনিজ। কিন্তু হুট করে বলের প্রকৃতি গেল বদলে, হালকা ভেতরে ঢুকে ফেলে দিল অফস্ট্যাম্পের বেল। হতভম্ভ গ্রিনিজ হাঁটা দিলেন ড্রেসিংরুমের উদ্দেশ্যে। অন্যদিকে, ম্যাচে লড়াই করার রসদ পেয়ে গেল ভারত।

ঘটনাস্থল লর্ডস, ১৯৮৩ বিশ্বকাপের ফাইনাল। আগের দুইবারের চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজের মুখোমুখি সেই বিশ্বকাপের চমক ভারত। প্রথম ইনিংসে ভারত ১৮৩ রানে অল আউট হবার পর ক্যারিবীয়দের হ্যাটট্রিক শিরোপা জয় তখন কেবল সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু ভাগ্যবিধাতা বোধহয় ভেবে রেখেছিলেন অন্য কিছু!

ইনিংসের চতুর্থ ওভারের কথা। বল করছিলেন ভারতীয় দলের সবচেয়ে অপরিচিত বোলার, বেশিরভাগ বলই আউটসুইং করে বেরিয়ে যাচ্ছে। সে বলটাও বেরিয়ে যাবে ভেবেই ছেড়ে দিয়েছিলেন গর্ডন গ্রিনিজ। কিন্তু হুট করে বলের প্রকৃতি গেল বদলে, হালকা ভেতরে ঢুকে ফেলে দিল অফস্ট্যাম্পের বেল।

হতভম্ভ গ্রিনিজ হাঁটা দিলেন ড্রেসিংরুমের উদ্দেশ্যে। অন্যদিকে, ম্যাচে লড়াই করার রসদ পেয়ে গেল ভারত। মহিন্দর অমরনাথ, কপিল দেবের উপর ভর করে অঘটন ঘটিয়ে ম্যাচ জিতে নেয় ভারত। সে বিশ্বকাপের প্রসঙ্গ ভারতীয়রা উল্লসিত হয় সুনিল গাভাস্কার, অমরনাথ, কপিল দেব, রজার বিনিদের নিয়ে।

সেই বিখ্যাত ডেলিভারি

কিন্তু, কেউই তার নাম নেয় না, ইতিহাস যেন ভুলে যেতে বসেছে তাঁকে। অথচ গ্রিনিজকে ফিরিয়ে প্রথম ধাক্কাটা দিয়েছিলেন, দলকে জুগিয়েছেন জয়ের বারুদ। অথচ ইতিহাস তাকে প্রাপ্যটা ফিরিয়ে দেয়নি। তিনি বলবিন্দর সিং সান্ধু।

১৯৫৬ সালে ভারতের মুম্বাইয়ে জন্মগ্রহণ করে সান্ধু। তার পিতা হারনান সিং নাজ ছিলেন পাঞ্জাবি ভাষার বিখ্যাত কবি। শুরুতে অফস্পিনার হিসেবে খেলা শুরু করেন সান্ধু। কিশোর বয়সেই তিনি বিখ্যাত কোচ রমাকান্ত আচরেকারের কাছে অনুশীলন শুরু করেন।

রমাকান্ত আচরেকার ছিলেন মুম্বাইয়ের বিখ্যাত কোচ, জহুরীর চোখ দিয়ে যিনি বের করে আনতেন খাঁটি হীরে। শচীন টেন্ডুলকার, বিনোদ কাম্বলির মতো ক্রিকেটারদের ক্রিকেটগুরু ছিলেন তিনিই। সান্ধুর মাঝেও তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন প্রকৃত পেস বোলারের গুণাবলি।

এজন্য সান্ধুর স্বভাবজাত ইনসুইং কাজে লাগাতে তাকে স্পিন বোলিং ছেড়ে মিডিয়াম পেস শুরু করার পরামর্শ দেন। টানা বোলিং করার সুখ্যাতি ছিল সান্ধুর, এটাও তিনি আয়ত্ত্ব করেছিলেন আচরেকার স্যারের অধীনে ট্রেনিং করেই। টানা ২০-২৫ ওভার তিনি বল করে যেতে পারতেন ক্লান্তিহীনভাবে।

কিন্তু কিছুতেই মুম্বাইয়ের রঞ্জি ট্রফির দলে সুযোগ পাচ্ছিলেন না সান্ধু। ১৯৮০-৮১ মৌসুমে কারসান গারভি জাতীয় দলের হয়ে ইংল্যান্ড সফরে গেলে দলে ডাক পান সান্ধু। কিন্তু প্রথম দুই ম্যাচে মাঠে নামার সুযোগ হয়নি তার। অবশেষে গুজরাটের বিপক্ষে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে তাঁর।

প্রথম সুযোগটা তিনি কাজ লাগান দারুণভাবেই, নয় উইকেট নিয়ে অভিষেক ম্যাচকে রাঙিয়ে তোলেন আপন রঙে। এরপর আর দল থেকে বাদ পড়তে হয়নি। সেবারের রঞ্জির ফাইনালেও অসাধারণ বল করে। দিল্লীর বিপক্ষে সেই ফাইনালে প্রথম সেশনেই টপ অর্ডারের পাঁচ উইকেট নিয়ে দিল্লীকে পুরো গুঁড়িয়ে দেন।

মুহূর্তেই বদলে গেল ভারত

ম্যাচ শেষ করেন নয় উইকেট নিয়ে। নিজের অভিষেক মৌসুমে ১৮.৭২ গড়ে ২৫ উইকেট নেন সান্ধু। পরের মৌসুমে দুলীপ ট্রফিতে ওয়েস্ট জোনের হয়ে সাউথ জোনের বিপক্ষে আট উইকেট এবং এগারো নম্বরে ব্যাট করতে নেমে ৫৬ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলেন।

পাকিস্থানের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে মদনলাল ইনজুরির কারণে ছিটকে গেলে হায়দ্রাবাদে চতুর্থ টেস্টে অভিষেক ঘটে সান্ধুর। নিজের অভিষেক টেস্টেই টানা দুই বলে তুলে নেন মহসিন খান এবং হারুন রশিদের উইকেট। যদিও সে ম্যাচে বলের চাইতে ব্যাট হাতে বেশি সফল ছিলেন তিনি। আসলে ব্যাটও তিনি চালাতে পারতেন ভালোই। কিন্তু সব সময় ভালো বোলিংয়ের আড়ালে পড়ে গেছে। অভিষেক টেস্টেই নয় নম্বরে নেমে খেলেন ৭১ রানের সময়োপযোগী এক ইনিংস।

ব্রিজটাউনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ভারতীয় ব্যাটিং অর্ডারে ধস নামলে ৫৬ রানের এক ইনিংস খেলে দলকে বিপদ থেকে রক্ষা করেন সান্ধু। ১৯৮৩ বিশ্বকাপে ভারতের শিরোপা জয়ের পেছনেও বড় ভূমিকা ছিল তার। প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই ভারতের শুরুর উইকেট এনে দিতেন তিনিই। ফাইনালের লো স্কোরিং ম্যাচেও শেষ উইকেটে সৈয়দ কিরমানির সাথে মিলে যোগ করেন মহামূল্যবান ২২ রান।

বাস্তব বনাম পর্দার বলবিন্দর

কিন্তু, কখনোই তিনি প্রচারের আলোয় আসতে পারেননি। সবার অলক্ষ্যে থেকেই যেন নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে গিয়েছেন। ভালো খেলার পরও তার ক্যারিয়ারটা থমকে গেছে আট টেস্ট এবং ২২ ওডিয়াই খেলেই। টেস্টে দশ উইকেট নেবার পাশাপাশি দুই অর্ধ-শতকে ব্যাট হাতে করেছেন ২১৪ রান। অন্যদিকে, ২২টি একদিনের ম্যাচে নিয়েছেন ১৬ উইকেট।

খেলা ছাড়ার পর ক্রিকেট কোচিংয়ের সাথে জড়িয়ে পড়েন সান্ধু। রঞ্জিতে মুম্বাই এবং পাঞ্জাবের হেড কোচ ছিলেন তিনি। ১৯৯০ সালে কেনিয়াতে ক্লাব ক্রিকেট খেলার পাশাপাশি সেখানকার ক্লাবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন কোচ হিসেবে। এছাড়া বিতর্কিত ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগে (আইসিএল) বাংলাদেশ থেকে যাওয়া দল ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্স দলের কোচের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। তবে, এত কিছুর মাঝেও ৮৩’র সেই মোড় ঘুড়ানো ডেলিভারিটাই ভারতের ক্রিকেটে অমর করে রেখেছে বলবিন্দরকে!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...