ক্যাপ্টেন ক্যালিপসো

ক্যারিবিয়ান ছোট্ট এক দ্বীপ অ্যান্টিগা থেকে উঠে এসে ব্যাট হাতে ক্রিকেট বিশ্ব শাসন করেছিলেন স্যার ভিভ রিচার্ডস। অ্যান্টিগার কথা আসলে সবার আগে আসবে ভিভের কথা। মাথায় মেরুন রঙের গোল টুপি পড়েই দাঁড়িয়ে পড়তেন বোলারের সামনে। স্পিন কিংবা পেস কখনোই তোয়াক্কা করতেন না বোলারের। কারণ তিনি ভাবতেন হেলমেট পড়া মানেই বোলারকে ভয় পাওয়া! অ্যান্টিগা থেকে উঠে এসে দীর্ঘসময় ২২ গজকে নিজের সাম্রাজ্য বানিয়ে শাসন করেছিলেন তিনি।

এই অ্যান্টিগা থেকেই উঠে আসেন আরেক ক্যারিবিয়ান তারকা রিচি রিচার্ডসন। তাঁকে বলা হয় ক্যারিবিয়ানদের স্বর্ণযুগের সবশেষ অধিনায়ক। ভিভের ছায়াতলেই কাটিয়েছেন ক্যারিয়ারের অনেকটা সময়। মাথায় ভিভের মতোই সেই মেরুন গোল টুপি! পেসারদের সামনেও নিতেন না হেলমেট। যাকে ভাবা হতো ভিভের যোগ্য উত্তরসূরী। ডিফেন্সিভ ব্যাটার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করে পরবর্তীতে বনে গেছেন ২২ গজের আগ্রাসী এক তারকা।

১৯৬২ সালের ১২ জানুয়ারি অ্যান্টিগার এক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন রিচি। স্কুল ক্রিকেট থেকেই উঠে আসেন ঘরোয়া ক্রিকেটে। আশির দশকে তখন ক্রিকেট দুনিয়া শাসন করছিলো ক্যারিবিয়ানরা। প্রতিপক্ষের জন্য যমদূতের মতোই ছিলো ভিভ রিচার্ডস, গর্ডন গ্রিনিজ, কলিন ক্রফট, অ্যান্ডি রবার্টস, ম্যালকম মার্শালদের নিয়ে গড়া ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল। সেই সময়ে ভিভের পর অন্যতম সেরা ব্যাটার হিসেবে ভাবা হতো রিচি রিচার্ডসনকে। অবশ্য পরবর্তীতে নিজের সময়ের সেরা ব্যাটার হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন রিচি।

গাই ইয়ারউড নামের এক কোচ তাঁর ক্রিকেটীয় প্রতিভা দেখে তাঁকে নিয়ে কাজ শুরু করেন। ডিফেন্সিভ থেকে গড়ে তুলেন আগ্রাসী ব্যাটার হিসেবে। ১৯৮২ সালে লিউয়ার্ড আইল্যান্ডের ওপেনার হিসেবেই ক্যারিয়ার শুরু করেন তিনি। ঘরোয়া ক্রিকেটে শুরু থেকেই বেশ নজরকাঁড়া পারফরম্যান্স দেখান রিচি। বেশ লম্বা সময় ধরেই ছিলেন নির্বাচকদের নজরে। ১৯৮৩ সালে ঘরোয়া ক্রিকেটে দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরির পর গর্ডন গ্রিনিজ ও দেশমন্ড হেইনেসের ব্যাকআপ হিসেবে জাতীয় দলে ডাক পান তিনি। ওই বছরের ২৪ নভেম্বর ভারতের বিপক্ষে মুম্বাইয়ে অভিষিক্ত হন রিচি। তবে অভিষেকেই শূন্য রানে আউট হয়ে হতাশ করেন নির্বাচকদের!

ওই সফরেই অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই হারিয়ে যায় রিচির ব্যাগপত্র! আর তাই অল্প কিছু কাপড় নিয়ে পুরো সফর অতিবাহিত করেন তিনি। তৃতীয় ওপেনার হিসেবে ছিলেন স্কোয়াডে। অনুশীলনেও পাচ্ছিলেন না সুযোগ। ক্লাইভ লয়েড, গ্রিনিজ, হেইনেসদের ভীড়ে অনুশীলনে উপেক্ষিতই ছিলেন রিচি। ব্যাটারদের পর বোলারদের ব্যাটিং অনুশীলনের পর সুযোগ মিলতো তাঁর। ব্যাপারগুলো নজর এড়ায়নি রবার্টসের। তরুন এই প্রতিভা যাতে শুরুতেই কোনো আঘাত না পান তাই রবার্টস নিজেই রিচিকে নেটে বোলিং করে অনুশীলন করতে সাহায্য করেন।

ওই সফরেই ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডেতেও অভিষিক্ত হন রিচি। আর অভিষেকেই করেন ৪৬ রান। রঙিন জার্সিতে অবশ্য অভিষেকটা উজ্জ্বল করতে পেরেছিলেন এই ব্যাটার। পরের বছর পাকিস্তানের বিপক্ষে দেখা পান মেইডেন ওয়ানডে ফিফটি। পরের অস্ট্রেলিয়া সিরিজে করেন তিন ফিফটি! টেস্টেও ছিলেন দুর্দান্ত! অজিদের বিপক্ষে টানা দুই টেস্টে দুই সেঞ্চুরি করেন তিনি! ওই বছরের শেষে অজিদের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের তৃতীয় সেঞ্চুরি তুলে নেন রিচি।

ততদিনে রিচি যেন নিজের জাত চিনিয়ে ফেলেছেন। বনে গিয়েছিলেন দলের নিয়মিত এক মুখ। ১৯৯৫ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে দুই ওয়ানডেতে ৯৯ ও ৯২ রানে অপরাজিত ছিলেন রিচি! দু’বার সেঞ্চুরির কাছে গিয়েও পাননি ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি। ওয়ানডেতে টানা সুযোগ পেলেও টেস্টে ছিলেন অনেকটাই অনিয়মিত। তবে দলে জায়গা পেলেই নিজের সেরাটা দিতেন তিনি। তবে দুর্দান্ত পারফরম করলেও ভিভের আধিপত্যের ছায়াতলেই থাকতেন এই তারকা।

১৯৮৬ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে শারজাহতে ক্যারিয়ারের মেইডেন ওয়ানডে সেঞ্চুরি করেন রিচি। পরের বছর পাকিস্তানের বিপক্ষে করাচিতে দেখা পান ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ওয়ানডে সেঞ্চুরি। রিচি তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের অন্যতম ভরসা। সময়ের সেরা ক্যারিবিয়ান তারকাও ছিলেন তিনি!

১৯৮৯ সালে ভারতের বিপক্ষে ঘরের মাটিতে ব্যাটারদের জন্য খুব বাজে পিচ হওয়া সত্ত্বেও ভাঙা আঙ্গুল নিয়ে ৯৯ রানের অসাধারণ এক ইনিংস খেলেন! ওই সিরিজের প্রথম টেস্টেই করেছিলেন ১৯৪ রান। সবশেষ টেস্টেও দলকে ১৫৬ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস উপহার দেন তিনি। ওই সিরিজে ৪ টেস্টে ২ সেঞ্চুরি ও ৩ ফিফটি করেন রিচি। ইনিংসগুলো ছিলো ১৯৪, ৯৩, ৫৯, ৯৯ ও ১৫৬! ওই বছর ৬ টেস্টে ৭২ গড়ে ৭৯৭ রান করেন তিনি। যা ছিলো রিচির টেস্ট ক্যারিয়ারের সেরা মৌসুম। ওয়ানডেতে ২৩ ম্যাচে ৮ ফিফটিতে ৪৩ গড়ে করেন ৮১৩ রান।

ঠিক তার পরের বছর ১৯৯০ সালটা ছিলো বিপরীত চিত্র! ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে সময় পার করেন তিনি। ৭ টেস্টে মাত্র ১ ফিফটিতে ২৯ গড়ে করেন ৩৫৭ রান! তবে ওয়ানডে ছিলেন নিজের চেনা ফর্মেই। এক সেঞ্চুরি আর তিন ফিফটিতে ৪৯ গড়ে রান করেন রিচি। পরের বছর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পর পর দুই টেস্টে দুই সেঞ্চুরির দেখা পান তিনি। এরপর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজেও ছিলেন উড়ন্ত ফর্মে ৫ টেস্টে ২ সেঞ্চুরি আর ৩ ফিফটি করেন রিচি। এই পারফরম্যান্সের পর ভিভ রিভার্ডসের স্থলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়কত্ব পান রিচি! ভিভ রিচার্ডসের টেস্ট ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে রিচি খেলেছিলেন ১০৪ রানের ইনিংস।

ভিভ তখন ক্যারিয়ারের একদম অন্তিম মূহুর্তে। ৯২ এর বিশ্বকাপ খেলেই বিদায় নিবেন সেটিও জানিয়ে দিয়েছিলেন বোর্ডকে। ভিভের অধীনে কোনো সিরিজই হারেনি ক্যারিবিয়ানরা। অধিনায়ক হিসেবে ভিভ ছিলেন আগ্রাসী ভূমিকার। অপরদিকে, রিচি ছিলেন বেশ শান্ত স্বভাবের। রিচির অধীনেই খেলেছিলেন কিংবদন্তি তারকা ব্রায়ান লারা, কার্টলি অ্যাম্ব্রোস, কোর্টনি ওয়ালশরা। রিচির অধীনে ওয়েস্ট ইন্ডিজ মাত্র এক সিরিজে পরাজিত হয়! ১৯৯৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওই সিরিজ হার ১৯৮০ এর পর ক্যারিবিয়ানদের জন্য ছিলো প্রথম সিরিজ হার!

ভিভের ক্যারিয়ার শেষ হওয়ার পর স্বভাবতই রিচিকে নতুনভাবে জানার কথা ক্রিকেট বিশ্বের। ভিভের ছায়াতলে যে তিনি আর নেই। নিজেকে যেনো আরেকবার ক্রিকেট দুনিয়ায় মেলে ধরবার সুযোগ রিচির সামনে। তবে না! ভিভের সাথে সাথে রিচির ক্যারিয়ারও যেনো কোথায় আটকে গেছে। অবাক করা ব্যাপার হলো, ভিভের অবসরের পর ব্যাট হাতে ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে সময় পার করেন রিচি।

১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত ২৪ টেস্টে মাত্র ২ সেঞ্চুরি আর ৭ ফিফটি করেন রিচি! এর মধ্যে ৯৩ সালে ১ সেঞ্চুরি আর ৪ ফিফটিতে ৪৪ গড়ে ৪৩৯ রান ছাড়া বাকি পরিসংখ্যান একেবারেই সাদামাটা। ওয়ানডেতেও বেশ খারাপ সময় পার করছিলেন তিনি। ১৯৯৩ থেকে ৯৬ পর্যন্ত ৫৫ ওয়ানডেতে মাত্র ৫টি ফিফটি করেন রিচি! অবশ্য ক্যারিয়ারের শেষটা রঙিন পোশাকে ছিলেন বেশ উজ্জ্বল। ৯৬ এর বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অপরাজিত ৯৬ রানের ইনিংসের পর শেষ ম্যাচে ৪৯ রানের একটি ইনিংস খেলেন তিনি।

১৯৯৫ সালে টেস্ট ক্যারিয়ারের শেষ মৌসুমে রিচি অবশ্য অদ্ভুত এক কীর্তি গড়েছিলেন। অ্যান্টিগায় অজিদের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে ক্যারিয়ারে প্রথমবার হেলমেট পড়ে ব্যাট করতে নামেন রিচি। বাকিরা হেলমেট ব্যবহার করলেও এর আগে রিচি কখনোই হেলমেট পড়েননি। এর জন্য একবার দূর্ঘটনার মুখেও পড়েন তিনি। ১৯৮৫ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে ম্যাচে পেসার অশান্তা ডি মেলের বল সরাসরি মুখে আঘাত হানে রিচির। রক্তাক্ত মুখ নিয়ে মাঠ ছাড়লেও পরের ম্যাচেই আবারো হেলমেট ছাড়াই নেমে পড়েন তিনি।

১৯৯৫ সালে নিজের টেস্ট ক্যারিয়ারের পড়ন্ত সময়ে এসে হেলমেট পড়েন তিনি। অবশ্য অবসরের পর এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, ‘অ্যান্টিগাতে এর আগেও আমি আঘাত পেয়েছিলাম। এছাড়া জ্যামাইকা টেস্টেও গ্লেন ম্যাকগ্রার বল আমার মাথায় লাগে। যার কারণে ঝুঁকি না নিয়ে হেলমেট পড়েছিলাম।’ এর আগের ৭৭ টেস্টেই ভিভের মতো সেই মেরুন গোল টুপি পড়ে খেলেছিলেন তিনি। ক্যারিয়ারের বাকি ৭ টা টেস্ট হেলমেট পড়েই খেলেন তিনি। আর ওই সিরিজেই চতুর্থ ও শেষ টেস্টে জয় নিয়ে সিরিজ জিতে নেয় অজিরা! ১৫ বছর পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে কোনো দল সিরিজ পায়।

রিচি টেস্টে ৮৬ ম্যাচে ৪৪ গড়ে ৫৯৪৯ রান করেন। ২৭ ফিফটির পাশাপাশি আছে ১৬ সেঞ্চুরি। ২২৪ ওয়ানডেতে ৩৩ গড়ে ৬২৪৮ রান করেন রিচি। ৫ সেঞ্চুরির সাথে আছে ৪৪ হাফ সেঞ্চুরি। ঘরোয়া ক্রিকেটে ৫৪৭ ম্যাচে ২৩ হাজারেরও বেশি রান করেছেন এই তারকা। জানুয়ারী ১৯৮৭ থেকে ১লা নভেম্বর, ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল মোট ওয়ানডে খেলেছিলো ১৩২টি। এই সময়ের মধ্যে ১৩২ টি ম্যাচেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের একাদশে ছিলেন রিচি। টানা সবচেয়ে বেশি ওয়ানডে খেলা ক্রিকেটারদের মধ্যে চারে আছেন এই ক্যারিবিয়ান তারকা।

১৯৮৩ সালে অভিষেকের পর ভিভ রিচার্ডস অবসরের আগ অবধি ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ৬২ টেস্ট খেলে ৪৮ গড়ে ৪৬৪৭ রান করেছেন রিচি। ১৪ সেঞ্চুরির সাথে আছে ১৮টি ফিফটি। গড়ের দিক দিয়ে ছিলেন সেই সময়ের সেরা এবং রানের দিক দিয়ে ছিলেন দ্বিতীয়তে। অপরদিকে, এই সময়ে ৬৬ টেস্টে ৪৫ গড়ে ৩৯৮৮ রান করেছিলেন ভিভ। ১০ সেঞ্চুরির সাথে ছিলো ২৫ ফিফটি। রান এবং গড় দুই দিকেই ছিলেন রিচি, গর্ডন গ্রিনিজ, দেশমন্ড হেইনেসদের চেয়ে পিছিয়ে। ভিভ রিচার্ডসের ছায়াতলেই রিচির ক্যারিয়ার ছিলো এমনটা মানতে নারাজ অনেকে। এই পরিসংখ্যানটা অবশ্য সেটি প্রমাণে ব্যর্থ।

ভিভ রিচার্ডসের মাহাত্ম্য কিংবা ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের অন্যতম সেরা নায়ক এসব নিয়ে কারোই সংশয় নেই। তবে রিচির অসাধারণ ক্যারিয়ার যে ভিভের ছায়াতলে ছিলো তাও অস্বীকার করার কারণ নেই। রিচির সময়ে তিনিই ছিলেন ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটে ওই সময়ের সেরা তারকা। রিচির অবসরের সাথে সাথেই যেনো নিভে গেছে ক্যারিবীয় ক্রিকেটের স্বর্ণযুগের সেই আলো!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link