চোখের জলে ভিজিয়ে রাখা বাবার কবর

এই প্রত্যন্ত গ্রামেরই এক বাসিন্দার নাম শাহনেওয়াজ দাহানি। পাকিস্তানের এ ক্রান্তি লগ্নে ২২ কোটি মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টায় যে একটি দল এশিয়া কাপে এসেছে সেই দলেরই সঙ্গী এই পেসার শাহনেওয়াজ দাহানি।

১.

পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের প্রত্যন্ত এক শহর, লারকানা। একটা জেলা, কিন্তু প্রায় সারা বছরই সেখানে বন্যা হয়। নাগরিক জীবনের অতীষ্ঠতায় লারকানা যে একটি শহর সেটিই ভুলে যায় এ অঞ্চলের বাসিন্দারা।

লারকানারই একটি গ্রামের নাম খাওয়ার খান দাহানি। লারকানা শহর তো তাও গুগল ম্যাপে পাওয়া যায় কিন্তু খাওয়ার খান দাহানি গ্রামটি এতই প্রত্যন্ত এলাকা যে এর অবস্থান গুগল ম্যাপেও মেলে না। এই কিছুদিন আগেই এ গ্রামের প্রায় পুরো অংশই বন্যায় প্লাবিত হয়ে যায়। সহস্র মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে, একই সাথে পানি আর খাদ্যের সঙ্কটের সঙ্গে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় মানবিক বিপর্যয়ে আচ্ছন্ন হয়ে যায় খাওয়ার খান দাহানি গ্রাম।

এই প্রত্যন্ত গ্রামেরই এক বাসিন্দার নাম শাহনেওয়াজ দাহানি। পাকিস্তানের এ ক্রান্তি লগ্নে ২২ কোটি মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টায় যে একটি দল এশিয়া কাপে এসেছে সেই দলেরই সঙ্গী এই পেসার শাহনেওয়াজ দাহানি।

শাহনেওয়াজের গ্রাম এখনো বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন। বিচ্ছিন্ন জনপদে এখনো পৌঁছায়নি ত্রাণ সামগ্রী। কিন্তু সেসবকে এক পাশে রেখে এশিয়া কাপের প্রথম ম্যাচে কী চেষ্টাটাই না করেছেন এ পেসার। বল হাতে চার ওভারে ২৯ রান দিয়ে কোনো উইকেট না পেলেও ব্যাট হাতে তাঁর ছয় বলে ১৬ রানের ক্যামিও একপেশে হতে যাওয়া এক ম্যাচকে দিয়েছিল লড়াইয়ের ইঙ্গিত।

শুধু ক্রিকেট খেলেই তাঁর গ্রামের মানুষকে এক চিলতে হাসি ফিরিয়ে আনার লড়াইয়ে ক্ষান্ত থাকেননি শাহনেওয়াজ। দেশ ছাড়ার আগে সরকারি-বেসরকারি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের কাছে সাহায্য চেয়ে টুইট করেছিলেন তিনি। একই সাথে সম্মিলিত প্রয়াসে এমন দূর্যোগ মোকাবেলা করার আহ্বান জানান তিনি।

২.

খাওয়ার খান দাহানি গ্রাম থেকে ততদিনে কখনোই কোনো ক্রিকেটার পাকিস্তানের হয়ে খেলতে পারেনি। শুধু এই গ্রাম নয়, সমগ্র লারকানা থেকেই কোনো ক্রিকেটারের জায়গা হয়নি পাকিস্তান দলে। বন্যাকবলিত এলাকা থেকে প্রফেশনাল ক্রিকেটে প্রবেশের পথটা তাই এ এলাকা থেকে একটু কঠিনই।

এমন অবস্থায় শাহনেওয়াজ দাহানি তাঁর বাবাকে বলল, ‘বাবা, আমি পাকিস্তানের হয়ে ক্রিকেট খেলতে চাই।’ শাহনেওয়াজের বাবা শান্ত, ধীর প্রকৃতির। ঠান্ডা মাথায় তিনি তাঁর পুত্রকে বললেন, ‘এমন জায়গা থেকে কেউ কখনোই ক্রিকেটার নিবে না। তুমি পড়াশোনায় মনযোগ দাও। ভাল পড়াশোনা করলে তুমি লারকানায় ভাল সরকারি চাকরি করতে পারবে।’

ক্রিকেটকে ততক্ষণে পেয়ে বসা এক শিশুর মন কি সেই কথায় ক্ষান্ত হয়? শাহনেওয়াজের বাবার সরিষা ক্ষেত ছিল। তাই প্রতিদিন খুব ভোরে উঠে তাকে ক্ষেতে যেতে হতো। শাহনেওয়াজ সেই ফাঁকেই কলেজ মাঠে খেলতে বেরিয়ে যেতো। নিয়মিত বল করত, সাথে ব্যাটিংটাই ঝালাই করে নিত। এভাবে কেটে যাচ্ছিল দিন। কিন্তু শুধু কলেজ মাঠে খেলে তো আর পাকিস্তানের হয়ে খেলার স্বপ্ন পূরণ হবে না। পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় শাহনেওয়াজের স্বপ্ন নিভে যাওয়ার উপক্রম হলো তখন।

কিন্তু তাঁর বড় ভাই মজিদ বিষয়টা নিয়ে ভাবলেন। ছোট ভাইয়ের ক্রিকেটের প্রতি প্রবল আগ্রহ তাকে মুগ্ধ করলো। এরপর একদিন শাহনেওয়াজ দাহানিকে নিয়ে গেলেন তাঁর এক বন্ধুর কাছে। মজিদের বন্ধু তখন শাহবাজ ক্রিকেট ক্লাবের ক্রিকেটার। শাহনেওয়াজ দাহানি তখন পর্যন্ত ক্রিকেটের হার্ডবল হাতেও নেয়নি। তাই প্রথমবার লেদার বল হাতে নিয়ে সে একটু নার্ভাসই হয়ে পড়ল। তবে তাঁর বোলিংয়ের ধরন তাকে ঠিকই সে ক্লাবে অনুশীলনের সুযোগ করে দেয়।

ক্লাবে অনুশীলনের তো সুযোগ পাওয়া গেল। কিন্তু জুতা, মোজা কোথায় পাওয়া যাবে? একে তো বাবা কিছু জানেন না, সবকিছুই তার চোখ এড়িয়ে হচ্ছে তার উপর তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভাল না। কী আর করার, শাহনেওয়াজ দাহানিকে দ্বারস্থ হতে হলো তাঁর বন্ধুদের কাছে। বন্ধুদের জুতা, মোজা নিয়ে অনুশীলন চালিয়ে গেলেন। মজার ব্যাপার হলো, বন্ধুর জুতা এতই দামী ছিল যে ক্লাবের অনেকেই ভাবতে শুরু করলো, শাহনেওয়াজ দাহানি বোধহয় অনেক ধনী পরিবারের সন্তান। এদিকে বাবাকে নিয়মিত ক্লাস, কোচিংয়ের কথা বলে মাঠে আসেন দাহানি।

৩.

শাহনেওয়াজ দাহানি ছিলেন প্রকৃতি প্রদত্ত এক মেধা। তাই ক্রিকেট বল স্পর্শ করার মাত্র দুই বছরের মধ্যেই তিনি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলার সুযোগ পেয়ে যান। তার ঠিক দু’বছর বাদেই তিনি সুযোগ পান পাকিস্তান দলে৷ লাইনটাকে আরেকটু বড় করে বলা যেতে পারে, লারকানার প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে শাহনেওয়াজ দাহানি পাকিস্তান দলে সুযোগ পান। যেটি তাঁর আশৈশব জুড়ে ছিল পরম এক স্বপ্ন।

তার চেয়েও বড় কথা বাবাকে তিনি দেখিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তার পুত্র এই শহর থেকে প্রথম জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া ক্রিকেটার। কিন্তু ততদিনে দাহানির বাবা আর এ পৃথিবীতে নেই। বাবাকে স্বপ্ন পূরণের সে দিনটা দেখাতে না পারায় লাহোরে থেকে লারকানার বাসের মধ্যেই অঝোরে কেঁদে ফেলেন দাহানি। কান্নার সীমা তত টুকুতেও থামেনি সেদিন। লারকানায় পৌঁছে বাবার কবরে গিয়ে আবারো সেদিন কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন শাহনেওয়াজ দাহানি। একদিকে স্বপ্নপূরণের আনন্দ অশ্রু অন্যদিকে বাবাকে এ দিনটা দেখাতে না পারার আক্ষেপের জল। দুই অশ্রু মিলে যেন আনন্দ বেদনার মিলন ঘটেছিল সেদিন।

৪.

বলিউডের গান বাজছে, বাড়িতে বাড়িতে ফুলে সজ্জিত, নাচে গানে একাকার- পাকিস্তান দলে সুযোগ পাওয়ার খবরে দাহানির গ্রাম যেন মেতে উঠেছিল ভিন্ন এক উৎসবে। উৎসব হবেই না বা কেন? গ্রামের প্রথম কোনো ছেলে পাকিস্তান দলে সুযোগ পেয়েছে। যা এর আগে কখনোই হয়নি। তাই গ্রামের ছেলের আগমনে একটু বাড়তি উৎসব তো হবেই। শাহনেওয়াজ দাহানি ছাদখোলা গাড়ি থেকে সেসব দৃশ্য দেখলেন। ফুল আর করতালির সমুদ্রে ভেসে গেলেন।

পাকিস্তানের ক্রিকেটে নিজের গ্রামের নাম লিখিয়ে অজস্র মানুষের ভালবাসায় সিক্ত হওয়া শাহনেওয়াজ দাহানিও সেদিন আনন্দে ভাসলেন। কোনো একদিন গ্রামের সহস্র মানুষের আনন্দ, উৎসবের উপলক্ষ হবেন। এমন দিনটাই তো তিনি চেয়েছিলেন।

৫.

শাহনেওয়াজ দাহানির ব্যাপারে পাকিস্তানের রথী মহারথীরা কী মনে করেন? মুলতান সুলতানের কোচ আজহার মাহমুদ তো মনে করেন, বহুদিন পরে পাকিস্তান ন্যাচারাল এক পেসার পেয়েছে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি আরো বলেন, ‘শক্তপোক্ত দেহের সাথে দুর্দান্ত গতি আর এগ্রেশন, একজন পেসারের যতগুলো আদর্শ গুণ থাকা দরকার তার প্রায় সব ক’টাই আছে দাহানির মাঝে। এটা অনেকটা নতুন করে শোয়েব আখতারকে পাওয়া মতো’।

শোয়েব আখতার নিজেও শাহনেওয়াজ দাহানিকে নিয়ে দারুণ আশাবাদী। শুধু নাকি সুইং ডেলিভারি নিয়ে কাজ করলেই দাহানি পরিপূর্ণ পেসার হতে পারবে । প্রতিপক্ষের জন্য সে আরো ভয়ংকর হয়ে উঠবে। এজন্য দাহানিকে আরো প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলার প্রতি নজর দিতে বলেছেন শোয়েব আখতার।

পাকিস্তানের আরেক বোলিং কিংবদন্তি ওয়াকার ইউনুস মনে করেন, শাহনেওয়াজ দাহানি শাহিনশাহ আফ্রিদি মানেরই পেসার উঠবেন। শুধু তাকে তাঁর ক্যারিয়ার সম্পর্কে যত্নবান হতে হবে। শৃঙ্খল থাকতে হবে।

৬.

নেট প্র্যাকটিসে আসিফ আলী ব্যাট করছেন। বোলিংয়ে শাহনেওয়াজ দাহানি। দাহানির করা একটি বল আসিফ বুঝতেই পারলেন না৷ সজোরে সোজা ভিতরে ঢুকে গিয়ে গিয়ে একদম বোল্ড। এরপরই দাহানি দুই হাত এরোপ্লেনের মতো করে উদযাপনে মেতে ওঠেন। প্র্যাকটিস সেশনে হঠাৎ উদযাপন? এমন উদযাপন করানো পিছনের লোক আবার স্বয়ং কোচ আজহার মাহমুদ। মাঠের পারফর্মেন্স আর নেটে পারফরম্যান্সে কোনো ফারাক না রাখতেই তিনি দাহানিকে এমন পরামর্শ দিতেন।

৭.

‘আপ হ্যায় ধোনি, ম্যা হু দাহানি’

২০২১ টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ধোনি তখন ভারতের মেন্টর। দাহানিরও ইচ্ছা রয়েছে এতদিন যাকে টেলিভিশনের পর্দায় দেখে এসেছে সেই ধোনির সাথে একটি মুহূর্ত পার করা। ভারতের তখন ট্রেনিং সেশন চলছে।

এমন অবস্থায়, হঠাৎই ভাঙা ভাঙা হিন্দি-উর্দু মিলিয়ে ‘আপ হ্যায় ধোনি, ম্যা হু দাহানি বলে’ পরিচয় দিয়ে দাহানির প্রবেশ। ধোনি কী মনে করে যেন বেশ পুলকিত বোধ করলেন৷ এক পাশে নিয়ে কথা বললেন দাহানির সাথে। দাহানিও যেন এক মুহূর্তের স্বপ্ন হাতে পেলেন। সেই মুহূর্তকে ফ্রেমবন্দী করে টুইট করলেন, ‘হোয়াট আ নাইট ইট ওয়াজ’।

৮.

কোনে সন্দেহ নেই, শাহনেওয়াজ দাহানি দারুণ সম্ভাবনাময় পেসার। তবে রাতারাতি তিনি সর্বপ্রথম সবার নজর কেড়েছিলেন তার সেলিব্রেশনের মাধ্যমে। বহু ক্রিকেটারের আইকনিক সেলিব্রেশন এখন পর্যন্ত ক্রিকেট জুড়ে গেঁথে আছে। উইকেট পাওয়ার পর শোয়েব আখতারের এরোপ্লেন স্প্রিন্ট, শহীদ আফ্রিদির স্ট্যাচু পোজ, ইমরান তাহিরের ম্যারাথন স্প্রিন্ট এখনো ক্রিকেট সমর্থকদের কাছে বহুল পরিচিত সেলিব্রেশন।

এর মাঝে নতুন এক সেলিব্রেশন দিয়ে জনপ্রিয়তা পান শাহনেওয়াজ দাহানি। পিএসএলে করা সেই জনপ্রিয় সেলিব্রেশনের নাম, ‘সেলফিব্রেশন’। অর্থাৎ সেলফির মতো ভঙ্গি করে উদযাপন। দাহানির কাছে জীবনের অর্থই উদযাপন করা, আর তাঁর সে জীবনের নামটাই তো বোলিং।

পাকিস্তান ক্রিকেটে শাহনেওয়াজ দাহানি এখন পর্যন্ত একটা সম্ভাবনার নাম। সবে মাত্র দলে ঢুকেছেন। অঙ্কুর থেকে বীজ হতে এখনো কিছু সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু যে ছেলেটি প্রত্যন্ত এক অঞ্চল থেকে ন্যাশনাল টিমে খুব সহজে সুযোগ মিলবে না জেনেও লড়াই চালিয়ে যায় তাঁর বিজয় তো আসবেই। আপাতত সে সময়টুকু পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাক।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...