নিজেকে ‘জাহির’ না করে

যারা আমার চেয়েও অনেকটাই প্রবীণ তথা প্রাচীন, কোন ক্রিকেটাড্ডায় এই নামটা উচ্চারণ করলেই তারা আব্বাস পদবীধারী এক পাকিস্তানী শিল্পী ব্যাটার-ক্রিকেটারকে দেখতে পান চোখের সামনে, যিনি তার ব্যাটের স্ট্রোকের আলোয় অন্ধকার করে দিতেন বোলারদের মাঠ জীবন।

আর যারা আমার চেয়ে অনেকটাই নবীন তথা আধুনিক, কোন ক্রিকেটাড্ডায় এই নামটা উচ্চারিত হলেই তারা খান পদবীর এক ভারতীয় বোলার-ক্রিকেটারকে দেখে ফেলেন চোখের সামনে, যিনি তার স্যুইংয়ের ঠেলায় দুর্বিষহ করে দিতেন ব্যাটারদের ব্যাটিং জীবন। আর এই দুইয়ের মধ্যে পেন্ডুলামের মত ঝুলে থাকে আমার সমসাময়িক প্রজন্ম, যারা ওই দুজনের ক্রিকেটই অনেকটাই দেখে ফেলেছেন আর মোহিত হয়ে আছেন দুজনের খেলাতেই।

মহারাষ্ট্রের আহমেদনগর জেলার শ্রীরামপুর শহরে ৭ অক্টোবর, ১৯৭৮ তারিখে জন্মেছিলেন এই লেখার নায়ক জহির খান। ছোটবেলাতেই মুম্বাইয়ের একটি ছোট্ট হাসপাতাল কোয়ার্টারে ‘শিফ্ট’ করে যান তিনি, যে হাসপাতালে কাজ করতেন তার বাবার এক আন্টি।

এই জহির খান নামের ক্রিকেটার ক্রিকেটার পরে ভারতের পেস বোলিংয়ের জয়পতাকা বহন করেছিলেন ১৪ বছর ধরে।সেই ছোট্ট হাসপাতালের কোয়ার্টারটাই ভারতীয় পেসবোলিংয়ের এক লড়াকু সফল যোদ্ধার আঁতুড়ঘর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে ইতিহাসে। আমরা সফলতাটা চোখের সামনে দেখতে পাই, কিন্তু পর্দার পিছনে থেকে যায় সাফল্যের পিছনের একমুখী, নিরলস অধ্যবসায়।

১৯৯৬ নাগাদ, প্রবীণ কোচ সুধীর নায়েক ছিলেন ১৮ বছর বয়সী তার প্রথম গুরু। একটি কাপড়ের মিলে তাকে পাঁচ হাজার টাকা মাসমাইনের একটি চাকরি জুটিয়ে দেন কোচ সুধীর নায়েক, যিনি তার মধ্যে দেখেছিলেন গতিময় পেস বোলিংয়ের অনন্ত সম্ভাবনা। অধিকাংশ দিন প্রাতরাশ হত না তার, যা হেরে যেত তার ইচ্ছেশক্তির কাছে।

তিন বছর ন্যাশনাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে (এনসিএ) নিবিড় ঘষামাজা এবং পরে চেন্নাইতে টি এ শেখরের এম আর এফ পেস একাডেমিতে (যার প্রতিষ্ঠার সময়ে যুক্ত ছিলেন ডেনিস লিলি) প্রশিক্ষণ নেওয়া তাকে নিয়ে ফেলে রঞ্জি ট্রফির ঘেরাটোপে। ১৯৯৮তে এম আর এফ পেস অ্যাকাডেমিতে তাকে পাঠানোর পিছনেও ছিলেন সুধীর নায়েক। পেস, স্যুইং, ইয়র্কার আর রিভার্স স্যুইংয়ের এই নায়ককে পাওয়ার জন্য ভারতীয় ক্রিকেট সুধীর নায়েকের কাছে ঋণী থাকবে।

১৯৯৯-২০০০ মরশুমে বরোদার হয়ে তার রঞ্জী অভিষেক হয়।২০০৫-০৬ অবধি তাদের হয়েই রঞ্জী-তে খেলেন তিনি।২০০০-০১য়ের রঞ্জী ফাইনালে রেলওয়েজ-কে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় বরোদা এবং ম্যাচপুরুষ হন তিনি, ২য় ইনিংসে ৫ উইকেটসহ ম্যাচে ৮/১৪৫ বোলিং ফিগারের জন্য। মোট পাঁচবার রঞ্জী ট্রফি জয়ী দলের সদস্য ছিলেন তিনি

২০০০-০১ মৌসুমে বরোদার হয়ে আর ২০০৬-০৭, ২০০৮-০৯, ২০০৯-১০ আর ২০১২-১৩ মৌসুমে মুম্বাইয়ের হয়ে।কাউন্টি ক্রিকেটেও ২০০৪য়ে সারে’র হয়ে আর ২০০৬-তে উস্টারশায়ার-এর হয়ে খেলেছেন তিনি।১৬৯ প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে তার নেওয়া উইকেট সংখ্যা ছিল ৬৭২। ১০০ আইপিএল ম্যাচে তার উইকেটসংখ্যা ছিল ১০২।

জাভাগাল শ্রীনাথের গোধূলি বেলায় এই ক্রিকেটারের জন্য সৌরভ গাঙ্গুলির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় দলের দরজা খুলে দিয়েছিলেন তৎকালীন নির্বাচকরা। তিন অক্টোবর ২০০০ তরিখে, তার ২২ বছর পূর্ণ হবার আগেই এক তাজা ফুলের আঘ্রাণ পেয়ে যায় ভারতীয় ক্রিকেট। যে সুগন্ধ ভারতের পেস বোলিংকে ছুঁয়ে থেকে স্নিগ্ধ রেখেছিল বহুদিন যাবত।

গ্রেগ চ্যাপেলের কোচিংয়ের সময়ে কিছুদিন চোট আর অবিচারের জন্য বাইরে থাকা বাদ দিলে পরের ১৪ বছরে কার্যত তিনিই টেনেছেন ভারতের পেস আক্রমণকে।ঐ ১৪ বছরে আশিষ নেহরা, অজিত আগরকার, শান্তাকুমারণ শ্রীসন্থ, মুনাফ প্যাটেল, ইরফান পাঠান, রুদ্রপ্রতাপ সিংয়েরা এসেছেন, গেছেন আবার এসেছেন ভারতীয় দলে, কিন্তু উল্টো দিকে তিনি ছিলেন সুদৃঢ় স্তম্ভর মত।

তাঁর পেস, স্যুইং, ইয়র্কার আর রিভার্স স্যুইং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঘাতক হয়ে ওঠে। সে সময় বিশ্বজুড়ে ওড়া ভারতীয় পেস বোলিংয়ের জয়পতাকা অনেকটাই বহন করেছেন জাহির খান। ২০০৩, ২০০৭ আর ২০১১র বিশ্বকাপ খেলা তিনি শেষবার ছিলেন চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য। ২০১১ বিশ্বকাপে তার এক একটা স্পেল কঠিন সময়ে উতরে দিয়েছিল ভারতকে।

২৩ টি বিশ্বকাপ ম্যাচে ৪৪ টি উইকেট আছে তার দখলে। পরিসংখ্যান জানায় যে ৯২ টেস্টে তার ৩১১ উইকেটের পাশাপাশি ১২৩০ রানও ছিল।৭/৮৭ আর ১০/১৪৯ ছিল সেরা টেস্ট বোলিং, ইনিংস আর ম্যাচপ্রতি।তার টেস্টে সর্বোচ্চ ৭৫ রান ছিল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে।২০০ ওডিআই-তে তার ছিল ২৮২ উইকেট আর ৭৯২ রান।৫/৪২ ছিল তার সেরা ওডিআই বোলিং। তার টেস্টে সর্বোচ্চ ৭৫ রান ছিল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। ১৭ টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচে তাঁর নেওয়া উইকেট সংখ্যা ১৭।তার মোট আন্তর্জাতিক উইকেটের সংখ্যা ছিল ৬১০।

বল ডেলিভারির আগে এই বাঁ-হাতি পেসারের দুরন্ত লাফটা আজ খুব মিস করি। ঐ লাফটা তাঁর ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে একটা স্বপ্নসম সময়ের প্রতিনিধিত্ব করত। গড়াপেটা থেকে ভারতীয় ক্রিকেটকে মুক্ত করার সৌরভ-শচীন-রাহুলদের মিশনে যে কয়েকজন তরুণ প্রতিভা তাদের প্রাণপণ অবদান রেখেছিলেন ঐ সময়টাতে, তাদের অন্যতম ছিলেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link