১৯৯৬ সালের এক নভেম্বর। লাহোরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অভিষেক হল এক পাকিস্তানি তরুণের। বয়স মোটে ২০-এর কাছাকাছি। বোলিং শুরু করার পরই কানাঘুষা চললো, পাকিস্তান তাঁদের ‘নেক্সট ইমরান খান’-কে খুঁজে পেয়েছে।
তবে, আব্দুল রাজ্জাক কখনোই ইমরানের মত গতিশীল ছিলেন না। তবে, খুব বেশি ব্যাটসম্যান তাঁর লাইন লেন্থ ধরতে পারতো না। রাজ্জাককে দেখে মারাত্মক কোনো পেসার মনে হত না কোনো কালেই। কিন্তু, তিনি ছিলেন পরিশ্রমী, মেশিনের মত একই রকম বল ঘণ্টার পর ঘণ্টা করে যেতে পারতেন।
প্রয়োজনের সময় পারফরম করতে পারা – আব্দুল রাজ্জাকের ক্যারিয়ারের বড় হাইলাইটস বলা যায় এটাকে। তৃতীয় বা চতুর্থ পেসার হিসেবে তাঁর ওপর ভরসা করতে পারতো পাকিস্তান। ব্যাটিংয়ে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারতেন যেকোনো জায়গায়।
পুরনো বলে রিভার্স স্যুইং করতে পারতেন, সাথে ছিল অ্যাকুরেসি। মিডিয়াম পেস করেও তিনি উপমহাদেশের কন্ডিশনে বিস্তর উইকেট পেয়েছেন। স্বয়ং শচীন টেন্ডুলকার একবার বলেছেন, তাঁর বিপক্ষে বোলিং করা শক্ত বোলারদের একজন হলেন রাজ্জাক।
আর ব্যাটিংয়ে লোয়ার মিডল অর্ডারে নেমে খেলেছেন অসংখ্য ক্যামিও ইনিংস। বলা যায়, আব্দুর রাজ্জাক ছিরেন সত্যিকারের ম্যাচ উইনার। কভারে ও আর মিড অফে তাঁর শটগুলো ছিল চোখধাঁধানো। ফ্রন্ট ফুট বা ব্যাক ফুট – দু’জায়গাতেই ছিরেলন সমান পারদর্শী।
ব্যাটিংয়ে তিনি কতটা সব্যসাচী ছিলেন সেটা বোঝাতে একটি তথ্যই যথেষ্ট। তিনি ওয়ানডেতে ১১ টি পজিশনের মধ্যে ১০ টিতেই ব্যাট করেছেন। খেলেননি কেবল ইনিংসের প্রথম বল। সবচেয়ে বেশি খেলেছেন সাত নম্বরে – ৮৪ ইনিংসে। তবে, সবচেয়ে বেশি গড় পাঁচ নম্বরে – ৪৯.৭৫।
প্রয়োজনে বড় শট যেমন খেলতে পারতেন। তেমনি, বিপদের সময়ে উইকেট ধরে রেখে ধীর স্থীর ব্যাটিংয়েও দেখা মিলেছে তাঁর। তিনি দারুণ একজন ম্যাচ রিডার যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন নিজের সময়ের সেরা ম্যাচ উইনারদের একজন। তবে, আন্ডাররেটেড যে ছিলেন, সেটা নতুন করে বলার কিছু নেই। দলে ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস, শোয়েব আখতার, আজহার মেহমুদরা থাকলে সেটা তো হবেই।
কিন্তু, আব্দুল রাজ্জাক কি আসলে কিংবদন্তি? মানুন আর নাই মানুন, পরিসংখ্যান তাঁর পক্ষেই কথা বলে। ওয়ানডেতে একই ম্যাচে হাফ সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট পাওয়া প্রথম পাকিস্তানি ক্রিকেটার তিনি।
এখানেই শেষ নয়। মাত্র সাত জন পাকিস্তানি ক্রিকেটার টেস্টে এক হাজার রান ও একশ উইকেটের মাইলফলক ছুঁয়েছেন। তাঁদের একজন হলেন রাজ্জাক। এই ফরম্যাটে দ্বিতীয় পাকিস্তানি হিসেবে তাঁর হ্যাটট্রিকও আছে।
এখনও খেলা চালিয়ে গেলে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের বড় ‘এক্স ফ্যক্টর’ হতে পারতেন রাজ্জাক। যতদিন খেলেছেন, ছিলেন ফরম্যাটটির বড় তারকা। ১৪২ ম্যাচে করেছেন আড়াই হাজারের ওপর রান, উইকেট পেয়েছেন ১৩৫ টি। পাকিস্তানের হয়ে জিতেছেন ২০০৯ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা।
ওয়ানডের বিবেচনায় তিনি সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারদের একজন। ৫০ ওভারে ২৫০ উইকেট আর পঁচ হাজার রান করা পাঁচ ক্রিকেটারের একজন তিনি। বাকি চারজন হলেন – শ্রীলঙ্কার সনাথ জয়াসুরিয়া, পাকিস্তানের শহীদ আফ্রিদি, দক্ষিণ আফ্রিকার জ্যাক ক্যালিস ও বাংলাদেশের সাকিব আল হাসান।
তাঁকে ভবগুরে ক্রিকেটারও বলা যায়। কাউন্টি ক্রিকেট, ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগ (আইসিএল), পাকিস্তান সুপার লিগ (পিএসএল), বিগ ব্যাশ, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল), শ্রীলঙ্কা প্রিমিয়ার লিগ (এসএলপিএল) – সব খেলেছেন তিনি। কেবল ইংল্যান্ডেই পাঁচটা ভিন্ন ভিন্ন দলের হয়ে খেলেছেন তিনি।
খুব কার্যকর হওয়ার পরও ২০১৩ সাল অবধি গড়িয়েছে তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। তখন বয়স ছিল ৩৪। দিব্যি আরও দুই-তিন বছর খেলে ফেলতে পারতেন। রাজ্জাকের ব্যাপারে দূরদর্শীতার অভাব দেখিয়েছে পাকিস্তানের নির্বাচকরা। আর রাজ্জাক নিজেও কূটনীতির প্রটোকল মানতে পারেননি। ফলে, ক্যারিয়ারের শুরুতে ইমরানের সাথে তুলনা হলেও বিদায়টা হয়েছে মোটামুটি নীরবেই।
বিরাট কোনো প্রতিভাবান হয়তো ছিলেন না, তবে তিনি অন্যতম উৎকৃষ্টমানের ‘ইউটিলিটি’ ক্রিকেটার ছিলেন। অনেক সময় তাঁকে ‘পাকিস্তানের ল্যান্স ক্লুজনার’ও বলা হত। সেই তুলনায় পাকিস্তান তাঁকে ব্যবহার করতে পেরেছে সামান্যই। ভাগ্যকে তাই দুষতেই পারেন রাজ্জাক!