অ্যাডাম চার্লস ভোজেস – নামটা চেনা চেনা লাগছে কি? লাগবারই কথা কারণ তার সাথে বিখ্যাত, স্বদেশীয় কিংবদন্তি স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যানের নাম জড়িয়ে আছে যে! ক্রিকেটের ডন যখন আন্তর্জাতিক নিজের বুট তুলে রাখবার সিদ্ধান্ত নেন তখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সবচেয়ে পুরানো এবং সর্বোচ্চ ক্ষেত্রে তাঁর গড় অবিশ্বাস্য ৯৯.৯৪ – যেটা আরও বেশী হলে অবাক হওয়ার কথা ছিলনা।
আর মানদণ্ড যুগ যুগ ধরে মানদণ্ড হিসেবেই রয়ে যাবে সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু নিজের বুট জোড়া তুলে রাখবার সময় নিজেকে ডনের পরে দেখা সেটাই তো কম কৃতিত্বের নয়, আর সেটাই করে দেখাতে পেরেছেন অ্যাডাম ভোজেস, সে যতই ৫২ টেস্টের তুলনায় ২০ টেস্ট কিংবা ২০ বছরের আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্যারিয়ারের তুলনায় মাত্র হাতেগোনা দেড় বছরের হোক!
আর এখানেই অ্যাডাম ভোজেসের কৃতিত্ব কারণ তার লড়াই শুধু ওই দেড় বছরের ছিল না, তার লড়াই ছিল দেড় যুগের। আর যার প্রথম বিস্তার ঘটেছিল ৩৬ বছর বয়সে এসে আর যার পরিনতি পেয়েছিল ডনের পর সেরা গড় নিয়ে তথা ৬১.৮৮ প্রতি ইনিংস হিসেবে নিজের টেস্ট ক্যারিয়ার শেষ করে।
ভোজেসের ক্যারিয়ারের সবকিছুই মনে হয় দেরিতে এসেছে। ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অধিনায়ক হয়েও তাঁর প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে ২৩ বছরে গিয়ে, ভাবুন একবার প্রতিযোগিতাটা। যাই হোক আস্তে আস্তে নিজের জাত চেনাতে চেনাতেই জাতীয় দলের দরজা খুলে যায় ২০০৬-৭ মৌসুমের অ্যাশেজ কিংবদন্তি ডেমিয়েন মার্টিনের হঠাৎ অবসরের পর।
তাঁর ভঙ্গিমা, অ্যাপ্রোচ বেশিরভাগ মার্টিনের মতো ছিল বলে হয়তো তাঁকে সবাই তার যোগ্য উত্তরসূরি ভাবাও শুরু করে দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৩ জনের দলে থেকেও তাঁর আগে সুযোগ পান অলরাউন্ডার দক্ষতা থাকার জন্য আরেক কিংবদন্তি অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস। আর বাকি ম্যাচগুলোতে নিজের দক্ষতা দেখিয়ে ভোজেসের ব্যাগি গ্রিন মাথায় তুলবার স্বপ্ন পূরণে কাঁটা বিছিয়ে দেন সাইমন্ডস।
যদিও পরের বছর বিশ্বকাপের আগে পরীক্ষামূলক ম্যাচে তার আন্তর্জাতিক অভিষেক হয় সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ২৮ বছর বয়সে। যদিও অসাধারণ ওই সময়ের অস্ট্রেলিয়া দলে কোনোদিন নিজের জায়গা প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন নি। তবুও যতগুলো সুযোগ পেয়েছেন ২০১৩ সাল পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন নিজেকে প্রমাণ করবার।
যাই হোক দেশের কথা ভুলে ঘরোয়া ক্রিকেটে নিজের সেরাটা দিয়ে যাচ্ছেন তখনই চমকটা হল। হঠাৎ ২০১৫ সালে ৩৬ বছর বয়সে ওয়েস্ট ইন্ডিজে ওই দলের বিরুদ্ধে টেস্ট দলে ডাক পেলেন। তখন তিনি নিজেও হয়তো নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারেননি।
ভাবতেই পারেনি যে ব্যাগি গ্রিনের জন্য এতকিছু করেছেন তাই বয়সে এসে মিলবে। আর এটাই তো একজন সাহসী নাবিকের পরিচয় যিনি কখনই নিজের হাল ছাড়েন না, শক্ত করে ধরে রাখেন। যদিও আগের মৌসুমের ব্যাটে অসাধারণ পারফরম্যান্স দিয়েছিলেন।
এতো বছর তাঁকে কেন ভাবা হয়নি কিংবা কেনো একসময় তাকে মার্টিনের যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন তা নিজের প্রথম ইনিংসেই বুঝিয়ে দিলেন। বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক ক্রিকেটার হিসেবে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ পর্যায়ে অভিষেকেই শতরান করে। ২৪৭ বলে ১৩০ রানের অপরাজিত ইনিংসটি ছিল যেন তার সমস্ত বঞ্চনার জবাব।
এরপর শুধু নিজেকে অন্য পর্যায়ে তুলে নিয়ে যাওয়া। দেড় বছরের ক্যারিয়ারে ৩১ টি ইনিংসে পাঁচটি সেঞ্চুরি ও চারটি হাফ সেঞ্চুরি। এর মধ্যে দু’টিই আবার ডাবল সেঞ্চুরি। এই সময় তিনটি পরপর ইনিংসে আউটই হতে চাইছিলেন না।।একটা সময় দু’টি ডাবল সেঞ্চুরি আর একটি সেঞ্চুরি করবার পর যখন আউট হলেন তখন আরেক মহান ক্রিকেটার শচীন টেন্ডুলকারের রেকর্ড ভেঙে ফেলেছেন দুটি ইনিংসে আউট হওয়ার মাঝে সর্বোচ্চ রান করে।
নিজের বঞ্চনার জবাব, নিজেকে অন্য পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার পর আর বেশি দেরি করেননি সম্মানের সাথে বিদায় নেওয়ার ক্ষেত্রেও। এতো অপেক্ষার পর নিজেকে ভালো জায়গায় রেখে সরে যাওয়া এক কথায় ‘সবুরে মেওয়া ফলে’র মতোই। রেখে গেলেন অসাধারণ সব রেকর্ড।
ব্যাটসম্যান হিসেবে যতটুকু দেখেছি বা তাতে তিনি ছিলেন অত্যন্ত কুশলী। অ্যাগ্রেসিভ ও ডিফেন্সিভ কলার অসাধারণ মেলবন্ধন দেখতাম তার ব্যাটিংয়ে। ধৈর্য আর টেম্পারপেন্টের সাথে প্রায় দেড় দশক ধরে বহু বড় বড় ইনিংস খেলেছেন। পিচের মধ্যে রান তথা দৌড়োতেনও খুব সুন্দর। আর যে কথা বললেই নয় তা তাঁর ফিল্ডিং। বুড়ো বয়সেও মাঠে নিজেকে উজাড় করে দিতেন।
ক্রিকেটে অধ্যাবসায় আর সংগ্রামের গল্পের কথা বললে, সবার উপরের দিকে আজীবনই আসবে অ্যাডাম ভোজেসের নাম। সারাজীবনের জন্য তাকে কুর্ণিশ করবে ক্রিকেট বিশ্ব। ‘বয়স কেবলই একটা সংখ্যা’ – কথাটা বারবার ব্যবহারে ক্লিশে হয়ে গেলেও তাঁর ক্ষেত্রে আবারো ব্যবহার না করার কোনো বিকল্প নেই।