২৮ রানের মাথায় পাঁচ উইকেট নেই। আবার আরেক চিত্রে ৩৪ রানের মাথায় নেই ছয় উইকেট। এই দুই চিত্রের সাথে বাংলাদেশ ক্রিকেট ভক্তরা খুব বেশি পরিচিত। এমন বিপর্যয় তো আর কম দেখেনি এদেশে ক্রিকেট সমর্থকেরা। তবে এখান থেকেও ঘুরে দাঁড়ানোর মত ঘটনা বাংলাদেশে বিরল। আর বিরল সে ঘটনায় দুই দফা একটা নাম ধ্রুব। নামটা আফিফ হোসেন ধ্রুব।
আফগানিস্তানের সাথে ২১৬ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নামা বাংলাদেশ ২৮ রানে হারিয়ে ফেলে পাঁচ উইকেট। সেখান থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের নতুন দিনের ধ্রুবতারা হওয়ার পথে হাটতে থাকা আফিফ পথ দেখালেন জয়ের। মেহেদী হাসান মিরাজকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে ফেলেন হার নামা এক জুটি। আর জয়ের বন্দরে ভেড়ান তরী।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এমনি করেই দলের হাল ধরেছিলেন আফিফ। তবে সেবার জয় নিশ্চিত করতে না পারলেও তিনি দলকে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন একটা সম্মানজনক স্থানে। ৩৪ রানে ছয় উইকেট নেই। এমন পরিস্থিতিতে নেমে দক্ষিণ আফ্রিকান বোলারদের সামলে ৭২ রানের এক ইনিংস খেলেন আফিফ। ঠিক এরপর থেকেই যেন সবাই একটু নির্ভার ভবিষ্যৎ নিয়ে।
ক্রমশ বাংলাদেশের ক্রিকেটের একজন ধ্রুব তারা হওয়ার পথে হাটা আফিফের জন্ম হয়েছিল ১৯৯৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলা খুলনায় জন্ম তার। খুব ছেলে বেলায় তিনি মা’কে হারিয়েছেন। মায়ের সাথে তার স্মৃতি নেই। থাকবেই বা কি করে? তখনও তো কথা বলাই শেখেননি আফিফ। এরপর খালার কাছে বেড়ে ওঠা। ছোট বেলা থেকেই ক্রিকেটটা খুব করে টেনেছে তাকে।
দশ বছর বয়সেই তিনি খুলনা জেলার হয়ে টুর্নামেন্ট খেলে ফেলছিলেন একটি। এরপর সিদ্ধান্ত নিলেন বাংলাদেশ ক্রিড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হবেন। মা মরা ছেলের ইচ্ছেতে আর বাঁধা দিলেন না বাবা। সপ্তম শ্রেণিতেই বিকেএসপির ছাত্র বনে যান তিনি। যে বিকেএসপি থেকে সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিমদের মত তারকাদের পথচলার শুরু সেখানেই নিজেকে নতুন এক দুনিয়ায় আবিষ্কার করেন আফিফ।
প্রতিভা তার মধ্যে ছিল। ছিল ক্রিকেটের প্রতি ভালবাসাও। বিকেএসপি শুধু সে ভালবাসার আর প্রতিভার সংমিশ্রণে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। আর ‘ফাইনাল প্রোডাক্ট’ হিসেবে আমাদেরকে উপহার দিয়েছেন আরও একজন পরিপক্ক ক্রিকেটার। তবে পরিপক্কতা এসেছে সময়ের সাথে। তবে তিনি যে তারকা হতেই ক্রিকেটের মহাদুনিয়ায় পা রেখেছেন তার প্রমাণ আফিফ রেখেছেন নিজের অভিষেক বিপিএল ম্যাচেই।
মাত্র ১৭ বছর বয়সেই তিনি খেলতে নেমেছিলেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ। তার থেকেও আশ্চর্যের জন্ম দিয়েছিলেন তিনি সে ম্যাচেই পাঁচ উইকেট নিয়ে। রাজশাহী কিংসের হয়ে তিনি পাঁচ উইকেট নিয়ে বনে গেছিলেন টি-টোয়েন্টি ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ ‘ফাইফার’ শিকারি। তখনই যেন সবাই আন্দাজ করে নিয়েছিলেন যে তিনি হতে চলেছেন আমাদের আগামী দিনের কাণ্ডারি।
সেই আন্দাজ যেন ক্রমশ সত্যিই হচ্ছে। আফগানিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এই বছরেই খেলা দুই ইনিংস অন্তত সেটাই প্রমাণ করে। দলের বিপদ সামলে নেওয়া আর দলকে একটা ভাল অবস্থানের দিকে নিয়ে যাওয়ার নেতৃত্ব গুণ অবশ্য তিনি বয়স ভিত্তিক দল থেকেই রপ্ত করেছিলেন। তিনি ২০১৬ সালে যুব এশিয়া কাপে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের সহ-অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
তবে তিনি প্রথম আলো কেড়েছিলেন ভারতের সিএবি দলের বিপক্ষে চার ম্যাচ সিরিজের চারটিতেই অর্ধশতক হাকিয়ে। তখন আফিফ ছিলেন অনূর্ধ্ব-১৭ দলের খেলোয়াড়। তখন থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের কর্তাদের নজরে ছিলেন আফিফ। সময়ের সাথে তিনি অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। এসেছেন জাতীয় দলে। হাল ধরছেন। ভরসার প্রতীক হয়ে উঠছেন।
এখন আফিফকে নিয়ে চর্চা হচ্ছে, আলোচনা হচ্ছে। সমালোচনার জায়গায় আফিফ এখনও পৌঁছুতে পারেননি। হয়ত দিন যত যাবে সমর্থকদের প্রত্যাশা বাড়বে। সে প্রত্যাশার চাপ সামলে নিয়ে তিনি হতে পারবেন কি না আমাদের আগামী দিনের মহাতারকা সেটাই শুধু দেখার অপেক্ষা। তবে ভরসা রাখতে নিশ্চয়ই কোন দ্বিধা নেই। আফিফের বয়সটা কেবল ২৩ ছুঁই ছুঁই।