পশ্চিম আফ্রিকার সুদীর্ঘ গ্যাম্বিয়া নদী আর সবুজঘন গিনিয়ান ফরেস্টের মাঝে মানচিত্রের ছোটোছোটো দাগ জন্ম দিয়েছে দেশগুলির। মরক্কো, সেনেগাল,আইভরি-কোস্ট,ঘানা,মালি,নাইজেরিয়া-ফুটবলের খাতিরে অতিপরিচিত কিছু নাম। বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসে আফ্রিকার আবির্ভাব নতুন নয়।
বিশ্ববিখ্যাত ফরাসি ফুটবলার মার্সেল দেশাই তাঁর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ফুটবল গিভস দ্য আফ্রিকান পিপল হোপ, অ্যা ট্রু মোটিভেশন ফর লাইফ।’ একটা ধুঁকতে থাকা অর্থনীতি, বিশ্বের ধনীতম দেশগুলির সাথে গড়ে ওঠা বৈষম্যের লড়াই,প্রবল দারিদ্র্য আর খাদ্য সংকটের সামনে আফ্রিকা বিগত দুই তিন দশক ধরে ফুটবলকে তাদের হাতিয়ার হিসেবে তুলে ধরতে পেরেছে এ কথা বলাই বাহুল্য।
১৯৩৪ সালে মিশর, ১৯৭০ সালে মরক্কো ও ১৯৭৪ সালে কঙ্গো প্রথম তিন আফ্রিকান জাতি হিসেবে বিশ্বকাপের মূলপর্বে অংশগ্রহন করলেও ১৯৮২ সালে ক্যামেরুন ও আলজেরিয়ার যুগ্ম অংশগ্রহন এবং প্রথম অংশগ্রহণেই ক্যামেরুনের সকলকে চমকে দেওয়া পারফরমেন্স প্রথমবার ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার নিরঙ্কুশ আধিপত্যের ভিত টলিয়ে দিল।
১৯৯০ সালে ঘটল সেই ঐতিহাসিক ঘটনা। বিশ্বফুটবলে আফ্রিকা পেল তাদের প্রথম সুপারস্টারকে।ক্যামেরুণের প্রবল দারিদ্র থেকে উঠে আসা ৩৮ বছরের মানুষটি শুধু ফুটবল নয়, পরপর চার গোল করে তাঁর ট্রেডমার্ক সেলিব্রেশনের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিলেন আফ্রিকান ফুটবলের সংগ্রাম আদতে একটা পদানত হয়ে থাকা জাতির উঠে দাঁড়াবার লড়াই,যার বিশ্বস্ত সেনাপতি তিনি, স্বয়ং রজার মিলা।
১৯৯৪ বিশ্বকাপে আফ্রিকান ফুটবলের আরেক দেশ পা রাখল বিশ্বকাপের মূলপর্বে। নাইজিরিয়ার আগমন এবং রাশিদি ইয়েকিনির বুলগেরিয়াকে গোল দেওয়ার পর সেই বিখ্যাত সেলিব্রেশন সদ্য দূরদর্শনের আবির্ভাবের সৌজন্যে রাতারাতি ছড়িয়ে পড়ল বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। ফুটবলের রাজপুত্র ডিয়েগো মারাদোনা, মিশেল প্লাতিনি, নেদারল্যান্ডের রুদ-খুলিতের সাথে স্পটলাইটে আসতে শুরু করল আফ্রিকান ফুটবলারদের নাম।
৯৮-এ দক্ষিণ-আফ্রিকা, ২০০২-এ সেনেগাল, ২০০৬-এ ঘানা-র মতোই একে একে টোগো,আইভরি কোস্ট,আঙ্গোলা-র মতো দেশ নিজেদের যোগ্যতায় আসতে শুরু করল বিশ্বফুটবলের বৃহত্তম মঞ্চে। ৩২ দেশের বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার পর থেকেই ক্রমে আফ্রিকার প্রত্যন্ত দেশগুলির অংশগ্রহনের হার বাড়তে শুরু করে।
২০১০ সালে বিশ্ব দেখল দক্ষিন আফ্রিকার আধিপত্য। ২০০৪ সালেই আফ্রিকান দেশগুলির বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য বিড পারমিশন দেয় ফিফা। মিশর এবং মরক্কোকে পিছনে ফেলে প্রথম আফ্রিকান দেশ হিসেবে ২০১০ বিশ্বকাপ আয়োজনের অনুমতি পায় নেলসন ম্যান্ডেলার দেশ। প্রথম সুযোগেই বাজিমাৎ। আফ্রিকান জাতিগুলির নিরন্তর অস্তিত্ব সংগ্রামকে পাথেয় করে দক্ষিণ-আফ্রিকা দেখিয়ে দিল ফুটবল শুধু জৌলুস নয়, ক্ষমতার আধিপত্য নয় বরং সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বের পিছিয়ে পড়া মানুষদের মূলস্রোতে ফিরে আসার দৃঢ় অবলম্বন।
ঘানার আসামোয়া গিয়ান,ক্যামেরুনের স্যামুয়েল এটো,আইভরি কোস্টের দিদিয়ের দ্রগবা- আরও কত মানুষ,আরও কত ইতিহাস কয়েক দশক ধরে সম্বৃদ্ধ করে আসছে আফ্রিকার ফুটবলকে। অনুন্নত পরিকাঠামো,প্রবল আর্থিক সংকট আর পুষ্টিহীনতার সাথে ক্রমাগত লড়াই করে মাত্র কয়েক লক্ষ জনসংখ্যার দেশগুলো কেবলমাত্র শারীরিক সক্ষমতা আর মানসিক দৃঢ়তাকে অবলম্বন করে উঠে আসছে বিশ্বফুটবলের রঙ্গমঞ্চে।
আফ্রিকার ঘন অন্ধকারে ডুবে থাকা রজার মিলা, দিদিয়ের দ্রগবাদের দেশ থেকে আস্তে আস্তে ঠিকরে বেরোচ্ছে অচেনা রোদ;বাদামগাছ আর কফির ঘন জঙ্গল থেকে প্রথম বিশ্বের ফুটবল মানচিত্রে উঠে আসছে একটা ধুঁকতে থাকা জাতি, কালো হীরের দেশ থেকে ফুটবল বিপ্লবের ডাক দিচ্ছে আদিম সভ্যতা, এখানেই তো ফুটবলের জয়, এখানেই তো ফুটবলের বিউটি, ইউরোপের হাজার হাজার শৌখিন গোলাপের পাশে মাথা উঁচিয়ে থাকা আদিম মহুল, আফ্রিকা!