আফ্রিদি আছেন সর্বত্রই

ক্রিকেট ব্যাট তৈরির জন্য বিখ্যাত পাকিস্তানের শিয়ালকোট শহর। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের নামী-দামী অনেক ব্যাটারদের মতে, উপমহাদেশে এর চেয়ে ভালো ব্যাট তৈরির কারখানা আর নেই। শচীন টেন্ডুলকার তাই একবার ওয়াকার ইউনুসকে তাঁর একটি ব্যাট দিয়ে বললেন ওই ব্যাটের একটি কপি শিয়ালকোট থেকে বানিয়ে দেয়ার জন্য।

ওয়াকার ইউনুসও সেই ব্যাট পাকিস্তানে নিয়ে গেলেন কপি বানানোর জন্য। কপি বানানো হলে ওয়াকারের কাছে ১৫-১৬ বছরের একটা ছেলে সেই মূল ব্যাটটি নেয়ার আবদার করে। ওয়াকার ইউনুসই বা সেই ব্যাট দিয়ে কী করবেন। সদ্য কৈশরে পাঁ দেয়া সেই ছেলেটিকে দিয়ে দিলেন শচীনের সেই ব্যাট। ওয়াকার হয়তো অনুমান করেছিলেন এই ছেলে পরবর্তীকালে ইতিহাস গড়বে, সেই ব্যাট দিয়েই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের নিজের আগমনী বার্তা জানান দেবে। কিংবা হয়তো করেননি।

১৯৯৬ সালে কেনিয়ায় চার দলীয় ওয়ানডে টুর্নামেন্ট খেলতে যায় পাকিস্তান। কেনিয়ার বিপক্ষে ম্যাচের আগে মুশতাক আহমেদ ইনজুরিতে পড়লে এক লেগ স্পিনারের অভিষেক হয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। ছেলেটার হাত চালিয়ে ব্যাট করতে পারাটাও কাজে লাগাতে চাইছিল পাকিস্তান দল। যদিও সেই ম্যাচে ব্যাটিং করার সুযোগ হয়নি তাঁর। বল হাতেই কোনো উইকেটের দেখা পাননি।

তবে পরের ম্যাচে শ্রীলংকার বিপক্ষে তাঁকে তিন নম্বর পজিশনে নামানো হয় দ্রুত কিছু রান তোলার জন্য। তবে শচীনের ব্যাট নিয়ে খেলতে নামা ছেলেটা কিছু রান করে মন ভরাবে কী করে! প্রথমবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ব্যাট করতে নেমেই গড়লেন ইতিহাস। সেই সময়ের দুর্দান্ত শ্রীলঙ্কার বোলিং লাইন আপ কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সেঞ্চুরি করলেন।

শুধু সেঞ্চুরি বললে অপরাধ হয়, করেছিলেন ক্রিকেট ইতিহাসের দ্রুততম এক সেঞ্চুরি। এক ইনিংসে সর্বোচ্চ ১১ টা ছয় মেরে ৩৭ বলেই ছুঁয়ে ফেলেন তিন অংকের সেই ম্যাজিক ফিগার। শতরান, ক্যারিয়ারের প্রথম শতরান, কালজয়ী এক শতরান। সেদিন গোটা বিশ্ব জেনেছিল ১৬ বছর বয়সে শচীনের ব্যাট নিয়ে বাইশ গজে ঝড় তোলা সেই অধ্যায়ের নাম শহীদ আফ্রিদি, বুম বুম আফ্রিদি।

তারপর থেকে পাকিস্তানের হয়ে নিয়মিত ওয়ানডে খেলেন এই অলরাউন্ডার। দুই বছর পর ৬৬ টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলে ফেলার পর টেস্টে অভিষিক্ত হন আফ্রিদি। অজিদের বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচেই আবারো ঝড় তোলেন। এবার বল হাতে প্রথম ইনিংসেই নেন পাঁচ উইকেট।

পরের টেস্টে ভারতের বিপক্ষে ওপেন করতে নেমে খেলেন ১৪১ রানের ইনিংস। সেই ম্যাচে ৫৪ রান খরচ করে ৩ উইকেট ও তুলে নেন তিনি। যদিও আক্রমনাত্মক ব্যাটিং স্টাইলের কারণে হয়তো টেস্টে ক্রিকেটে তাঁর পারফর্মেন্স অনেকের নজরেই আসেনি। অথচ তাঁর খেলা মাত্র ২৭ টি টেস্ট ম্যাচে প্রায় ৩৭ গড়ে করেছেন ১৭১৬ রান। বল হাতেও নিয়েছেন ৪৮ উইকেট। তবুও নানা কারণে লম্বা হয়নি তাঁর সাদা পোশাকের ক্যারিয়ার।

তবে রঙিন পোশাকে রঙ ছড়াতে দ্বিধা করেননি এই পাকিস্তানি অলরাউন্ডার। মারকুটে ব্যাটিং আর লেগ স্পিন দিয়ে রাজত্ব করেছেন গোটা ক্রিকেট বিশ্বে। হয়তো তিনি শচীনদের মত কপি বুক ব্যাটসম্যান নন। ঝুলিতে হাজার দশেক রান থাকার পরেও হয়তো তিনি ইতিহাসের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন নন।

তবে তিনি বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে, যে কোনো কন্ডিশনে তিনি ফ্যাক্টর, বিগ ফ্যাক্টর। ম্যাচের পরিস্থিতি যাই হোক, আফ্রিদি ব্যাট হাতে বাইশ গজে থাকা মানে ম্যাচে এখনো জীবিত। বুম বুম আফ্রিদি মানে এক আস্থা, লাখো ক্রিকেটপ্রেমীর ফিসফিসিয়ে বলতে থাকা এখনো আফ্রিদি আছে।

তবে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তিনি বোধহয় তাঁর সেরাটা দিয়েছেন। পাকিস্তানের হয়ে খেলা ৯৯ টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ১৫০ স্ট্রাইকরেটে করেছেন ১৪১৬ রান। বল হাতেও নিয়েছেন ৯৮ উইকেট যা বিশ্ব ক্রিকেটের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এছাড়া দেশ-বিদেশের টি-টোয়েন্টি লিগ গুলোতে তাঁর ছুটে চলা তো রয়েছেই।

সেই ১৯৯৬ সালে অভিষেক হওয়া ১৬ বছরের ছেলেটি আজ ৪২ বছরে পাঁ দিয়েছেন। তাঁর অভিষেক হওয়ার পরে জন্ম নেয়া কত ছেলে-পুলেও দিব্বি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে বেড়াচ্ছেন। তবে তিনি মাঠ ছাড়েননি। এই বয়সে এসেও বিশ্বের বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলোতে ঝড় উঠাচ্ছেন কখনো ব্যাট হাতে, কখনো আবার বল হাতে।

অবশ্য তিনিই তাঁর বায়োগ্রাফিতে বলেছিলেন তাঁর অফিশিয়াল বয়স নাকি পাঁচ বছর কমানো। তাহলে আজ তাঁর বয়স হবার কথা ৪৭ বছর। তা যতই হোক, তাতে আফ্রিদি থোরাই কেয়ার করেন। তিনি ক্রিকেটটা উপভোগ করে খেলছেন, খেলুক না।

আফ্রিদি বরাবরই একটা ধাঁধা। আস্কিং রান রেট যতই হোক, তিনি যতক্ষণ ক্রিজে থাকবেন – ম্যাচের মোড় ঘুরে যেতে পারে, কিংবা ওই গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতিতে যে তিনি ডাক মারবেন না – সেই নিশ্চয়তাও নেই। তিনি এমনই একজন ক্রিকেটার যিনি যেখানে যখন খেলেছেন – সেখানে অসংখ্য অসম্ভম ম্যাচ জিতিয়েছেন, আবার কমবেশি ডাকও মেরেছেন।

আপনি চাইলে আফ্রিদির ভক্ত হতে পারেন – সেরকম গুণ তাঁর আছে। কিংবা আপনি তাঁর সমালোচকও হতে পারেন, তাঁকে নিয়ে ট্রল করার অসংখ্য উপাদান তাঁর মধ্যে বিদ্যমান। কিন্তু কখনোই তাঁকে আপনি এড়িয়ে যেতে পারবেন না। যে কোনো রকম বল পিটিয়ে ছক্কা হাঁকানো কিংবা যেকোনো বলে আউট হয়ে যাওয়া – এমন হেয়ালি ক্রিকেটারের দেখা রোজ রোজ মিলে না।

আপনি যদি নব্বই দশকের ক্রিকেট ভক্ত হন, আপনি আফ্রিদিকে মনে রাখবেন। আপনি যদি ২০০০-এর পরবর্তী সময়ের ক্রিকেট ভক্ত হন – আফ্রিদিকে মনে রাখবেন। কিংবা যদি ২০১০-এর পর থেকে যে ফ্র্যাঞ্চাইজির জোয়ার – আপনি যদি এই সময়টার ভক্ত হন তাহলেও আফ্রিদিকে আপনি মনে রাখতে বাধ্য। কারণ, আফ্রিদি সব জায়গাতেই আছে।

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link