পরিপূর্ণ একজন ‘চার্মার’ ছিলেন তিনি, ছিলেন কার্যকর এক ক্রিকেটার। নব্বই দশকে তাঁর মত ড্যাশিং চরিত্র ভারতীয় ক্রিকেটে আর ছিল না। সমৃদ্ধ ব্যাটিং, দারুণ ফিল্ডিং – যতক্ষণ মাঠে থাকতেন মুগ্ধ করতেন।
তাঁর মধ্যে সেই গুনটা ছিল যা দিয়ে কখনো হয় ম্যাচ জেতা যেত, কখনো বা জেতা যেত হৃদয়। কেবল সমর্থকদের হৃদয় না, তিনি স্বয়ং মাধুরী দিক্ষিতের হৃদয়ও হরণ করেছিলেন বলে শোনা যায়। যদিও, অজয় জাদেজা কেবল হৃদয় জিতেই ক্ষান্ত হননি, হৃদয় ভঙ্গও করেছেন। তিনি যতটা আলোচিত ছিলেন একটা সময়, পরে হয়েছেন ততটাই সমালোচিত। কারণ, কেবল দর্শক নয় – একটা সময় তিনি বাজিকরদেরও মন যুগিয়ে চলতেন।
বলা হত, অজয় জাদেজার মধ্যে কপিল দেব সুলভ একটা ব্যাপার আছে। তাঁর খুব প্রকৃতি প্রদত্ত অ্যাথলেটিজম, চমৎকার রানিং বিটিউন দ্য উইকেট, অন্তিম মুহূর্তে ম্যাচ করে ফেলতে পারার দক্ষতা আর ভুবন ভোলানো বিজয়ী হাসি – এসব তাঁকে বাকিদের চেয়ে আলাদা করে তুলেছিল।
তিনি উইকেটে নেমেই ব্যস্ত হয়ে যেতেন, বিশেষ করে মিডল ওভারে দ্রুত সিঙ্গেল করে খেলা, শেষের দিকে চার-ছক্কার ঝড় তোলা – এই কাজগুলো করতেন। টি-টোয়েন্টির জমানা হলে হয়তো চুটিয়ে কিংবদন্তি বনে যেতে পারতেন।
১৯৯৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ২৬ বলে ৪৫ রানের এক ইনিংস খেলেছিলেন। আজকালকার টি-টোয়েন্টির যুগে এটাকে খুবই সাধারণ মনে হতে পারে – কিন্তু ওই সময় সেটা ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার। ওই দিনটাতে তিনি একদমই দয়া মায়া দেখাননি পাকিস্তানের বোলারদের। বিশেষ করে তাঁর রূদ্রমূর্তিটা সবচেয়ে বেশি টের পান ওয়াকার ইউনুস। তাঁর শেষ দুই ওভার থেকে জাদেজা বের করে আনেন ৪০ রান।
১৯৯২, ১৯৯৬, ১৯৯৯ – তিনটি বিশ্বকাপই খেলেছেন তিনি। ওয়ানডেতে পাঁচ হাজারের ওপর রান করেছেন। মিডিয়াম পেস বোলিংও করতেন কখনো। ১৯৯৯ সালে শারজাহতে একবার ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এক ওভারে নিয়েছিলেন তিন উইকেট।
যদিও, টেস্ট ক্রিকেটটায় একদমই মানাতে পারেননি জাদেজা। বিশেষ করে স্যুইং ও জেনুইন পেসের দুর্বলতার কারণে মাত্র ১৫ টেস্টেই থামে তাঁর ক্যারিয়ার। যদিও, খুব নির্মম সত্যি কথা হল – তাঁর ক্যারিয়ারটা আসলে থামিয়ে দিয়েছে ম্যাচ ফিক্সিং।
লম্বা সময় অধিনায়কের ডেপুটি ছিলেন। মোহাম্মদ আজহারউদ্দীনের পর তিনিই হবেন অধিনায়ক – সেই লক্ষ্যেই বোর্ড অব কনট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া (বিসিসিআই) তাঁকে গড়ে তুলছিল। সেজন্য টুকটাক ওয়ানডেতেও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
১৯৯৭ থেকে ২০০০ – এই তিন বছরে ১৩ টি ওয়ানডেতে তিনি অধিনায়কত্ব করেন। এর মধ্যে ভারত আটটা ম্যাচ জেতে। তবে, বিসিসিআইয়ের পরিকল্পনায় পানি ঢেলে দেন তিনি নিজেই। যদিও, এখানে পানি ঢালা না বলে ‘আগুন ধরিয়ে দেন’ বলা ভাল।
২০০০ সালে সিবিআই-এর তদন্তের পর কেঁপে ওঠে ভারতীয় ক্রিকেট। মোহাম্মদ আজহারউদ্দীন আজীবনের নিষেধাজ্ঞা পান। আর জাদেজা নিষিদ্ধ হন পাঁচ বছরের জন্য। সেটা তাঁর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারটা একেবারে শেষ করে দেয়।
যদিও, পাঁচটা বছর তিনি বেশ গ্ল্যামারাস একটা ছুটিই কাটিয়েছেন। তিনি নাম লেখান বলিউডে। ২০০৩ সালে মুক্তি পায় অজয় জাদেজা অভিনীত ‘খেল’। এ সিনেমায় ছিলেন সেলিনা জেটলি। ২০০৯ সালে করেন ‘পাল পাল দিল কে সাথ’। তবে মাঠের ফর্ম সিনেমায় আর দেখাতে পারেননি সুদর্শন জাদেজা। ফিরে যান মাঠে।
নিষেধাজ্ঞা শেষ করে তিনি ঘরোয়া ক্রিকেটে ফিরেছিলেন। ২০০৪ সালে হাই কোর্টের বিশেষ অনুমতিতে তিনি ফেরেন ঘরোয়া ক্রিকেটে। দিল্লী দলের হয়ে ফেরেন রঞ্জিতে, ফিরেই তিনি হয়ে যান অধিনায়ক।
২০০৫ সালে তিনি রাজস্থান দলে কোচ-অধিনায়ক দুই ভূমিকাতেই ছিলেন। শেষ প্রথম শ্রেণির ম্যাচ যখন খেলেন তখন তাঁর বয়স ৪২। পরে শুধু কোচিং করেন। এখন অবশ্য তিনি শুধুই ধারাভাষ্যকার। এমনকি ধারাভাষ্যকার হিসেবে ‘কাই পো চে’ ছবিতে ছোট্ট একটা চরিত্রও করেছেন।
জাদেজার জন্ম ১৯৭১ সালের এক ফেব্রুয়ারি, গুজরাটের জামনগরে। ‘সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম’ বলতে যা বোঝায় সেটাই হয়েছিল তাঁর। তিনি রাজ পরিবারের ছেলে। কে.এস রঞ্জিৎসিংজি ও কে.এস দুলীপসিংজি – দু’জনেই তাঁর আত্মীয়। এই দু’জনের নামেই ভারতের রঞ্জি ট্রফি ও দুলীপ ট্রফির নামকরণ হয়েছে। সাবেক প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটার কে.এস ছত্রপালসিংজি হলেন জাদেজার আপন চাচা।
এমন একটি পরিবারের ছেলের ক্যারিয়ারের শেষটাও রাজকীয় হওয়ারই কথা। কিন্তু, তিনি নিজেই যে নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছেন। নিজের নাম, বংশের নামই শুধু নয়, তাঁর ফিক্সিংয়ের ঘটনায় কলঙ্কিত হয়েছে ভারত এবং ক্রিকেট বিশ্বও।