বাংলাদেশের ক্রিকেট আর ফুটবল – একটা খেলার জনপ্রিয়তা বাড়া ও আরেকটার কমে যাওয়ার মধ্যে একটা সমান্তরাল রেখা টানা আছে। আর সেটা হল ১৯৯৭ সালের আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। সেই আসরে মালয়েশিয়াতে কেবল বিশ্বকাপ ক্রিকেটের টিকেট পাওয়ার পাশাপাশি, টুর্নামেন্টের সেরাও হয় বাংলাদেশ। সেই দলটির কাণ্ডারি ছিলেন আকরাম খান – দ্য বিগ হার্টেড ক্রিকেটার।
পরিসংখ্যানগত দিক থেকে নব্বই দশকের যেকোনা বাংলাদেশি ক্রিকেটারের মত আকরাম খানও ছিলেন সাদামাটা। আর তাই, বাকিদের মত তাঁকেও ঠিক পরিসংখ্যানের মাপকাঠিতে ফেলা যাবে না। এ কথা না স্বীকার করলেই নয়, তাঁর স্রেফ ৬৮ রানের একটা ইনিংস বাদ দিলেই বাংলাদেশ ক্রিকেট পিছিয়ে যায় অন্তত বছর চারেকের জন্য।
১৯৯৭ সালে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে সেই ম্যাচটা ছিল আইসিসি ট্রফির গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচ। ৩৩ ওভারে ১৪১ রানের লক্ষ্যের সামনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের ১৫ রানে চারটা উইকেট পড়ে, ৮৬ রানে পড়ে ছয়টা। আকরাম ঠায় ছিলেন উইকেটে। শরীরটা যতই বিশাল হোক না কেন, সাহসটাও ছিল আকাশচুম্বি – ফিটনেস তাই বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি সেই ইনিংসে। মাত্র তিন বাউন্ডারির ইনিংস দিয়ে তিনি রানরেটের সাথে পাল্লা দিয়ে জয় এনেছেন টেল এন্ডারদের সঙ্গী করে।
প্রথম হাফ সেঞ্চুরি আকরাম করেন পাকিস্তানের বিপক্ষে, ১৯৯৭ সালের এশিয়া কাপে। ৫৯ রানের ইনিংস খেলার পথে কলম্বোতে তিনি সামলান আকিব জাভেদ, সাকলাইন মুশতাকদের।
আকরামের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ভাল সময়টা ছিল ১৯৯৮-৯৯ মৌসুমে। বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়ার আগে ১৯৯৯ সালের মার্চে তিনি টানা দুই হাফ সেঞ্চুরি করেন কেনিয়া ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। বিশ্বকাপের শুরুতে অবশ্য ফর্মে ছিলেন না।
ফর্মে ফিরেছিলেন শেষ ম্যাচে। পাকিস্তানের বিপক্ষে ঐতিহাসিক জয় পাওয়ার ম্যাচে তার ব্যাট থেকে আসে ৪২ রান। সেই ফর্ম ধরে রেখেছিলেন ঢাকার মাটিতে এরপর অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৪১ রান করার পরের ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে করেন ৬৪ রান।
ভারতের বিপক্ষে সেই ম্যাচে দানবীয় আকার ধারণ করেছিল আকরামের ব্যাট। ইনিংসটি খেলেছিলেন মাত্র ৫২ বলে। আট চারের সাথে ছিল একটি ছক্কা। তবে, ওয়ানডের মত টেস্টটাতে তিনি দীর্ঘদিন দলকে সার্ভিস দিতে পারেননি। তবে, টেস্ট ইতিহাসে বাংলাদেশের প্রথম ছক্কা এসেছিল তাঁরই ব্যাট থেকে।
আকরামের বড় গুণ ছিল, মিডল অর্ডারে রানের চাকা সচল রাখতে পারা। স্পিন বোলিংটা বেশ ভাল খেলতেন। মাঝের ওপর গুলোতে তাঁর ওপর ভরসা করতো বাংলাদেশ দল। প্রয়োজনের সময় জ্বলে উঠতে জানতেন, ব্যাটিং করতেন পরিস্থিতি বুঝে। ঘরোয়া ক্রিকেটে ছিলেন বিশাল পারফর্মার। ওই আমলে বাংলাদেশ ক্রিকেটের নি:সন্দেহে অন্যতম সেরা ছিলেন।
খেলোয়াড়ী জীবনের ইতি মন মত টানতে না পারলেও তিনি ক্রিকেটের সাথে আছেন এখন। তিনি বাংলাদেশ দলের নির্বাচক হিসেবে করেছেন বড় সময়, এখন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালকদের একজন তিনি। যদিও, সেই পরিচয়ে আদৌ তিনি কতটা দেশের ক্রিকেটের জন্য ভূমিকা রাখতে পেরেছেন – সে নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
আকরাম খানের সাথে বাংলাদেশ ক্রিকেটের বড় কিছু রেকর্ড জড়িয়ে আছে, যা আদৌ মুছে ফেলা যাবে না। বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে জয় এসেছে তাঁর নেতৃত্বে। ভারতে কোকাকোলা ত্রিদেশীয় সিরিজের সেই ম্যাচে তিনি নিজেও ৫১ বলে ৩৯ রানের ইনিংস খেলেন, কেনিয়ার ২৩৬ রানের জবাবে দুই ওভার হাতে রেখে জয় পায় বাংলাদেশ।
চট্টগ্রাম একটা সময় বাংলাদেশ ক্রিকেটের আঁতুরঘর ছিল। আর তাতে সেখানকার খান পরিবারের বড় একটা অবদান ছিল। আকরাম খান সেই পরিবারের প্রথম জাতীয় ক্রিকেটার। পরে তাঁর ভাতিজা নাফিস ইকবাল ও তামিম ইকবাল খানও জাতীয় দলে খেলেন। খানদের সেই ক্রিকেট ঐতিহ্য বহাল তবিয়তে টিকে আছে দেশের ক্রিকেটে!
হ্যাঁ, খেলোয়াড়ী জীবনে আকরাম খান যেমন সর্বেসর্বা ছিলেন, প্রশাসনিক ভূমিকায় তিনি তেমনটা ছিলেন না। দু’টো পুরোপুরি ভিন্ন দু’টি পরিচয়। সেখানে তাঁর ভূমিকা ও কার্যকারিতা নিয়ে আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের যথেষ্ট সুযোগ আছে। হয়তো খেলোয়াড়ী জীবনের মত প্রশাসনিক দায়িত্বেও আরো দায়িত্ববান হয়ে উঠবেন তিনি!