বাংলাদেশের ক্রিকেটের কয়েকটা রহস্য নিয়ে আপনি যদি কাজ করেন, তাহলে এই তালিকায় অলক কাপালি থাকার কথা।
সম্ভবত বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে সুন্দর ব্যাটসম্যানদের একজন তিনি। কিন্তু কীসব আশ্চর্য কারণে সেই সৌন্দর্য্য পারফরম্যান্সে ফুঁটিয়ে তুলতে পারলেন না। আজও তাই এক আক্ষেপ, এক রহস্য হয়ে আছেন অলক কাপালি।
একজন আদর্শ ব্যাটসম্যানের সব গুলো গুনই ছিল তাঁর মাঝে। বিশ্বমানের ব্যাটসম্যান হতে যা যা দরকার তাও ছিল। দেশের ক্রিকেটে এমন প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান খুবই কম দেখা গেছে। ডান হাতের কব্জিতে অনেক বাহারি শটের দখল ছিল তাঁর। দারুণ ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি ডান হাতে লেগ স্পিনটাও ভাল করতে পারতেন তিনি। এত প্রতিভাবান একজন ক্রিকেটার হয়েও নিজেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সেভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি অলক কাপালি।
খুব স্বল্প সংখ্যক ম্যাচেই থেমে যায় অলকের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ার। সল্প সংখ্যক সেই ম্যাচ খেলেই হয়েছেন টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম হ্যাটট্রিক ম্যান, ব্যাট হাতে করেছিলেন ওয়ানডেতে দ্রুততম সেঞ্চুরি।
অলকের সহজাত নান্দনিক ব্যাটিং স্টাইল ছিল অনেকটা চোখের প্রশান্তি। ট্রেডমার্ক কাভার ড্রাইভ, দৃষ্টিনন্দন সুইপ, শ্লগসুইপ, স্কয়ার কাট ও দ্রুত রান করার ক্ষমতা এবং স্বকীয় স্টাইল তাঁকে অতি অল্প সময়ে তারকা ক্রিকেটারের খ্যাতি এনে দিয়েছিল। ব্যাটিং আর বোলিংয়ের পাশাপাশি ফিল্ডিংয়ে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন এই ক্রিকেট প্রতিভা।
দেশের ক্রিকেটে তাঁর আগমন দুঃসময়ে ত্রাতার মতো। দলে এসে আলো ছড়িয়েছেন ব্যাটে বলে। ২০০২ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে ক্রিকেটের অভিজাত সংস্করণ টেস্টে তাঁর অভিষেক হয়। অভিষেক ম্যাচে নিজের সামর্থ্যের জানান দেন অলক কাপালি। প্রথম ইনিংসে ব্যাট হাতে ৭২ বলে করেন ৩৯ রান, চার বাউন্ডারিতে তাঁর এই দৃষ্টিনন্দন ইনিংসটি সাজান অলক। দ্বিতীয় ইনিংসেও রান পান তিনি।
২০০২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তৃতীয় ওয়ানডেতে ৯২ বলে ৮৯ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের জাত চেনান তিনি।
ওয়ানডেতে ভাল খেলার ধারাবাহিকতা তিনি ধরে রাখেন টেস্টেও। প্রথম টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে খেলেন ৫২ রানের ইনিংস। দ্বিতীয় টেস্টে তিনি নিজের সেরা ইনিংসটি খেলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। ২০০২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৮৫ রানের ইনিংস খেলেছিলেন বাংলাদেশের ডান হাতি এই স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান। দারুণ সব শটে সাজিয়েছিলেন তার এই ইনিংস। ১২ বাউন্ডারির সাথে ছিল ২টি ওভার বাউন্ডারির মার। সেই ম্যাচটি বাংলাদেশ হেরেছিল সাত উইকেটে। বাংলাদেশ ম্যাচ হারলেও তাঁর এই নানন্দিক ইনিংসটির কারণে ম্যাচ সেরা নির্বাচিত হয়েছিলেন অলক।
ডান হাতে ব্যাট করার পাশাপাশি লেগ স্পিনটা ভাল করতে পারতেন অলক। ডান হাতের লেগ স্পিন ঘূর্ণিতে টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম হ্যাটট্রিক করেছিলেন তিনি। ২০০৩ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে তিন ম্যাচ টেস্ট সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে ১০৭ তম ওভারে পঞ্চম এবং ষষ্ঠ বলে সাজঘরে ফেরান সাব্বির আহমেদ এবং দানিশ কানেরিয়াকে। ইনিংসের ১০৯তম ওভারের প্রথম বলেই ওমর গুলকে লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেলেন অলক কাপালি। সেই সাথে পেয়ে যান টেস্ট ক্রিকেটে নিজের প্রথম হ্যাটট্রিক। মাত্র ১৯ বছর ২৪০ দিন বয়সে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে এই রেকর্ড করেন অলক।
বাংলাদেশের প্রথম হ্যাটট্রিক ম্যানের টেস্ট ক্যারিয়ার দীর্ঘ হয়নি। ২০০২ সালে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হওয়া এই ক্রিকেটার বাংলাদেশের হয়ে শেষ টেস্ট ম্যাচটি খেলেছেন ২০০৬ সালে। দীর্ঘ চার বছরে ১৭ টেস্ট ম্যাচে থেমে আছে তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ার।
অলক কাপালি ওয়ানডে ক্রিকেটের জন্য একজন আদর্শ ব্যাটসম্যান ছিলেন। ২০০২ সালে টেস্টের মত ওয়ানডে ক্রিকেটেও অভিষেক শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। আর সর্বশেষ ওয়ানডে খেলেছেন ২০১১ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে।
নিজের খারাপ ফর্মের কারণে দল থেকে বাদ পড়েন অলক কাপালি। সে সময় বাংলাদেশের নতুন কোচ ডেভ হোয়াটমোরের যুগে আর নিয়মিত হতে পারেননি দলে। ২০০৭ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলেও জায়গা হয়নি তাঁর।
ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফর্ম করে ফেরেন দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত প্রথম টি-২০ বিশ্বকাপের বাংলাদেশ স্কোয়াডে।
ওয়ানডে ক্রিকেটে নিজের সেরা ইনিংসটি খেলেছিলেন ২০০৮ সালে এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষে। আফতাব আহমেদের ইনজুরিতে সেবার এশিয়া কাপে বাংলাদেশ দলে ডাক পান অলক। সে আসরে সুপার ফোর ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে সেই ম্যাচে চার-ছক্কার ফুলঝুরি ছুটিয়ে ছিলেন অলক কাপালি। মাত্র ৮৬ বলে ভারতের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেন তিনি। যা ছিল বাংলাদেশী হিসেবে দ্রুততম সেঞ্চুরি এবং ভারতের বিপক্ষে প্রথম সেঞ্চুরি। ৯৭ বলে ১১৫ রানের ইনিংসটি সাজান ১০টি চার এবং ৫টি ছক্কায়।
লর্ডসের মতো পাকিস্তানের করাচিতে মাঠেও রয়েছে অনার্স বোর্ড। যেখানে ওয়ানডে, টেস্ট, টি-২০তে সেঞ্চুরি কিংবা পাঁচ নাম লেখা হয়ে যায় এই বোর্ড। এশিয়া কাপে করাচিতে ভারতের বিপক্ষে সেই সেঞ্চুরির সুবাদে অলক কাপালির নাম লেখা হয়ে আছে সেই বোর্ডে।
বাংলাদেশের হয়ে ৬৯টি ওয়ানডে খেলে এক সেঞ্চুরি এবং পাঁচ হাফ সেঞ্চুরিতে রান করেছেন ১২৩৫। বল হাতে লেগ স্পিন ঘূর্ণিতে ২৪টি। তিনি হতে পারতেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেরা অলরাউন্ডারদের একজন। ব্যাট-বল দুটোই যে সমান তালে কথা বলতো অলক কাপালির। কিন্তু জীবন তো আর ফুলে ফুলে সাজানো কোনো গল্প নয়। অফ ফর্ম আর পর্যাপ্ত সুযোগের অভাবে দল থেকে ছিটকে যান অলক।
অলক কাপালি ২০০৮ সালে ভারতের বিদ্রোহী ক্রিকেট লিগ আইসিএল যোগ দেন। সেই সিদ্ধান্ত ভুল ছিল না বলেও মনে করেন এই ক্রিকেটার। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত তাঁর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারে প্রভাব ফেলে বেশ, ফিরে এসে জাতীয় দলে ফিরলেও আগের মত নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি।
আইসিএলে খেলতে গিয়ে ব্যাট হাতে দারুণ পারফর্ম করেছিলেন তিনি, আইসিএলের প্রথম সেঞ্চুরিটিও আসে তাঁর ব্যাট থেকে। মাত্র ৬০ বলে সেঞ্চুরি করেছিলেন অলক। তিনি সেই আসরের দ্বিতীয় রান স্কোরারও হয়েছিলেন।
জাতীয় দল থেকে বাদ পড়েছেন নয় বছর হল কিন্তু দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে এখনো নিয়মিত খেলে যাচ্ছেন তিনি।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১৬৭ ম্যাচে রান করেছেন ৯০৬৭। তিনটি ডাবল সেঞ্চুরির পাশাপাশি আছে সতেরোটি সেঞ্চুরি।
লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটেও খেলে যাচ্ছেন তিনি। ২২১ ম্যাচে তাঁর রান ৪৭২৩। চার সেঞ্চুরির পাশাপাশি আছে ২১টি হাফ সেঞ্চুরি।
টি-২০ ক্রিকেটে খেলছেন নিয়মিত। দেশের ফ্যাঞ্চাইজি ভিত্তিক টি-২০ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট তাঁর কদর আছে এখনো। প্রতিবার বিপিএলে দল গুলো তাঁকে দলে নেয়। ব্যাট- বলে তরুনদের সাথে তাল মিলিয়ে পারফর্মও করে যাচ্ছেন। ২০১৫ সালে বিপিএলে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের শিরোপা জয়ের অন্যতম নায়ক ছিলেন তিনি। হয়েছিলেন ম্যান অব দ্যা ফাইনালও।
হয়তো আর কয়েক বছর ক্রিকেটটা চালিয়ে যাবেন তিনি, ঘরোয়া ক্রিকেটে তাঁর উপস্থিতি তরুণরা শিখতে পারবে অনেক কিছু। কিন্তু তারপরও অলক এক রহস্য হয়েই থেকে যাবেন।