সত্তরের দশকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সবচেয়ে ধারাবাহিক পারফরমারদের একজন ছিলেন আলভিন কালিচরণ। তাঁকে ভাবা হচ্ছিলো ক্রিকেট দুনিয়ার পরবর্তী কিংবদন্তি হিসেবে। ক্যারিয়ারের শুরুটাও করেছিলেন বেশ দুর্দান্ত। যে সম্ভাবনা আর আশার আলো দেখিয়ে জাতীয় দলে এসেছিলেন তাঁর অর্ধেকই হয়তো দিতে পারেননি তিনি!
তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের দলের সবচেয়ে বড় অ্যাসেটের একটি! তবুও খারাপ সময়ে পাশে পায়নি দলকে। ক্যারিয়ারের খারাপ সময়টায় বাদ পড়ার পর হারিয়ে গেছেন অচিরেই! ক্রিকেট গ্রেট হতে যাওয়া কালিচরণ ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের সেরাদের একজন হলেও ক্রিকেটের এক আক্ষেপ হিসেবেই শেষ করেছেন ক্যারিয়ার!
গায়ানার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন কালিচরণ। চার ভাই ও ছয় বোন সহ ১১ জন ভাই-বোন নিয়ে ছোট থেকেই একটি ক্রিকেট দলের সাথে ছিলেন তিনি! তার বাবা ছিলেন একজন নারকেল চাষী। তিনি নিজেও ক্লাব ক্রিকেটে খেলেছেন। লাঠি-সোঁটা দিয়েই ক্রিকেট খেলতেন কালিচরণ। গোলাকার কিছু পেলে সেটিকে বল বানিয়েতে পেটাতেন তিনি।
স্কুল লেভেলেই পোর্ট ম্যুরান্ট ক্লাবের হয়ে নজরকাড়া পারফরম করেন তিনি। শিল শিল্ড ট্রফিতে গায়ানার হয়ে মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি অধিনায়কত্ব করেন!
কালিচরণের প্রতিভা সবার আগে দেখতে পায় ইংলিশ কাউন্টি দল গ্ল্যামরগান। তবে বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞার কারণে তাকে নিজেদের দলে নিতে পারেনি গ্ল্যামরগান। এই সুযোগে ওয়ারউইকশায়ারের অধিনায়ক অ্যালান স্মিথ নিজে গায়ানা গিয়ে কালিচরণের সাথে চুক্তি করেন। ১৯৭১ সালে ওয়ারউইকশায়ারে যোগ দেন এই মারকুটে ব্যাটার।
পরের বছর ১৯৭২ সালে টেস্ট দলে ডাক পান তিনি। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে অভিষেকও হয় কালিচরণের। আর অভিষেক টেস্টে ব্যাট করতে নেমে প্রথম ইনিংসেই গড়েন সেঞ্চুরি রেকর্ড। দ্বিতীয় ইনিংসে অবশ্য ব্যাট করার সুযোগ হয়নি। এরপর দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নেমেই হাঁকান আরেকটি সেঞ্চুরি! বিল পন্সফোর্ড, ডল ওয়াল্টার্সের পর তৃতীয় ক্রিকেটার হিসেবে নিজের প্রথম দুই ইনিংসেই সেঞ্চুরির কীর্তি গড়েন কালিচরণ।
পরের বছরই ওয়ানডেতেও অভিষেক হয় এই তরুন তারকার। ওয়ানডে অভিষেকের দ্বিতীয় ম্যাচেই করেন অসাধারণ এক ফিফটি। সেবার অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্টে ওভালে টানা দুই ইনিংসেই ফিফটির দেখা পান তিনি। পরের সিরিজে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কেনিংটন ওভালে টানা দুই ইনিংসেই খেলেন আশি রানের ইনিংস।
ওই ফর্মটা ক্যারি করেন পরের বছরেও। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে ঘরের মাটিতে দুই সেঞ্চুরি ছাড়াও খেলেন ৯৩ রানের আক্ষেপময় এক ইনিংস। সেঞ্চুরির দেখা পান ভারতের বিপক্ষে পরের সিরিজেও!
১৯৭৪ সালে সেবার গর্ডন গ্রিনিজ, ভিভ রিচার্ডসরা অভিষেকের অপেক্ষায়। দলে ততদিনে নিজের সেরাটা দিয়ে জায়গা পাঁকা করে ফেলেছেন কালিচরণ। তার ঝড়ো ব্যাটিং প্রতিপক্ষের জন্য বরাবরই হুমকি। পরের বছর ১৯৭৫ এর বিশ্বকাপেও খেলেন তিনি।
সেখানে বিশ্বকাপের উদ্বোধনী আসরেই শিরোপা জয় করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সেখানে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দুই ম্যাচে দু’টি ফিফটি করেন এই ক্যারিবিয়ান তারকা। ওই বিশ্বকাপের হাই ভোল্টেজ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তিনি ৭৯ বলে ৮৩ রানের অসাধারণ এক ইনিংস উপহার দেন দলকে। ডেনিস লিলির টানা ১০ বলে নেন ৩৫ রান! লিলির উপর ওই দশ বলে তাণ্ডব চালান কালিচরণ (৪,৪,৪,৪,৪,১,৪,৬,০,৪)!
পরের তিন বছর মাত্র তিন ওয়ানডেতে সুযোগ পান তিনি! তবে টেস্টে ছিলেন নিয়মিত মুখ। ১৯৭৮ সালে ক্যারি প্যাকারের ওয়ার্ল্ড সিরিজে খেলা বেশ কিছু ক্রিকেটারকে বাদ দেয় ক্রিকেট ওয়েস্ট ইন্ডিজ (সিডব্লিউআই)। তখন অধিনায়কের পদ থেকে সরে দাঁড়ান ক্লাইভ লয়েড।
লয়েডের এমন সিদ্ধান্তের অনেক ক্রিকেটারই টেস্ট থেকে নিজেদের নাম সরিয়ে নেয়। একটা নতুন দল পুনরায় গঠন করা হলো। আর সেই দলের দায়িত্ব পান কালিচরণ। কিন্তু শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ঘরের মাটিতে আনকোরা ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল পেরে উঠতে পারেনি।
পরের সিরিজটা ভারতের। কালিচরণের কাঁধেই দলের দায়িত্ব। ওই সিরিজে ৬০ গড়ে ৫৩৮ রান করেন এই ক্যারিবিয়ান তারকা। ব্যাট হাতে ছিলেন তিনি ধারাবাহিক ফর্মে। তবে ভারতের মাটিতে ১-০ তে হেরে যায় ক্যারিবীয়রা। ৫১ টেস্টে ৫০ গড়ে (৪৯.৬০) গড়ে তিনি করেছেন ৩৮৬৯ রান।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের টপ অর্ডার দ্রুত ফিরলেও তিনি সাবলিল ভাবেই ব্যাট হাতে টিকে থাকতেন ঘন্টার পর ঘন্টা! পরবর্তীতে ক্লাইভ, গর্ডনরা আবার ফিরলে অধিনায়কত্ব থেকে অব্যহতি পান তিনি। ৯ ম্যাচে কালিচরণের অধীনে ক্যারিবীয়রা জয় পেয়েছে মাত্র ১ ম্যাচে। যদিও দল বিবেচনায় ওই ১ জয় তখন অনেক বড় ব্যাপারই।
অধিনায়কত্ব গেলেও ব্যাট হাতে বেশ কয়েক ম্যাচেই দুর্দান্ত পারফরম করেন তিনি। কিন্তু ১৯৮০ সালের শুরুর দিকে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে এক টেস্টে সেঞ্চুরির পরের টেস্টের দুই ইনিংসেই ডাক মারেন তিনি। এরপর ৭৫ রানের একটি ইনিংস খেললেও সে বছর ব্যাট হাতে আর স্বরুপে দেখা যায়নি এই ক্যারিবিয়ান তারকাকে।
এরপরই বাদ পড়েন দল থেকে। আর জাতীয় দলের জার্সি গায়ে ফিরতে পারেননি তিনি! ওয়ানডে দল থেকেও বাদ পড়েন স্বল্প সময়ের ব্যবধানে। বাদ পড়ার পর তিনি ফিরেন যান কাউন্টিতে। সেখানে ওয়ারউইকশায়ারের হয়ে খেলে যান আরও বছর কয়েক।
১৯৮৩ সালে উইজডেন বর্ষসেরা ক্রিকেটারের পুরষ্কারও জেতেন কালি। ৬৬ টেস্টে ৪৪.৪৩ গড়ে করেছেন ৪৩৯৯ রান। ১২ সেঞ্চুরির পাশাপাশি আছে ২১ ফিফটি। ৩১ ওয়ানডেতে ৩৪ গড়ে করেছেন ৮২৬ রান। ঘরোয়া ক্রিকেটে ৮৮৩ ম্যাচে করেছেন প্রায় ৪৪ হাজার রান! টেস্ট ক্যারিয়ারের শেষদিকে খারাপ সময়টা না গেলে ক্যারিয়ার শেষে ৫০ এর বেশি গড় নিয়েই বিদায় নিতে পারতেন এই ক্যারিবিয়ান গ্রেট!