এক অখ্যাত হ্যারির ডায়েরি

আজ বছর দশেক হয়ে গেল, বাবা পৃথিবীতে নেই। থাকলে কি বলতেন? জানিনা। বাবা ১৬ আগস্ট লর্ডস টেস্ট দেখলে কি প্রতিক্রিয়া দিতেন? জানিনা। ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে বসে চন্দ্র-ও কি দেখলেন সেদিন খেলাটা? জানি না। দেখলে কি প্রতিক্রিয়া দিলেন? জানি না। শুধু জানি, আমার ভারতের ফ্যান হওয়ার পেছনের সেই অরণ্যদেবকে সেদিন দেখাটা মিথই থেকে গেল সারাজীবনের মত।

আমার নাম হ্যারি। আমি ব্রিটিশ। হরি শোনে অনেকে। তাই অনেকে ভারতীয় ভাবে আমাকে। তা, ভারতীয় না হলেও ভারতের ফ্যান, টু বি একজ্যাক্ট, চন্দ্র’র ফ্যান আমি।

দিনটা এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে। ২৩ আগস্ট, ১৯৭১ সাল। আমি তখন ১৩। এই ওভালের ভক্সহল প্রান্ত থেকে চন্দ্রর ঐ অলৌকিক স্পেলটা দেখে ফেলেছিলাম যে। ১৮.১-৩-৩৮-৬। চন্দ্রর শিকার ছিলেন লাকহার্স্ট, এডরিচ, ফ্লেচার, রে ইলিংওয়ার্থ, স্নো আর প্রাইস। মাত্র ৪৫.১ ওভারে ঝুলে যায় অমিত শক্তিধর ইংল্যান্ড দ্বিতীয় ইনিংসে ১০১ রানে। আর ৭১ রানের প্রথম ইনিংস লিড নিয়েও পঞ্চম দিনে চার উইকেটে হারে টেস্টটা।

প্রথম ইনিংসে ৩৫৫ করেছিল ইংল্যান্ড ওভালে, প্রথম দিনে। জেমসনের ৮২ আর অ্যালান নটের ৯০ রানের ইনিংসে ভর দিয়ে। একনাথ সোলকার তিন আর বেদি-চন্দ্র-ভেঙ্কট দু’টো করে উইকেট নেন। দ্বিতীয় দিন খেলা হয়নি, বৃষ্টির জন্য। তৃতীয় দিন ভারত করে ২৩৪/৭। অনেকের মিলিত চেষ্টায় চতুর্থ দিন সেই ইনিংস শেষ হয় ২৮৪তে, ইলিংওয়ার্থ পাঁচ উইকেট নিয়েছিলেন।

অধিনায়ক অজিত ওয়াদেকার ৪৮, দিলীপ সারদেশাই ৫৪, সোলকার ৪৪, ফারুখ ইঞ্জিনিয়ার ৫৯। তারপরে একদিন বিশ্রামের পরে চতুর্থ দিন আমাদের ঝরাপাতার মত টুপ টুপ করে খসে পড়ার কথা তো আগেই বললাম। দ্বিতীয় ইনিংসে আমাদের ১০১-তে সর্বোচ্চ ছিল ডি’অলিভেরার ১৭। চন্দ্রর ছয় উইকেট ছাড়াও ভেঙ্কট দুটো আর বিষান সিং বেদি এক উইকেট নেন, জেমসন রান আউট হন।

মোট ১৭৩ রানের টার্গেটের সামনে সেদিন ভারত শেষ করে ৭৬/২-তে। শেষদিন, আজ থেকে ৫০ বছর আগের সেই ২৪ আগস্ট ভারত চার উইকেটে জয় তুলে নেয় ১৭৪/৬ করে। আবার অধিনায়ক ওয়াদেকার (৪৫) ও সারদেশাইয়ের (৪০) জ্বলে ওঠা, সাথে ভিশি-র ৩৩ ও ইঞ্জিনিয়ার অপরাজিত ২৮। আন্ডারউডের ব্যর্থ শেষ চেষ্টায় তিন উইকেট নেওয়া।

চতুর্থ দিন ভক্সহল প্রান্ত থেকে চন্দ্রর ঐ অলৌকিক স্পেলটা আবার মনে পড়ছে আজ ৬৩তে দাঁড়ানো আমার। এই তো আট দিন আগে লর্ডস টেস্টে আমাদের স্পিনার সামি-বুমরার কাছে অসহায় আত্মসমর্পণের মুহূর্তে স্পিন বোলিং-এর মৃত্যুশয্যা থেকে শেষকৃত্য – সব দেখিয়ে দিয়েছিলেন।

আজ বছর দশেক হয়ে গেল, বাবা পৃথিবীতে নেই। থাকলে কি বলতেন? জানিনা। বাবা ১৬ আগস্ট লর্ডস টেস্ট দেখলে কি প্রতিক্রিয়া দিতেন? জানিনা। ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে বসে চন্দ্র-ও কি দেখলেন সেদিন খেলাটা? জানি না। দেখলে কি প্রতিক্রিয়া দিলেন? জানি না। শুধু জানি, আমার ভারতের ফ্যান হওয়ার পেছনের সেই অরণ্যদেবকে সেদিন দেখাটা মিথই থেকে গেল সারাজীবনের মত।

বাবার সাথে দেখেছিলাম খেলাটা। বাবা কাঁদছিলেন। আর আমি চন্দ্রাহত হয়ে গিয়েছিলাম। চন্দ্র মিথ হয়ে গিয়েছিলেন আমার জীবনে। তারপরে আর কোনদিন ইংল্যান্ডের খেলা দেখেননি বাবা।

এক অলৌকিক জয়ের ৫০ বছরে ভারত আজ নিশ্চয়ই আনন্দমুখর। ওয়াদেকার, সোলকার, সারদেশাই আর সেদিনের ম্যানেজার হেমু অধিকারীও আজ জীবনের মাঠে নেই, বাবার মতনই। সানি-ভিশি-মানকড়-ইঞ্জিনিয়ার-ভেঙ্কট-বেদী-আবিদ আলীর সঙ্গে আমার আইডল চন্দ্রও আজ নিশ্চয়ই ৫০ বছর আগের দিনটার ওই গৌরবের জয়টায় উৎসবে মাতবে, সবাই ৭০ পেরিয়ে গেলেও।

২৪ আগস্ট, ২০২১।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...