শেষ বিকেলের আলো

নব্বইয়ের দশক থেকে পরবর্তী সময়টা রাজত্ব ছিলো অজিদের। নব্বইয়ের দশক থেকে একটা লম্বা সময়ে ২২ গজে নিজেদের আধিপত্য দেখায় অজিরা। ওই সময়টাই অজিদের ক্রিকেট ইতিহাসের স্বর্ণালী সময়। ভুরি ভুরি তারকা ক্রিকেটারদের ভীড়ে অনেকেই ক্যারিয়ার লম্বা করতে পারেননি। একবার ছিটকে গেলেই ফিরতে অপেক্ষা করতে হয়েছে অগনিত প্রহর। সেই পথেরই অপেক্ষমান এক প্রতিভাবান মিনি অলরাউন্ডার ছিলেন অ্যান্ডি বিকেল, নি:সন্দেহে দলের সবচেয়ে আন্ডাররেটেডও তিনিই ছিলেন।

জেসন গিলেস্পি, ব্রেট লি, গ্লেন ম্যাকগ্রাদের মতো তারকাদের ভিড়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ার লম্বা করতে পারেননি বিকেল। সাত বছরের ক্যারিয়ারে খেলেছেন মোটে ১৯ টেস্ট! তবে ওয়ানডে খেলেছেন ৬৭ টি। গিলেস্পি ও ম্যাগ্রা তখন দলের নিয়মিত মুখ। সাথে তৃতীয় পেসার হিসেবে তরুণ ব্রেট লি ছিলেন নির্বাচদের পছন্দের। কারো ইনজুরি কিংবা তৃতীয় পেসার হিসেবেই দলে আসা যাওয়ার মধ্যে ছিলেন বিকেল। নিজেকে প্রমাণের একটা বড় মঞ্চ খুঁজছিলেন মনে মনেই। কিন্তু নিজেকে প্রমাণ করতে হলে তার আগে সুযোগ যে মিলতে হবে! সেই মঞ্চটাই যেনো পাচ্ছিলেন না তিনি।

অবশেষে সেই সুযোগ পেলেন! ২০০৩ বিশ্বকাপ আশির্বাদ রুপে এলো বিকেলের ক্যারিয়ারে। এই বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত সাদা পোশাকে বেশ অনিয়মিত মুখ হলেও রঙিন পোশাকে নিজেকে অনেকটাই মেলে ধরেছিলেন তিনি। একজন বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবেই বিশ্বকাপের মঞ্চে পেয়ে গেলেন সুযোগ। স্কোয়াডে থাকলেও একাদশে সুযোগ পাওয়াটা যেনো বিশাল কিছু! তারকায় ঠাঁসা এই দলে নিজের জায়গাটা যেন শুধু কল্পনাই করতে পারছিলেন বিকেল।

তবে ভাগ্যেটা সেবার সুপ্রসন্নই ছিলো বিকেলের। ইনজুরিতে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যান গিলেস্পি। আর তাতেই কিনা একাদশে সুযোগ পেয়ে যান বিকেল। কথায় আছে – সুযোগ বার বার আসে না, আর যখন আসে সেটা অবশ্যই লুফে নিতে হয়। সোনার হরিণের মতো পাওয়া সেই সুযোগ নির্দিধায় লুফে নেন অ্যান্ডি বিকেল। সুযোগ পেয়েই করলেন বাজিমাত। নিজের প্রথম ম্যাচে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে সুযোগ পেয়েই শিকার করলেন তিন উইকেট!

৫ ওভার বল করে ১৩ রানে নেন তিন উইকেট। পরের ম্যাচে ১ ওভারেই কোনো রান না দিয়েই শিকার করেন ২ উইকেট! অবশ্য নামিবিয়ার বিপক্ষে সেই ম্যাচে একাই ধসিয়ে দেন গ্লেন ম্যাগ্রা! সেই ম্যাচে ম্যাগ্রা একাই শিকার করেন ৭ উইকেট!

গ্লেন ম্যাকগ্রার সেই স্পেলটা হয়তো বেশ মনে ধরেছিলো বিকেলের। আর মনে মনেই হয়তো ছক কষে ছিলেন এমন কিছু একটা তিনিও করে দেখাবেন। সেজন্য অবশ্য খুব বেশি সময় অপেক্ষাও করতে হয়নি তাঁকে। পরের ম্যাচেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বিধ্বংসী বোলিং করে ১০ ওভারে মাত্র ২০ রানে ৭ উইকেট শিকার করেন বিকেল!

শুধু বোলিংয়েই নয়, ব্যাট হাতে সেদিন খাদের কিনারা থেকে দলকে বাঁচাতে সেরাটা দেন তিনি। তাঁর দুর্দান্ত বোলিংয়ে ২০৪ রানে থামে ইংলিশদের ইনিংস। জবাবে ব্যাট করতে নেমে দলীয় ১১৪ রানে ৪ ও ১৩৫ রানে ৮ উইকেট হারিয়ে ম্যাচে ব্যাকফুটে অজিরা! শেষ দুই উইকেটে প্রয়োজন ছিলো ৭০ রান।

মাইকেল বেভান তখনো ক্রিজে। বেভানের সাথে ৭০ রানের জুটি গড়ে দলকে সহজেই জয়ের বন্দরে পৌঁছে দেন অ্যান্ডি বিকেল। ৩৬ বলে ৩৪ রানে অপরাজিত থাকেন তিনি। বল হাতে ম্যাজিকেল স্পেলের পর ব্যাট হাতে সেই অনবদ্য ইনিংসে ম্যাচের নায়ক ছিলেন বিকেল।

সেই ম্যাচে বিশ্বকাপ ইতিহাসের দ্বিতীয় সেরা বোলিং ফিগার নিজের নামের পাশে যোগ করেছিলেন বিকেল। অবশ্য ম্যাগ্রার খর্ব শক্তির নামিবিয়ার বিপক্ষে নেওয়া ৭ উইকেটের চেয়ে পরিস্থিতি আর শক্তিমত্তা বিবেচনায় ঢের এগিয়েই থাকবে ইংলিশদের বিপক্ষে বিকেলের নেওয়া ৭ উইকেট।

সুযোগ পেয়ে বিশ্বকাপের মঞ্চটা নিজের আলোয় রাঙান বিকেল। ওই বছরই তিনি ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বেশি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেন। বোলিংয়ে পাশাপাশি ব্যাটিংয়েও ছিলেন বেশ উজ্জ্বল। যদিও ২০০৩ সাল যেনো বিকেলের ক্যারিয়ারে ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। টেস্টেও সুযোগ পেয়েছিলেন ৯ ম্যাচে! অবশ্য ওই মৌসুমে গিলেস্পি বেশ লম্বা সময় বাইরে ছিলেন কিনা তাই বলেই। গিলেস্পির ইনজুরিটাই ক্যারিয়ারে আশির্বাদ রুপে পেয়েছিলেন বিকেল।

২০০৪-০৫ মৌসুমে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার (সিএ) কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে বাদ পড়েন অ্যান্ডি বিকেল। তবে ঘরোয়া ক্রিকেটে ছিলেন অদম্য! ২০০৫-০৬ মৌসুমে ৩৫ বছর বয়সে পিউরা কাপের বর্ষসেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন তিনি। প্রায় ৩৫ গড়ে ৪৬৫ রান বল হাতে ৫০ উইকেট শিকার করেন এই পেস অলরাউন্ডার। এছাড়া শেফিল্ড শিল্ড টুর্নামেন্টে তিন মৌসুম মিলিয়ে শিকার করেন ১৫৫ উইকেট!

২০০৬-০৭ মৌসুমে বল হাতে নিয়েছিলেন ৪৫ উইকেট, যার মধ্যে ৫৪ রানে ৭ উইকেটও নেন তিনি! দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পরেও ফিরতে পারেননি জাতীয় দলে। তবে ২০০৭ সালে কাঁধের ইনজুরিতে ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায় বিকেলের। অস্ত্রোপচার হলেও ইনজুরি থেকে পুরোপুরি বের না হতে পারায় ২০০৯ সালে ক্রিকেটকে বিদায় জানান এই বোলিং অলরাউন্ডার।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৬৭ ওয়ানডে ম্যাচে ৪৭১ রান আর বল হাতে ৭৮ উইকেট। ১৯ টেস্টে ৩৫৫ রান আর ব্যাট হাতে ৫৮ উইকেট। সাত বছরের ছোট্ট ক্যারিয়ারে সময়ের হিসেবে অনেকটা খেলে ফেলেছেন। পরিসংখ্যানের মাপকাঠি দিয়ে বিচার করলে অ্যান্ডি বিকেল নিতান্তই সাদামাটা একজন। কিন্তু তিনি যে ম্যাচের পর ম্যাচ ছিলেন উপেক্ষিত। প্রতিভা আর সামর্থ্যের সবটা থাকা সত্ত্বেও টিম কম্বিনেশনের গ্যাড়াকলে পিষ্ট হয়ে যায় তাঁর স্বপ্নের ক্যারিয়ার।

হয়তো ভুল সময়ে জন্মেছিলেন। ফুটবল খেলায় আমরা যেমন সাবস্টিটিউট দেখতে পাই, তেমনি অ্যান্ডি বিকেল ছিলেন ক্রিকেটের সাবস্টিটিউট। ১২তম খেলোয়াড় হিসেবেই তিনি বেশ পরিচিত। কারো ইনজুরিতে তিনিই দলের সম্পদ, আবার সবাই ফিট তো তিনিই দলের বোঝা! এভাবে সাত বছরের ক্যারিয়ারে নি:স্তব্ধতার মাঝেই শেষ হয়ে যায় বিকেলের ক্যারিয়ার!

তিনি ছিলেন শেষ বিকেলের আলো, ক্ষণিকের জন্য এসে হারিয়ে গেছেন দ্রুতই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link