তিনি হয়তো সে ভাবে ক্রিকেট মেধায় পরিপূর্ণ ছিলেন না। ব্যাট হাতে অনেক সীমাবদ্ধতার জায়গা ছিল তাঁর। তবে বাইশ গজে নামতেন এক অদম্য সাহস নিয়ে। বুক উঁচিয়ে, প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে লড়াইটা করতে জানতেন। হেলমেট পূর্ববর্তী যুগে ক্রিকেট মাঠে আক্ষরিক অর্থেই রক্তাক্ত হয়েছিলেন তিনি। তবুও অংশুমান গায়কোয়াড় সবসময় জড়িয়ে থাকতে চেয়েছেন ক্রিকেটের সাথেই।
১৯৫২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর এক ক্রিকেটীয় পরিবারেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন গায়কোয়াড়। বাবা দত্ত গায়কোয়াড় ও প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছেন বারোডার হয়ে। পরবর্তীকালে অংশুমানের ছেলেও বারোডার হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেছে। তবে অংশুমানই একমাত্র নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। ভারতের হয়ে টেস্ট ও ওয়ানডে দুই ফরম্যাটেই খেলেছেন এই ব্যাটসম্যান।
অংশুমান গায়কোয়াড় মূলত পরিচিত ছিলেন তাঁর সাহসী ব্যাটিং এর জন্য। তাঁর সময়ে ক্রিকেট বিশ্বে দাপিয়ে বেড়াত ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেসাররা। তাদেরকেও সাহসের সাথে খেলতেন গায়কোয়াড়। টেস্ট ক্রিকেটে দারুণ ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি।
‘দ্য গ্রেট ওয়াল’ বললেই ক্রিকেটপ্রেমীদের সামনে ভেসে আসে রাহুল দ্রাবিড়ের ছবি। তবে এর অনেক আগেই ভারতের ক্রিকেটে আরেকজন ওয়াল এসেছিলেন। টেস্টে তাঁর রক্ষনাত্মক ব্যাটিং এর জন্য পরিচিত ছিলেন দ্য গ্রেট ওয়াল নামে। বিশেষ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেসারদের সামলানোর কারণেই বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
অংশুমান গায়কোয়াড় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষিক্ত হয়েছিলেন ১৯৭৪ সালে। ইডেন গার্ডেন্সে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে একটি টেস্ট ম্যাচে। এরপর টেস্ট ক্রিকেটে ভারতের ব্যাটিং লাইন আপের এক ভরসার নাম হয়ে উঠেছিলেন তিনি। বিশেষ করে কঠিন সময়ে, কঠিন কন্ডিশনে ভারতের অনেক টেস্ট বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
পাকিস্তানের বিপক্ষেও এমন এক ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। সেই টেস্টে আগে ব্যাট করতে নেমে ৩৩৭ রানে বোর্ডে জমা করেছিল পাকিস্তান। জবাবে ভারতের শুরুটা খুব একটা ভালো হয়নি। দ্রুতই উইকেট পড়ে যেতে থাকে। তবে সেই সময় ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন দ্য গ্রেট ওয়াল অংশুমান গায়কোয়াড়।
৪৩৬ বল ব্যাট করে করেছিলেন ২০১ রান। সেই ইনিংসে তিনি ব্যাট করেছিলেন মোট ৬৭১ মিনিট। যা প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের ইতিহাসেই সবচেয়ে ধীর গতির ডাবল সেঞ্চুরি। তাঁর এই বিখ্যাত ইনিংসে ভর করে ম্যাচ ড্র করেছিল ভারত।
ব্যাট হাতে একবার প্রায় মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিলেন এই ব্যাটসম্যান। সেই সময় সেফটির জন্য হেলমেট কিংবা এত গার্ডস ছিল না। ১৯৭৬ সালে জ্যামাইকাতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এক টেস্ট ম্যাচের কথা। সেখানে ৮১ রানে ব্যাট করছিলেন অংশুমান। সেই সময় মাইকেল হোল্ডিং এর একটি বাউন্সার একদম তাঁর কানে এসে লাগে।
রক্তাক্ত হয় বাইশ গজ। সেখান থেকে সাথে সাথে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। টানা দুদিন ভর্তি ছিলেন আইসিইউতে। সৌভাগ্যবশত কয়েকটি অপারেশনের পর আবার সুস্থ হয়ে ফিরেছিলেন তিনি। তবে বাকি জীবন পোহাতে হয়েছে কানের নানা সমস্যা।
আবার মাঠে ফিরে ভারতের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছেন ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত। দেশটির হয়ে খেলেছেন মোট ৪০ টি টেস্ট ও ১৪ টি ওয়ানডে ম্যাচ। তাঁর অভিষেক হয়েছিল কলকাতায়, ১৯৮৪ সালে শেষ টেস্ট ম্যাচটিও কলকাতায় খেলেছিলেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। সবমিলিয়ে ৪০ টেস্টে ৩০.০৭ গড়ে করেছেন ১৯৮৫ রান। সাথে আছে ২ টি সেঞ্চুরি ও ১০ টি হাফ-সেঞ্চুরি। ওদিকে ১৫ ওয়ানডে মাচেও করেছেন ২৬৯ রান। সেখানে আছে একটি হাফ-সেঞ্চুরি।
ওদিকে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও ছিলেন দারুণ সফল। ২০৬ ম্যাচে ৪১.৫৬ গড়ে করেছিলেন ১২ হাজারের বেশি রান। এছাড়া বল হাতেও আছে ১৪৩ উইকেট। নিজের শেষ প্রথম শ্রেণির ম্যাচেও করেছিলেন সেঞ্চুরি।
ক্রিকেটকে বিদায় জনানোর পরেও জড়িয়ে ছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটের সাথেই। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত কাজ করেছেন নির্বাচক হিসেবে। এরপর ১৯৯৭ সালে ভারতের প্রধান কোচের দায়িত্বও পালন করেছেন। তবে ১৯৯৯ বিশ্বকাপের ব্যর্থতার পর তিনি আর কোচ হিসেবে ছিলেন না। তবে এরপর আবার কয়েক মাসের জন্য দ্বিতীয় দফায় ভারতের কোচ হয়েছিলেন। পরে জন রাইট দায়িত্ব নিলে তিনি সরে আসেন।
সবমিলিয়ে ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসে তিনি এক কিংবদন্তিই বটে। যিনি দেশটির ক্রিকেটকে পরিচয় করিয়েছেন অদম্য সাহসের সাথে। বিশ্বের সেরা পেসারদের চোখে চোখ রেখে লড়াই করতে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন ফিরে আসার লড়াইয়ে।