‘অভিমানী’ এক অবিচল চরিত্র

বাংলাদেশের ক্রিকেট তখন সবেমাত্র বাইশগজে দাঁড়াতে শিখেছে। সেসময় ক্রিকেট দুনিয়ার এই শিশুর হয়ে ব্যাট করতে এসেছিলেন সতেরো বছর বয়সের কিশোর। খেলাটির সবচেয়ে পুরনো ও কঠিন মৌসুম, ইংলিশ গ্রীষ্ম। সাপের মতো ফণা তোলা সুইং, সবুজ গালিচার মতো ২২ গজ, সম্পূর্ণ অচেনা-অজানা কন্ডিশন; সেই কিশোরকে ভয় লাগাতে পারে না কিছুই।

তাবৎ ক্রিকেট পন্ডিতের হতবাক চোখে মুগ্ধতার পরশ বুলিয়ে কিশোরটি প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন লাল-সবুজের। জিওফ্রে বয়কট সেসময় বলেছিলেন, ‘আরে! ছোকরার টেকনিক তো জবরদস্ত!’ সেদিনের সেই কিশোরকে চিনতে ভুল হওয়ার কথা নয় – তিনি মুশফিকুর রহিম।

মুশফিকুর রহিমের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শুরুটাই হয় ভুল বোঝাবুঝি দিয়ে। ২০০৫ সাল আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু করার সময় সমর্থকদের অনেকে মেনে নিতে পারেনি তাকে। সবাই ভেবেছিল তৎকালীন উইকেট কিপার ব্যাটসম্যান খালেদ মাসুদ পাইলট’কে সরাতেই নির্বাচকদের এই হেয়ালি। কিন্তু ইংল্যান্ডে নিজের অভিষেক সফরে এসেক্স ও নর্দাম্পটনশায়ারের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে ৬৩ ও ১১৫ রানের দুই ইনিংস খেলে নিজকে নিয়ে ওঠা সমালোচনার জবাব দেন মুশফিক।

সেবার জবাবটা দিয়েছেন ঠিকই তবে বাংলাদেশের জার্সি গায়ে জড়ানোর এতগুলো বছর পরও মুশফিকের সাথে ভুল বোঝার সেই প্রথা রয়েই গেছে। আর আবেগী মুশফিক সমালোচনা থামাতে গিয়ে করেছেন উদ্ভট কাজ, তাতে আরও বেড়েছে সমালোচনা। সেটা কখনো সমর্থকদের কাছে, কখনো গণমাধ্যমে, আবার কখনো নিজের বোর্ডের কাছেও।

তবে এত এত সমালোচনার ভিড়েও বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম সেরা আবিষ্কার যে মুশফিকুর রহিম সেটি বলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। প্রতিভার চেয়ে পরিশ্রমের দিকেই বেশি নজর তার। নি:সন্দেহে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ঘাম ঝরানো ক্রিকেটার তিনি।

দাঁতে দাঁত চেপে স্ট্যাম্পের সামনে বাইশ গজের পিচটায় লড়ে যান তিনি। অভিজ্ঞ চোখ তার শ্যাডো প্র্যাকটিস দেখলেই বলে দিতে পারে তিনি অনন্য। দুই চারটে বল খেলতে দেখলেই নিশ্চিতভাবেই বলা যাবে, হি ইজ ওয়ান অব দ্য বেস্ট। হ্যাঁ মুশফিকুর রহিম খাঁটি সোনা বটে। মুশির কোচ জেমি সিডন্স অকপটেই বলেছিলেন, ‘হি ইজ দ্য গোল্ডেন বয় অফ বাংলাদেশ।’

১.৬ মিটার উচ্চতার ছোটখাটো একজন মানুষ মুশফিক, অথচ দীর্ঘদেহী সব ফাস্ট বোলারকে অনায়াসে দেখিয়ে দেন সীমানার পথ। তার ডিপ মিড উইকেট দিয়ে মারা বাউন্ডারীগুলো কত আনন্দের উপলক্ষ্য এনে দিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেটে! তার ভয়ডর নেই, আছে সাহস, আছে ব্যক্তিত্ব।

টেস্টে তিন-তিনটে দ্বিশতক যার দুইটি আবার উইকেট কিপার হিসেবে; শেষ পাঁচ বছরে টেস্ট বা ওয়ানডে, দুই বিভাগেই রান করেছেন চল্লিশোর্ধ্ব গড়ে; নিজের চার নম্বর পজিশনে বিশ্বসেরাদের একজন তিনি; বাংলাদেশ ক্রিকেটের সর্বোচ্চ পাঁচটি জুটির চারটিতেই আছেন, আছেন ওয়েলিংটনের ক্ল্যাসিক ৩৫৯ রানের জুটিতে; তৃতীয়-চতুর্থ-পঞ্চম-ষষ্ঠ-অষ্টম টেস্ট উইকেটের সর্বোচ্চ জুটিতেও একটা অংশ মুশফিকের দখলে।

মিডল অর্ডারে মুশফিকের উপস্থিতি মানেই একটু বাড়তি নির্ভরতা। হুট করে টপ অর্ডার ভেঙে পড়লেও আশা রাখা যায় কেউ একজন আসবেন গুটি গুটি পায়ে, আবার নতুন করে গড়ে তুলবেন বাংলার ব্যাটিংদুর্গ।

উইকেটের সামনের মুশফিককে নিয়ে প্রশ্ন নেই, তবে প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দেয়া যায় উইকেটের পিছনে দাঁড়ানো মুশফিকের পরিসংখ্যানের উপর। দেশের হয়ে সর্ব্বোচ্চ ডিসমিসালধারী মুশফিক, অথচ দেশসেরা উইকেট কিপারের তকমা পাওয়া হয়নি তার। শিশুতোষ ভুলে বারবার হয়েছেন খবরের শিরোনাম।

তবে গ্লাভস হাতে দাঁড়ানোর কারনটা নিশ্চিতভাবেই মুশফিকের ‘খেলার প্রতি নিবেদন’। সর্বোচ্চ উপায়ে দলকে সার্ভ করতে চান তিনি। উইকেটের পেছন থেকে খেলাটাকে ‘রীড’ করে কাজে লাগাতে চান ব্যাটিংয়ের সময়ে। তবে মুশফিক কিপিং ছাড়লেই বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভালো। একটু জটিল প্রক্রিয়ায় হলেও তিনি মেনে নিয়েছেন সেটা। টেস্টে এখন আর তিনি গ্লাভস হাতে নামেন না, টি-টোয়েন্টিতেও অনিয়মিত।

কলম্বোতে ২১৪ রানের পাহাড় টপকানো কিংবা দুর্ভেদ্য ভারতের দিল্লি জয়; ‘মাসল পাওয়ার’ এর অভাবে টি-টোয়েন্টিতে অপাংক্তেয় মুশফিকের এই ফরম্যাটেও আছে কিছু কাব্যিক গল্প। তারপরও টি-টোয়েন্টির মারকাটারি ব্যাটিংয়ে কিছুটা বেমানান মুশফিক। তবে টেস্ট আর ওয়ানডেতে বদলে যায় দৃশ্যপট, এই দুই ফরম্যাটে ব্যাটসম্যান মুশফিক দেশসেরাই বটে।

লম্বা এক ক্যারিয়ারে অনেক চাপের সামনে দাঁড়াতে হয়েছিল মুশফিককে। কখনো নিদারুণ দক্ষতায় সামলেছেন সেসব, কখনো বা হেরে গেছেন। তবে মুশফিক কখনো পিছন ফিরে আসেননি। বাংলাদেশ ক্রিকেট মুখ থুবড়ে পড়লে এগিয়ে এসেছেন তিনি, কাঁধে তুলে নিয়েছেন দলকে। বাংলাদেশের মিস্টার ডিপেন্ডেবল বড্ড অভিমানী আর আবেগী। তবে নিজের লড়াইয়ের মঞ্চটা ভালো বোঝেন তিনি, জানেন কিভাবে ধ্বংসস্তুপে দাঁড়িয়েও প্রতিরোধ গড়তে হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link