১.
চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামের বাইরে তখন ম্যাচ জয়ের আনন্দে নাচ শুরু করেছেন শাহরুখ খান। সাল ২০০৮। প্রথম ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) প্রথম ম্যাচে ব্যাঙ্গালুরুকে পর্যুদস্ত করার পরের চিত্র। একঝাঁক পুলিশ ঘিরে আছে শাহরুখ খানকে।
দূরে এক ছেঁড়া ময়লা জিন্স পড়া যুবক নাচতে নাচতে চেষ্টা করছে শাহরুখের কাছে আসার। আসতে দিচ্ছে না পুলিশ। শাহরুখ বলে উঠলেন, ‘উসকো আনে দো। হিরো হ্যায় মেরা!’ সেই যুবক ওই ম্যাচে দু’টি উইকেট নিয়েছিলেন, তার মধ্যে একজনের স্টাম্প উড়িয়ে দিয়েছিলেন যার নাম – বিরাট কোহলি।
২.
জীবনের প্রথম ম্যাচ। ছেঁড়া জিন্স সরে গিয়ে সেই বাঙালির গায়ে ‘২’ নম্বর নীল জার্সি। একটা শর্ট বল দিল শ্রীলঙ্কার বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যানকে, ব্যাটসম্যানটা ততক্ষণে বোলারদের পিটিয়ে স্কোরবোর্ড ছোটাচ্ছে বুলেটের মতো। শর্ট বলটা মারার চেষ্টা করলেন। গতি একটু কম থাকায়, বল গিয়ে পড়ল ফিল্ডারের হাতে। প্রথম আন্তর্জাতিক উইকেট। ব্যাটসম্যানটির নাম – সনাথ জয়াসুরিয়া।
ময়নাগ্রামের ধান ঝাড়া এক যুবক চোখভরা স্বপ্ন নিয়ে পা রেখেছিল কলকাতায়। আশ্রয়হীন কলকাতায় অতুল দেব বর্মণের বাড়িতে পড়ে থেকে স্বপ্ন দেখত নীল জার্সির। কিন্তু স্বপ্নেও ভাবেনি এই ভূভারত তাঁর ছেঁড়া বুটজোড়া ফিরিয়ে দেবে ‘ডিন্ডা অ্যাকাডেমি অব বোলারস’ নামক ট্রলের শ্লেষ দিয়ে।
স্যোশাল মিডিয়ার বিষাক্ত তীরগুলো প্রতিক্ষণে সব থেকে যে বাঙালিকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়, তাঁর নাম হয়তো অশোক ভীমচন্দ্র ডিন্ডা। অথচ কেউ খোঁজ নেয়নি ধান ঝাড়া মাটি থেকে ২২ গজের সবুজে পপিং ক্রিজের ঠিক আগে একটা ক্ষুধার্ত তামাটে শরীরের চকিত স্পট জাম্প দিয়ে ১৪০ কেপিএইচ-এর এক একটা বুলেট ছুঁড়তে কত দম লাগে।
স্যোশাল মিডিয়া খুব স্বস্তা করে দেয় সংগ্রামকে, আর দামী করে দেয় পরিসংখ্যানকে। ভাগ্যিস, জহির খান কিংবা জাভাগাল শ্রীনাথের সময় স্যোশাল মিডিয়া ছিল না, না হলে কে বলতে পারে ২০০৩ সালে ফাইনালের পর আর কোনোদিনও হয়তো কামব্যাক করতে পারতেন না একজন জহির খান।
সেই চিন্নাস্বামীর বাইরে শাহরুখের কাছে ঘেঁষতে না দেওয়াটা যেন প্রতীকী হয়েই রয়ে গেল অশোক ভীমচন্দ্র ডিন্ডার, যার সৌরভ গাঙ্গুলির অধিনায়কত্বে মুম্বাইকে ১০১ রানে থামিয়ে দিয়ে ধ্বংসাত্মক ৪-১৮, কিংবা ধোনির অধিনায়কত্বে শেষ ওভারের দুর্দান্ত স্পেলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জয় এনে দেওয়া ৩-৩৯ মনে রাখা হয়না, শুধু মনে রাখা হয় এক ওভারে ৩০ রান দেবার রেকর্ড,অথবা ক্রিস গেইলের বিপক্ষে ওভারে ২৬।
খুঁত তো ছিলই। ইনস্যুইং, আউটস্যুইং, রিভার্স স্যুইং কিংবা ইয়র্কারের পাঠগুলো না আওড়ে, তিনি পড়েছিলেন মান্ধাতা আমলের ‘স্ট্রাক অন দ্য পিচ’-এর লেসনগুলোতে। তবুও তাঁর জীবনে উইকেটগুলো ছিল এক গামলা দুধ। রঞ্জিতে বাংলার হয়ে ৪০০ এর বেশি। আইপিএলে উইকেটের সূত্রে দু’দুবার ম্যান অব দ্য ম্যাচ, চাহাল-চাহারের অনেক অনেক আগে টি-টোয়েন্টিতে এক ম্যাচে সর্বাধিক উইকেট নেওয়া প্রথম ভারতীয়।
আর ওভারে রান দেওয়াটা ছিল এক কচলা লেবু, যা সারাজীবনের মতো নষ্ট করেদিয়েছিল তাঁর ক্যারিয়ারকে। ছেঁড়া বুটের জন্য কতবার প্র্যাকটিস করতে পারেননি, ডাক্তার কাঁধের চোটের জন্য বলে দিয়েছিল আর বল করতে পারবেন না, তবুও ফিরে এসেছিলেন, বাংলার বোলিংকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
রঞ্জি যারা ফলো করেন না, তাঁরা বাংলার পিচে দিন্দার গুরুত্ব বুঝবেন না।
২০১৩ সাল। বিজয় হাজারের সেমি ফাইনালে মুখোমুখি তামিলনাড়ু ও বাংলা। সেবার দীনেশ কার্তিক, মুরালী বিজয়দের শেষ করে দিয়েছিল যে দু’জন, তাদের একজন আজ ভারতের গোলাপ, আর একজন সবার পরিত্যক্ত পলাশ। মোহাম্মদ শামি আর অশোক ডিন্ডা।
প্রোটিয়া কিংবদন্তি অ্যালান ডোনাল্ড তখন পুনের বোলিং কোচ। দিন্দাকে বলেছিলেন, ‘বেস্ট ডেথ বোলার!’ আর দেখুন কিছু অবজ্ঞা আর কাঁধে রাখা একটা হাতের অভাবে, সেটা হয়ে উঠলো – ‘ডেথ অব বেস্ট’!
আসলে জহির সেদিন তাঁর কাঁধের উপর একটা বাঙালির হাত পেয়েছিলেন, তার দশ বছর পরে কাঁধের উপর একজোড়া রাজপুত হাত পেয়েছিলেন ঈশান্ত শর্মা, ভুবনেশ্বর কুমার কিংবা মোহিত শর্মারাও। কিন্তু, সবার বর্জিত কিংশুক বা পলাশ ফুলের মতো সেটা পেলেন না শুধু ডিন্ডা।
আসলে পলাশকে কেউ স্পর্শ করে না, শুধু রঙ দেখে তার শুধু। অনেক বেশি কিছু বলে ফেললাম, আসুন আবার ট্রল করে বুটের তলায় পিষে ফেলি এক গ্রাম্য বালকের ঘামে ভেজা স্বপ্নের ‘ছেঁড়া তার’ গুলোকে, যিনি গত দশ বছর ধরে বাংলার বোলিংয়ে লড়ে যাওয়া এক পার্শ্বচরিত্র হয়ে রয়েছেন।
আসলে কখনও কখনও ‘নায়ক’ এর থেকে পার্শ্বচরিত্ররা বেশি দাগ কাটে!