আক্রমণ ও রক্ষণের ভারসাম্যই জীবন

লোকটাকে ১৮ বছর ৯ মাস বয়সে হঠাৎ উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল নিউজিল্যান্ডে, ভারতের হয়ে টেস্ট খেলতে।

শোনা যায়, এই উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার পিছনে ছিলেন তখনকার এক বিখ্যাত মুম্বাইকার। লোকটা ওই বয়সে সেই আচমকা উড়িয়ে নিয়ে যাওয়াকে সম্মান দিয়েছিলেন তার বাঁ-হাতি ট্র্যাডিশনাল অফস্পিন বোলিং দিয়ে, ৩ ম্যাচের টেস্ট সিরিজে ১৫টি উইকেট নিয়ে।

ব্যাটে আহামরি কিছু করেননি সেবার লোকটা। শেষের দিকে ব্যাট করতে এসে ৫ ইনিংসে দুবার অপরাজিত থেকে মোট মাত্র ৪৮ রান করেছিলেন তিনি। তবু আর পিছনে ফিরে দেখতে হয়নি তাঁকে পরের ১১ বছর। তারপরে লোকটা আলট্রা ডিফেন্সিভ ব্যাটিংয়ে নিজেকে মুড়ে ফেলায় ধার দিয়ে গেছেন, আক্রমণাত্মক স্পিন বোলিংয়ের সঙ্গে সঙ্গেই।

পরে যত ক্যারিয়ার এগিয়েছে, লোকটার মতই লোকটার ব্যাটও ততই বেশি বেশি আক্রমণে গেছে যার ফল লোকটার সম্মানজনক অলরাউন্ড টেস্ট আর ওয়ানডে ক্যারিয়ার। লোকটা তার ১১টা টেস্ট শতকের সাতটাই অর্জন করেছিলেন বিদেশের মাঠে, সিডনির ২০৬-সহ।

১৯৮১’র ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৯২’র ২৬ ডিসেম্বর, লোকটা ৮০টা টেস্ট খেলে ৩৫.৭৯ গড়ে ১টি ২০০+ সহ (সিডনির ২০৬) করেছিলেন ৩৮৩০ রান (১১X১০০, ১২X৫০), বলে নিয়েছিলেন ১৫১ উইকেট, ৪০.৯৬ গড়ে। লোকটার টেস্টে ইনিংসে ৫ উইকেট ছিল দুবার, সেরা বোলিং ছিল ৫/৭৫। টেস্টে ৩৬টা ক্যাচ নিয়েছিলেন বিশ্বস্ত ফিল্ডার ওই লোকটা।

আর ১৯৮১’র ২৫ নভেম্বর থেকে ১৯৯২’র ১৭ ডিসেম্বর, লোকটা ১৫০ ওয়ানডে খেলে ২৯.০৪ গড়ে করেছিলেন ৩১০৮ রান (৪X১০০, ১৮X৫০), বলে নিয়েছিলেন ১২৯ উইকেট, ৩৬.০৪ গড়ে। লোকটার ওয়ানডেতে ইনিংসে ৫ উইকেট ছিল ১বার, সেরা বোলিং ছিল ৫/১৫।

৪০টা ওয়ানডে ক্যাচও নিয়েছিলেন লোকটা। লোকটার প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে রেকর্ডও ছিল বেশ ভালো, ১৭ বছর বয়সে মুম্বাই রণজি টিমের সদস্য হয়েছিলেন লোকটা। রণজি ট্রফিতে বরোদার তিলকরাজকে ৬ বলে ৬টা ৬ মেরেছিলেন ওই লোকটা, যা তখন গোটা বিশ্বর স্বীকৃত ক্রিকেটে সোবার্স ছাড়া আর কেউ করে দেখাতে পারেন নি।

নরেন্দ্র হিরওয়ানিখ্যাত চেন্নাই টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ভারতের অধিনায়কও ছিলেন ওই লোকটা। আর সানি, কপিল, বেঙ্গসরকার, শ্রীকান্ত, আজহার, সবার ডেপুটি ছিলেন লোকটা, ভারতীয় দলে। ভারতের ১৯৮৫র বেনসন হেজেস ট্রফি জেতায় অনেকটাই অবদান ছিল এই লোকটার, ব্যাটে ১৮২ রান করে আর বলে ৮ উইকেট নিয়ে। বেনসন হেজেস ট্রফিতে ‘প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্ট’ হয়ে অডিগাড়িও জিতেছিলেন ওই লোকটাই, যাতে মাঠেই উঠে পড়েছিল পুরো টিম। ১৯৮৩’র বিশ্বকাপজয়ী ভারত দলেও ১৪ জনের স্কোয়াডে ছিলেন লোকটা।

‘খারুশ’ মানসিকতার আদি কর্ণাটকী পরে মুম্বাইকার লোকটা জীবনে ‘মাচো’ আর ফ্ল্যামবয়েন্ট ছিলেন সবসময়। সব সময় পড়ে গেলেও তিনি নিজেই উঠে দাঁড়িয়েছেন হতাশা ঝেড়ে, যাকে বলে ‘গিরে ভি তো টাং উপর’।

খেলা ছেড়ে, তিন বছর পরে ১৯৯৫ থেকে কমেন্ট্রিতে গিয়ে প্রেস বক্সে সুপারডুপার হিট ছিলেন লোকটা, তার ক্ষুরধার ক্রিকেট বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে।তারপরে কমেন্ট্রি ছেড়ে ২০১৭-তে ভারতের কোচ হয়েছিলেন এবং ওই তীক্ষ্ণ ক্রিকেট প্রজ্ঞা আর অবিশ্বাস্য ম্যানেজমেন্টের কল্যাণে গত তিন বছর সেই ভূমিকাতেও বুক চিতিয়ে বিচরণ করেছেন, দুবার (২০১৮-১৯ আর ২০২০-২১) অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে তাদের হারানো-সহ।

সেই বিচরণে আপাতত লোকটার শেষ চাঁদমারি আগামী জুনে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল ম্যাচ, কিউয়িদের বিরুদ্ধে, যাদের বিরুদ্ধে তিনি শুরু করেছিলেন তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। আসলে অলরাউন্ডারেরও অলরাউন্ডার এই লোকটা। একটুর জন্য অনেক কিছু হয়না, এই লোকটার কোচিংয়ে যেমন একটুর জন্য বিশ্বকাপ জেতেনি ভারত, ২০১৯ সালের জুলাইয়ে।

কারুর সঙ্গে কোনদিন কোন ঝামেলা দীর্ঘস্থায়ী হতে দেননি লোকটা। যে পাত্রে রাখা হয়েছে, সেখানেই জলের মত মানিয়ে নিয়েছেন লোকটা, নিজের টার্মে।সানি, কপিল, আজহার, শ্রীকান্ত থেকে কুম্বলে, শচীন, সৌরভ, রাহুল হয়ে আজকের বিরাট, রোহিত, রাহানে, ঋষাভ পান্ত – সবাই এর সাক্ষী।

এমনকি বিসিসিআই-ও জানে সেকথা। নিজের সীমানা ভালো করে চেনা লোকটা সেই সীমানার মধ্যেই সাম্রাজ্য রেখেছেন আজীবন, কোথাও অনুপ্রবেশ না করে, সব পাওয়ার পিছনে না ছুটে। একসময়ের প্রায় ১৯ লোকটার কাঁধে এখন বয়সের হাত, তবু আজও একইরকম বিন্দাস থেকে গেছেন একদা ভারতীয় ক্রিকেটের পিনআপ বয় লোকটা, চিরদিন ক্রিকেটের আর জীবনের পিচ বুঝে আক্রমণ আর রক্ষণকে ভারসাম্য করে মিশিয়ে যাওয়া লোকটা। সিনিয়র সিটিজেন হতে চলা সেই লোকটার নাম রবিশঙ্কর জয়াধৃত শাস্ত্রী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link