২৫ মে ২০০৭। মিরপুরে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে মুখোমুখি ভারত ও বাংলাদেশ। মিরপুরের মাটিতে অভিষেক। সমর্থক সহ সবার মাঝেই তাই বাড়তি উত্তেজনা। তবে সেই উত্তেজনা ম্লান হয়ে যায় প্রথম দিনেই। ভারতের চার ব্যাটারের প্রতাপে অসহায় আত্মসমর্পণ করে বাংলাদেশের বোলাররা। কোনো উইকেট না হারালেও সেদিন চার ব্যাটার ব্যাট করে ভারতের।
অবশ্য ভারতকে হাতে ধরে সুযোগটা দিয়েছিলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক হাবিবুল বাশার। টসে জিতে নিলেন ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত। দিনশেষে এই সিদ্ধান্তটাই চরম ভুল প্রমাণিত হল। অবশ্য দিনশেষে নয়, দিনের অর্ধেক যেতেই বোঝা গিয়েছিল বাশার ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পুরো দিন বাংলাদেশের বোলারদের শুধু মাঠের মধ্যে দৌড়িয়েছেন ভারতের ব্যাটাররা।
লাঞ্চ বিরতিতে ভারতের সংগ্রহ বিনা উইকেটে ৬৭। হতে পারত ভিন্ন চিত্র। ভারতের রানের পাশে থাকতো দুই উইকেট! ব্যক্তিগত ১৮ রানে কার্তিকের ক্যাচটা ফেলে দিয়েছিলেন সাকিব আল হাসান। এরপর জাফরের ৪২ রানে রিটার্ন ক্যাচটা লুফে নিতে পারেননি মোহাম্মদ রফিকও। ব্যাস, বাংলাদেশের জন্য দিনের বাকিটা সময় স্রেফ খাটুনির উপর ছিল।
দুই ওপেনার ওয়াসিম জাফর ও দীনেশ কার্তিক ততক্ষণে পুরো সেট। উইকেটে বাংলাদেশের বোলারদের জন্য স্রেফ হতাশা ছাড়া আর কিছুর দেখা মিলছিল না। দ্বিতীয় সেশনটাও স্বাচ্ছন্দ্যেই পার করলো ভারত। দুই ওপেনারই সেঞ্চুরির বেশ কাছাকাছি। তবে চা বিরতির পর খুব বেশি সময় আর খেলতে পারেননি কার্তিক। প্রচণ্ড গরমে পানি শূন্যতায় মাঠ ছাড়লেন এই ওপেনার।
জাফরের সাথে চা বিরতির পর যোগ দিলেন রাহুল দ্রাবিড়। দ্রাবিড়ের সাথে জুটির পথে জাফর তুলে নিলেন ব্যক্তিগত সেঞ্চুরি। একদিকে ভারতীয় সমর্থকদের উল্লাস, আরেকদিকে বাংলাদেশীদের হতাশা। বাংলাদেশের বোলাররা যেন নির্বাক চেয়ে দেখছেন ভারতের ব্যাটিং; কিছুতেই যে দমাতে পারছেন না। দিনের শেষ ভাগে ব্যক্তিগত ১৩৮ রানে অসুস্থ হয়ে ড্রেসিং রুমে ফিরে যান জাফর।
সূর্য যখন অনেকটাই নেমে এসেছে দ্রাবিড়ের সঙ্গি হলেন শচীন টেন্ডুলকার। দু’জনের ব্যাটে বাকি পথটাও হেসেখেলেই পার করলো ভারত। প্রথম দিনশেষে ভারতের সংগ্রহ বিনা উইকেটে ৩২৬।
সেঞ্চুরির দ্বারপ্রান্তে দ্রাবিড়, শচীন সবে থিতু হয়েছেন – এমন অবস্থা নিয়েই দ্বিতীয় দিনের শুরু ভারতের। বাংলাদেশের জন্য আগের রাতটা ছিল নিশ্চয়ই শোচনীয়। দু:স্বপ্ন ভেবেও হয়ত আড়াল করতে পারেনি বিভিষিকাময় প্রথম দিনটা।
২০০৩ সাল, চট্রগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়াম। ঘন্টার পর ঘন্টা ক্রিজে মাটি কামড়ে পড়ে আছেন দুই প্রোটিয়া ব্যাটার জ্যাক রুডলফ ও বোটা ডিপেনার। মাশরাফি বিন মুর্তজা, এনামুল হক জুনিয়র, তাপস বৈশ্যরা ওভারের পর ওভার করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু উইকেটের নাম-নিশানও নাই। আর টিভির পর্দায় চাতক পাখির মত বিরক্তির চোখে তাকিয়ে আছে বাংলাদেশী সমর্থকরা। অপেক্ষা শুধু একটি উইকেটের। প্রতি মুহূর্তেই অপেক্ষা একটি উইকেটের।
কিন্তু না, উইকেটের দেখা মেলেনি। না সমর্থকদের, না বাংলাদেশের বোলারদের। প্রায় দুইদিন বাংলাদেশের বোলারদের ঘাম ছুঁটিয়ে ব্যাটিং করে গেছেন রুডলফ, ডিপেনাররা।
ওই টেস্টে অবশ্য প্রথমে ব্যাট করেছিল বাংলাদেশ। দ্বিতীয় সেশন শেষ হতেই অলআউট বাংলাদেশ। এরপর প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে ৪১ রানে ২ উইকেট হারায় দক্ষিণ আফ্রিকা। এরপর প্রায় দেড়দিন বাংলাদেশী বোলারদের উপর দাপট দেখান রুডলফ, ডিপেনাররা!
ওই টেস্টের অবস্থা খানিকটা ভিন্ন হলেও বাংলাদেশের বোলারদের জন্য একই চিত্র ছিল। মিরপুর টেস্টে প্রথম দিনের শোচনীয় অবস্থা বদলায়নি দ্বিতীয় দিনেও।
দ্বিতীয় দিনের প্রথম ঘন্টায় সেঞ্চুরি তুলে নেন দ্রাবিড়; শচীনও খেলে ফেলেছেন পঞ্চাশোর্ধ ইনিংস। প্রায় আট ঘন্টা খাটনির পর দ্বিতীয় দিনের লাঞ্চ বিরতির আগ মূহুর্ত বাংলাদেশের জন্য সফলতা ধরা দিল। ৪০৮ রানে প্রথম উইকেটের পতন! দ্রাবিড় ফিরলেন ১২৯ রানে। মোহাম্মদ রফিকের বলে এবার আর সুযোগ হাতছাড়া করেননি রাজিন সালেহ।
দ্রাবিড়ের উইকেটটা বাংলাদেশের জন্য চরম দুর্দশার মধ্যেও খানিকটা স্বস্তি; কষ্টদায়ক স্বস্তি বলাই ভাল। শচীনের সাথে দ্বিতীয় উইকেটে যোগ দিলেন কার্তিক। আগের দিনের সেঞ্চুরির আক্ষেপটা মেটালেন দ্বিতীয় দিনে। শচীনের সাথে দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে সেঞ্চুরি তুলে নিলেন কার্তিক; শচীনও তখন সেঞ্চুরির দোরগোড়ায়। মাশরাফি মুর্তজার হাত ধরেই দ্বিতীয় উইকেটের দেখা বাংলাদেশের। আগের দিনও বাকিদের অসহায়ত্বের মাঝেও উইকেটহীন বেশ ভাল বোলিংই করেছিলেন এই পেসার।
চা-বিরতিতে ভারতের রান তখন পাঁচশো পার। রান বন্যার ইনিংসে সৌরভ গাঙ্গুলি ফিরে যান মাত্র ১৫ রানে। তবে শচীন পার করে ফেলেন শত রানের কোটা। মহেন্দ্র সিং ধোনিকে নিয়ে ইনিংসের বাকি পথটা সহজেই পার করেন শচীন। চতুর্থ উইকেটে গড়লেন ৮৫ রানের জুটি। বাংলাদেশের বোলাররা তখন ভারতের পানে তাকিয়ে। কখন হবে ইনিংস ঘোষণা!
দ্বিতীয় দিনের সূর্য যখন অস্তাচলে – বাংলাদেশের বোলারদের জন্য স্বস্তির খবর; ইনিংস ঘোষণা করছে ভারত। শচীনের অপরাজিত ১২২ ও ধোনির পঞ্চাশোর্ধ ইনিংসে ৩ উইকেটে ৬১০ রানে ইনিংস ঘোষণা করে ভারত।
বাংলাদেশের বোলারদের জন্য অসহায়ত্ব শেষ; তবে বাংলাদেশের জন্য না! বোলারদের শেষে এবার অসহায়ত্ব শুরু ব্যাটারদের। দিনের একদম শেষ মুহূর্তে ব্যাট করতে নেমে জহির খানের সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে বাংলাদেশের ব্যাটিং শিবির।
ইনিংসের প্রথম বলেই আউট জাভেদ ওমর বেলিম। পরের দুই ওভারে হাবিবুল বাশার, শাহরিয়ার নাফিস, মোহাম্মদ আশরাফুলরাও প্যাভিলিয়নে। ৭ রানেই নেই বাংলাদেশের ৪ উইকেট। স্কোরের দিকে তাকালে মনে হতে পারে কোনো এই রোমাঞ্চকর ফুটবল ম্যাচ চলছে।
রাজিন সালেহ, সাকিব আল হাসানের ব্যাটে কোনোরকমে প্রতিরোধ গড়ে বাংলাদেশ। পঞ্চম উইকেটে ৩৩ রানের জুটি ভাঙে শেষ বিকেলে অনিল কুম্বলের বলে। ৫৫ রানে ৫ উইকেট নিয়ে দিনটা কোনোরকমে শেষ করেছিল তরুণ সাকিব আর মোহাম্মদ শরিফ।
তৃতীয় দিনে বাংলাদেশ কতক্ষণ টিকবে সেটাই ছিল ভাবনা। দলের অর্ধেক ব্যাটার প্যাভিলিয়নে। প্রথম ইনিংসে না নামতেই যেন দ্বিতীয় ইনিংসের প্রস্তুতিতে সবাই! শক্তিশালী ভারতের সামনে তৃতীয় দিনে ঘন্টা দুয়েকও লড়াই করতে পারেনি বাংলাদেশ। সাকিবের সর্বোচ্চ ৩০ রানের ইনিংসে ১১৮ রানে গুড়িয়ে যায় বাংলাদেশ দল। জহির খান ৫ ও কুম্বলে নেন ৩ উইকেট।
তৃতীয় দিনেই এই টেস্টের ফলাফল আসতে যাচ্ছে সেটা তখন অনুমেয় ছিল। যে উইকেটে ভারতের ব্যাটাররা ঘন্টার পর ঘন্টা শাসন করেছেন বাংলাদেশের বোলারদের – সেই উইকেটেই মাত্র ২ ঘন্টাও টিকতে পারেনি বাংলাদেশের ব্যাটাররা। বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে ৪৯২ রানের লিড পায় ভারত। ভারতের টেস্ট ইতিহাসে প্রথম ইনিংসে এটি সর্বোচ্চ লিডের রেকর্ড!
ফলোঅনের লজ্জা মাথায়, ৪৯২ রান পিছিয়ে; লজ্জাজনক পরাজয় চোখ রাঙাচ্ছে বাংলাদেশের সামনে। তবু হয়ত ঘুরে দাঁড়ানোর বিন্দু আশা নিয়ে আবার ব্যাটিংয়ে নেমেছিল বাংলাদেশ। তবে সেই আশার ছিটেফোঁটাও ছিল না ব্যাটিংয়ে। ইনিংসের প্রথম বলে আবারও গোল্ডেন ডাক জাভেদ ওমর! টেস্ট ইতিহাসের ১৪তম ব্যাটার হিসেবে ‘কিং পেয়ার’ (দুই ইনিংসেই গোল্ডেন ডাক) আউট হন বেলিম (সেই সংখ্যাটা এখন ২২জন)।
পরের দুই ওভারে আউট বাশার ও নাফিস; ঠিক যেন প্রথম ইনিংসের হাইলাইটস দেখছিলেন সমর্থকরা। ১০ রানে নেই ৩ উইকেট। এবার সালেহর সাথে হাল ধরলেন আগের ইনিংসে শূন্য হাতে ফেরা আশরাফুল। হঠাৎ মিরপুরে শুরু আশরাফুল ঝড়। টেস্ট ক্রিকেটে যেন রঙিন পোশাকের অনূভুতি। ভারতীয় বোলারদের উপর পালটা আক্রমণ। ম্যাচ বড় ব্যবধানে হারবেন, ঘুরে দাঁড়ানোর আর সম্ভাবনা নেই; সেটা ভেবেই হয়ত খানিকটা দাপট দেখানোর চেষ্টা।
দলীয় ৯১ রানে যখন আশরাফুল ফিরলেন তখন তার ব্যক্তিগত সংগ্রহ ৪১ বলে ৬৭! ১২ চার ও ২ ছক্কায় একপেশে ম্যাচেও যেন বাংলাদেশের জন্য ছোট্ট প্রাপ্তি। সেখান থেকে ১৫৪ রানে নেই ৭ উইকেট। ভারতের চেয়ে যেন ম্যাচ শেষে করতে বাংলাদেশের তাড়া-ই বেশি। ম্যাচ শেষ হওয়াটা যখন সময়ের ব্যাপার – ব্যাট হাতে শেষ বিকেলে ঝড় তুললেন মাশরাফি।
১৫৪ থেকে বাংলাদেশ অলআউট হল ২৫৩ রানে। মাশরাফি একাই খেললেন ৬৮ বলে ৭০ রানের ঝড়ো ইনিংস। মাশরাফি-আশরাফুলের ঝড়ো ফিফটি ছিল বাংলাদেশের জন্য হতাশা ভর্তি খাতায় খানিকটা প্রাপ্তি। তিন দিন পূর্ণ না হতেই শেষ ঢাকা টেস্ট। ম্যাচ সেরা জহির খান আর সিরিজ সেরার পুরস্কার জেতেন শচীন টেন্ডুলকার।
প্রথম টেস্টে বৃষ্টির কল্যাণেই হয় বেঁচে যায় বাংলাদেশ। ম্যাচটা ড্র তে সমাপ্ত হলেও সেই টেস্টে ভারতের চোখে চোখ রেখেই লড়াই করেছিল মাশরাফি-বেলিমরা। তবে ঢাকা টেস্টের অভিষেকে ভারতের সামনে চোখ জোড়া খুলতেই পারেনি বাংলাদেশ দল।
১-০ তে সিরিজ হার। কোনো দলের প্রথম চার ব্যাটারই এক ইনিংসে সেঞ্চুরি দেখা পাওয়ার প্রথম কীর্তি। দু:স্বপ্নময় তিন দিন আর পাহাড়সম হতাশায় শেষ হয় মিরপুরের অভিষেক টেস্ট।