টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশ পার করছে তাঁদের স্মরণকালের সবচেয়ে বাজে সময়। বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে জয় দিয়ে শুরু করলেও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে যেন অসহায় আত্নসমর্পন টাইগারদের। প্রোটিয়াদের কাছে ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং তিন বিভাগেই পরাস্ত হয়ে বড় ব্যবধানের হারই সঙ্গী হয়েছে সাকিবদের। বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক এবং নির্বাচক হাবিবুল বাশারের মতে বাইরের দেশে টি-টোয়েন্টি লিগুগুলোতে সুযোগ না পাওয়াই কাল হয়েছে বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের জন্য।
বর্তমান সময়টা ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের। যে দেশের ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি লিগ যত উন্নত, সেই দেশের ক্রিকেটারদের টি-টোয়েন্টিতে পারফর্ম করার সম্ভাবনাও তত বেশি। ফ্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি লিগগুলো যেন অন্য সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে তরুণ ক্রিকেটারদের জন্য। বিশ্বসেরা ট্রেনিং সুযোগ-সুবিধা, কোচ কিংবা ক্রিকেটারদের সাথে ড্রেসিং রুমে অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে নেয়া – সবকিছুই একজন ক্রিকেটারকে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ফলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সাথে মানিয়ে নিতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না সেই ক্রিকেটারদের। বিশ্বের অন্যান্য দেশের ক্রিকেটাররা জাতীয় দলের খেলা ব্যতীত বাকি সময়টা ব্যস্ত থাকেন বিশ্বব্যাপী টি-টোয়েন্টি লিগ খেলতে। টি-টোয়েন্টির বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার কথাই ধরুন না, বিশ্বকাপ শেষেই বিগ ব্যাশে নিজেদের ঝালিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন স্মিথ-ফিঞ্চরা। এছাড়া সারাবছর আইপিএল, পিএসএল, সিপিএলের নিয়মিত মুখ তাঁরাই।
অন্যদিকে বাংলাদেশে যেন পুরো বিপরীত অবস্থা। সবেধন নীলমণি এক বিপিএল তাঁর জৌলুস হারিয়েছে আগেই। মানহীন বিদেশি ক্রিকেটার, হোম গ্রাউন্ড কিংবা পর্যাপ্ত ট্রেনিং সুবিধা না থাকায় বিপিএল খেলে কতটুকু লাভবান হচ্ছেন ক্রিকেটাররা সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।
অবশ্য এই সীমাবদ্ধতা সামলেও সফল ক্যারিবীয় ক্রিকেটাররা। নিজেদের লিগ সিপিএল তেমন সুবিধা দিতে না পারলেও সারাবছর আইপিএল-বিগব্যাশের মত টি-টোয়েন্টি লিগে নিয়মিত খেলে নিজেদের ঝালিয়ে নেন তাঁরা। কিন্তু বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের সেই সুযোগটাও কম। কিংবা সুযোগটা পেলেও তাঁদের খেলার আগ্রহ আছে কিনা সেটাও একটা প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অসাধারণ পারফর্ম করে ফ্যাঞ্চাইজি দলগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণও করতে পারছেন না তাঁরা।
একমাত্র সাকিব আল হাসান এবং মুস্তাফিজুর রহমানই নিয়মিত সুযোগ পেয়েছেন বাইরের লিগগুলোতেই। আইপিএলের পাশাপাশি সাকিব খেলেছেন বিগব্যাশ এবং সিপিএলে, অন্যদিকে মুস্তাফিজ সুযোগ পেয়েছিলেন কাউন্টিতেও। মজার ব্যাপার হল, আন্তর্জাতিক টি- টোয়েন্টি ব্যাটে-বলে বাংলাদেশের সেরা পারফর্মার এই দুজনই।
টি-টোয়েন্টিতে গত কয়েক মাস ধরেই ভাঙা-গড়ার মাঝ দিয়েই যাচ্ছে বাংলাদেশ দল। এই ফরম্যাট থেকে অবসর নিয়েছেন দুই অভিজ্ঞ তামিম ইকবাল এবং মুশফিকুর রহিম, বাজে ফর্মের কারণে দল থেকে বাদ পড়েছেন আরেক বর্ষীয়ান মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। লিটন দাস, আফিফ হোসেন, সৌম্য সরকারদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট পাড়ায় আগমনের বছর পাঁচেক কেটে গেলেও তাঁরা নিজেদের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারছেন না।
ঠিক এই জায়গাটাতেই প্রশ্ন ওঠে বিশ্বব্যাপী নিয়মিত টি-টোয়েন্টি খেলার, অন্য দেশের ক্রিকেটাররা যেখানে ফ্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলে নিজেদের পরিণত করেই নামছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে। সেখানে অনেকটাই অপরিণত অবস্থায় মাঠে নামছেন বাংলাদেশের তরুণরা, ফলে পায়ের নিচে শক্ত মাটি খুঁজে পাচ্ছেন না লিটন- আফিফরা। সে কারণেই হাবিবুল বাশার ট্রান্সজিশন পিরিয়ড ছাপিয়ে ব্যর্থতার দায়ভারটা চাপাচ্ছেন ফ্যাঞ্চাইজি লিগ না খেলার উপরেই।
তিনি বলেন, ‘অবশ্যই বাংলাদেশ দল পুর্নগঠন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সিনিয়ররা খেলছে না এবং তাঁরা নিজেদের সেরা ফর্মেও নেই। সত্যি বলতে বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টিতে ধারাবাহিক দল নয়, মাঝেমধ্যে চমক দেখালেও তাঁরা নিয়মিতই সেটা করে দেখাতে পারেনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার আরেকটা কারণ হল ফ্যাঞ্চাইজি লিগগুলোতে নিয়মিত সুযোগ না পাওয়া। কেবল সাকিব এবং মুস্তাফিজই আইপিএল এবং অন্যান্য লিগগুলোতে সুযোগ পেয়ে থাকে। বাংলাদেশি ক্রিকেটাররা কেবল বিপিএল খেললেও অন্যান্য টুর্নামেন্টগুলোতে সুযোগ পায় না।’
বাশারের কথার প্রতিফলন ফুটে ওঠে বাংলাদেশ দলের পারফরম্যান্সেও। বিশ্বের নানা প্রান্তে খেললে নতুন কন্ডিশন, পরিস্থিতি, নতুন সব অভিজ্ঞতা হত ক্রিকেটারদের। ফলে বিদেশের মাটিতে হারার আগেই হেরে বসতো না দল। কিন্তু সেটা না হওয়ায় ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ জিতলেও বাইরের দেশে বড় মঞ্চে হচ্ছে অসহায় আত্নসমর্পণ। ক্রিকেটারদের নিয়মিত ফ্যাঞ্চাইজি লিগে অংশ নেয়া তাই হয়ে দাঁড়িয়েছে সময়ের দাবি, অন্যথায় অসহায় আত্মসমর্পণের দৃশ্যটা আরও নিয়মিত হয়ে উঠবে এ দেশের ক্রিকেটে।