শেষ বল!
প্রয়োজন মাত্র দুই রান! আগের দুই বলেই দুই উইকেট নিয়ে ম্যাচে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে ভারত৷ স্ট্রাইকে তখন জাহানারা আলম। সব আক্ষেপ ঘুচিয়ে বাংলার মেয়েরা কি পারবে ভারতের কাছ থেকে এশিয়া কাপ ছিনিয়ে আনতে?
ভারতের কাছেই যেনো বার বার তীরে গিয়ে তরী ডোবে। এবার কি তরী ঘাটে ভীড়তে পারবে? বল করলেন হারমানপ্রীত কৌর! কিছু সামনে এসে লেগ সাইডে ঠেলে দিয়েই প্রাণপণে ছুটতে লাগলেন জাহানারা! বল কুড়িয়ে ফেরত পাঠাতে পাঠাতে বাংলাদেশ সৃষ্টি করে ফেলেছে ইতিহাস। ভারতকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো জয় করে নিয়েছে এশিয়া কাপের শিরোপা।
সব আক্ষেপ ঘুচিয়ে অবশেষে ঘাটে ভীড়লো বাংলার তরী। ছেলেদের তরীটা বার বার ডুবে গেলেও বাংলার মেয়েরা ডুবতে দেননি! তারা ঘাটে ভিড়িয়েই শিরোপা নিয়ে দেশে ফিরেছে।
১০ জুন, ২০১৮। সে যেনো এক রূপকথার গল্প।
কুয়ালামাপুরে নারী এশিয়া কাপের ফাইনালে ভারতের মুখোমুখি বাংলাদেশী মেয়েরা। পুরো বাংলাদেশী ক্রিকেট ভক্তদের চোখ সেদিন টিভির পর্দায়। এমনকি জাতীয় দলের খেলোয়াড়েরাও মিরপুরে অনুশীলনের মাঝে টিভির সামনে মনযোগ রেখেছিলেন। শুধু একটা স্বপ্ন, একটা মেজর ট্রফি। যেটা ছেলেরা এতো বছরেও পারেনি মেয়েরা কি পারবে? তিনবার এশিয়া কাপের ফাইনালে গিয়েও ট্রফি আনতে পারেনি ছেলেরা৷ এই ব্যর্থতা আড়াল হবার নয়, কিন্তু মেয়েরা কি গড়তে পারবে ইতিহাস?
কিনারা ওভালে টসে জিতে প্রথমে বোলিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশের অধিনায়ক সালমা খাতুন। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে খাদিজাতুল কুবরা আর জাহানারার বোলিং দাপুটে মাত্র ৩২ রানেই ৪ উইকেট হারিয়ে চরম ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে ভারত। মিতালি রাজ, স্মৃতি মান্ধানা, দিপ্তি শর্মা ও অনুজা পাতিলরা ছিলেন আসা যাওয়ার মিছিলে। অনুজা পাতিল অবশ্য ‘অবস্ট্রাক্টিং দ্যা ফিল্ড’ এর কারণে আউট হন। ৩২ রানেই দলের চার ব্যাটসম্যান সাজঘরে! ক্রিজে তখনো ঠায় দাঁড়িয়ে ভারতীয় অধিনায়ক হারমানপ্রেত কৌর।
একে তো তখন ইনিংসে নবম ওভার চলছে, তার উপর দলের চার উইকেট নেই। পঞ্চম উইকেটে বেদা কৃষ্ণামূর্তিকে নিয়ে জুটি গড়েন কৌর। ২৫ বলে ৩০ রানের জুটির পথে ব্যক্তিগত ১১ রানে অধিনায়ক সালমা খাতুনের বলে বোল্ড হয়ে ফেরত যান। ৬২ রানেই দলের অর্ধেক ব্যাটসম্যান প্যাভিলিয়নে! এরপর ১২ রানের মাথায় আউট দলের আরো দুই ব্যাটসম্যান! রুমানা আহমেদের এক ওভারেই তুলে নেন তানিয়া ভাটিয়া ও শিখা পান্ডেকে। ৭৪ রানেই ৭ উইকেট তুলে নিয়ে ম্যাচে তখন আধিপত্য বাংলার মেয়েদের।
ইনিংসের বাকি মাত্র ৫ ওভার, হাতে মাত্র ৩ উইকেট। ফাইনালের মতো মঞ্চে ভারতের এমন অবস্থায় দলের সব ভরসা তখন অধিনায়ক কৌরের উপর। ঝুলন গোস্বামিকে নিয়ে ৮ম উইকেট কৌর জুড়ে দিলেন ২৫ বলে ৩৫ রানের জুটি। সেই সাথে তুলে নিলেন ব্যক্তিগত হাফ সেঞ্চুরি। তখন ইনিংসের শেষ ওভারে খাদিজাতুল কুবরার প্রথম বলেই রান আউট হন ঝুলন! আর শেষ বলে আউট হবার আগে ওই ওভার থেকে আরো পাঁচ রান যোগ করেন কৌর।
নির্ধারিত ২০ ওভারে ৯ উইকেটে ১১২ রানের লড়াকু সংগ্রহ করে ভারত নারী দল। ৪২ বলে ৭ চারে সর্বোচ্চ ৫৬ রান করেন হারমানপ্রেত কৌর। দলের প্রায় অর্ধেক রানই আসে তার ব্যাট থেকে। বাংলাদেশের পক্ষে ৪ ওভারে ২৩ রানে খাদিজাতুল কুবরা আর ৪ ওভারে ২২ রান রুমানা নেন ২ টি করে উইকেট। ভারতের বোলিং আর অভিজ্ঞতার সামনে এই স্কোর নেহাৎ কমও নয়। অপরদিকে, বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপও খুব শক্তিশালী না।
জবাবে ১২৩ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে ধীরে সুস্থেই শুরু করেন বাংলাদেশের দুই ওপেনার শামিমা সুলতানা ও আয়েশা রহমান। ওপেনিং জুটিতেই দু’জনে মিলে করেন ৩৫ রান। তখনো বেশ সহজ লক্ষ্যই মনে হচ্ছিলো বাংলাদেশের জন্য। এরপরই বাংলাদেশ শিবিরে পুনম যাদবের আঘাত! পর পর দুই বলেই দুই ওপেনারকে ফিরান এই ভারতীয় স্পিনার। দুই ওপেনারের বিদায়ে ৩৫ রানেই ২ উইকেট হারায় বাংলাদেশ মেয়েরা। এরপর তৃতীয় উইকেটে জুটি গড়েন ফারজান ও নিগার। ভারতীয় স্পিনারদের শক্ত বোলিংয়ে ২৮ বলে ২০ রানের জুটির পথে ফারজানা ফেরেন ব্যক্তিগত ১১ রানে।
এরপর চতুর্থ উইকেট নিগার ও রুমানার ২৮ রানের জুটি ধীরে ধীরে বাংলাদেশ মেয়েদের শিরোপা জয়ের লক্ষ্যে নিয়ে যায়। দলীয় ৮৩ রানে ব্যক্তিগত ২৪ বলে ২৭ রানে নিগার সুলতানা আউট হলে দলীয় স্কোর দাঁড়ায় ১৫.২ ওভারে ৪ উইকেটে ৮৩ রান। পুনব যাদব শিকার করেন তার চতুর্থ উইকেট। দলের জিততে প্রয়োজন তখন ২৮ বল থেকে মাত্র ৩০ রান, হাতে ৬ উইকেট। এরপর পঞ্চম উইকেট রুমানার সাথে ১৩ রানের জুটিতে কৌরের বলে স্টাম্পিং হয়ে ফাহিমা ফেরেন ৭ রানে।
বাংলাদেশ মেয়েদের সামনে সমীকরণ তখন ২ ওভারে দরকার মাত্র ১৩ রান, হাতে ৫ উইকেট। শিরোপা জিততে একদম সহজ সমীকরণ। কিন্তু ১৯ তম ওভারে দিপ্তি শর্মার বলে মাত্র চার রান নেন দুই সেট ব্যাটসম্যান রুমানা ও সানজিদা! ম্যাচের সমীকরণ পালটে শেষ ওভারে দরকার ৯ রান, হাতে এখনো পাঁচ উইকেট। শেষ ওভারে বল হাতে নিজেই দায়িত্ব নেন ভারতীয় অধিনায়ক হারমানপ্রেত কৌর।
প্রথম বল থেকে সিঙ্গেল নিয়ে রুমানাকে স্ট্রাইক দেন সানজিদা। পরের বলেই বাউন্ডারি মেরে জয়ের সমীকরণ আরো সহজ করে নেন রুমানা৷ শেষ ৪ বলে দরকার মাত্র চার রান! তৃতীয় বলে সিঙ্গেল নিয়ে প্রান্ত বদল করেন রুমানা। ৩ বলে দরকার আর তিন রান! এরপরই সেই নাটক! ড্রামা! থ্রিলার! শেষ বলে ২ রান নিয়ে প্রথমবার এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলতে নেমেই জয় তুলে নেয় বাংলার বাঘিনীরা।
এশিয়া কাপের ফাইনালে ভারত নারী দলকে তিন উইকেটে হারিয়ে শিরোপা ঘরে তোলে বাংলার মেয়েরা। সেদিন কুয়ালালামপুরের কিনারা ওভালে এক ইতিহাস সৃষ্টি করে বাংলাদেশ নারী দল। সুযোগ সুবিধা কম, বিভিন্ন ধরনের সীমাবদ্ধতা, অল্প বেতন এতো কিছুর পরেও ছেলেদের আগে ট্রফি জয়ের স্বাদ পেলো বাংলার বাঘিনীরা। ছয়বারের এশিয়া কাপ চ্যাম্পিয়নদের মুখের সামনে থেকে শিরোপা ছিনিয়ে নেয় বাংলার এগারো মেয়ে।