বাংলাদেশের ‘অনন্ত আক্ষেপ’ একাদশ

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের বয়স বেশিদিন নয়। তবে, ম্যাচ প্রতি খেলোয়াড় অভিষেকের হারে বাংলাদেশের অবস্থান বেশ ওপরে। অনেক প্রতিভাই বাংলাদেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রমাণের সুযোগ পেয়েছেন। কেউ সুযোগ কাজে লাগিয়ে লম্বা দৌড়ের ঘোড়া হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করেছেন, কেউ বা পারেননি।

তবে, যারা পারেননি – তাঁদের অনেকেই ক্রিকেটের হিসেবে বেশ যোগ্য ও প্রতিভাবান ছিলেন। হয়তো নিজেদের প্রতি আরেকটু যত্নশীল হলে কিংবা আরেকটু সুযোগ পেলে চিত্রটা ভিন্ন হতে পারতো। সেই সব আক্ষেপদের নিয়ে চাইলে একটা একাদশও বানিয়ে ফেলা যায়।

একাদশে যারা ঠাঁই পেয়েছেন, তাঁদের ছাড়াও এই তালিকাটা বেশ লম্বা। এখানে পেসার মোহাম্মত শরীফ, শাহাদাত হোসেন, তারেক আজিজ কিংবা রবিউল ইসলাম শিপলুরা আসতে পারতেন। আসতে পারতেন ওপেনার জুনায়েদ সিদ্দিক কিংবা শামসুর রহমান শুভ। আবার স্পিনারদের মধ্যে সোহাগ গাজী, ইলিয়াস সানিরাও বিবেচিত হয়েছেন। তবে, টিম কম্বিনেশন বিবেচনা করে তাঁদের রাথা হয়নি।

  • নাফিস ইকবাল (অধিনায়ক)

খান পরিবারের ছেলে। বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব ১৯ দলের অধিনায়ক। তিনি বড় হয়ে জাতীয় দলের অধিনায়ক হবেন – এমনই ছিল পরিকল্পনা। কিন্তু, নাফিস ইকবাল খেলেছেন ১১ টি টেস্ট ও ১৬ টি ওয়ানডে।

টেস্টে ২৩.৫৪ গড়ে তাঁর সংগ্রহ ৫১৮ রান, ওয়ানডেতে ১৯.৩১ গড়ে তিনি সংগ্রহ করেছেন ৩০৯ রান। তিনি সর্বশেষ ওয়ানডে খেলেন ২০০৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। সর্বশেষ টেস্ট ম্যাচটি খেলেন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২০০৬ সালে। এরপর ঘরোয়া ক্রিকেট খেললেও আর ফেরা হয়নি জাতীয় দলে।

  • হান্নান সরকার

হান্নান সরকার ছিলেন টেকনিক্যাল দিক থেকে বেশি শক্তিশালী একজন ব্যাটসম্যান। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ব্যাটিংয়ের ধরন না বদলানোর কারণে অনেক দ্রুতই ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে হারিয়ে যান। অথচ, অভিষেক টেস্ট ইনিংসেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হাফ সেঞ্চুরি করেন তিনি।

তিনি বাংলাদেশের জার্সি গায়ে ১৭ টেস্ট এবং ২০ ওয়ানডে খেলেছিলেন। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ খেলেছিলেন ২০০৪ সালে। এরপরেও বেশ কিছু দিন ঘরোয়া ক্রিকেট চালিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ২০১১ সালে মাত্র ২৮ বছর বয়সে ক্রিকেটকে বিদায় জানান তিনি।

  • আফতাব আহমেদ

আজো তাঁর মত একজন ভয়ডরহীন বেধরক পেটাতে পারা ব্যাটার খুঁজে ফিরে বাংলাদেশ দল। তবে, পরিসংখ্যানের বিচারে আফতাবের ক্যারিয়ার বড়ই সাদামাটা। ৬ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ১৬ টেস্টে ২০.৭৮ গড়ে ৫৮২ রান করেন। ৮৫ টি ওয়ানডেতে ২৪.৭৩ গড়ে ১৯৫৪ এবং টি-টোয়েন্টিতে তে ১১ ম্যাচে ২২.৮০ গড়ে ২২৮ রান করেন তিনি।

২০১৩ সালে বাদ পড়ে আর দলে ফিরতে পারেননি। ২০১৪ সালে সব ধরনের ক্রিকেটকে বিদায় জানান আফতাব আহমেদ। এখন তিনি রীতিমত কোচ বনে গেছেন।

  • তুষার ইমরান 

ঘরোয়া ক্রিকেটের রান মেশিন তিনি। অথচ, জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছেন  সামান্যই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দেশের হয়ে পাঁচটি টেস্ট ও ৪১ টি ওয়ানডে খেলেছেন তুষার ইমরান। ওয়ানডেতে আছে দু’টো হাফ সেঞ্চুরি। সর্বশেষ জাতীয় দলে খেলেছেন ২০০৭ সালে।

এর বছর দশেক বাদে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে বিস্তর রান করে জাতীয় দলে ফেরার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু, শেষ অবধি হয়নি ব্যাটে-বলে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১৮২ ম্যাচে ৩২ সেঞ্চুরি ও ৬৩ ফিফটিতে ৪২.৭৫ গড়ে ১১৯৭২ রান করেছেন তিনি। ক্যারিয়ার শেষ করলেন ১২ হাজার রানের মাইলফলক থেকে ২৮ রান দূরে থাকতে।

  • নাঈম ইসলাম

ঘরোয়া ক্রিকেটের পারফরম্যান্স বিবেচনা করলে জাতীয় দলের হয়ে আরো বেশি সুযোগ পাওয়া উচিৎ ছিল নাঈম ইসলামের। সব ফরম্যাট মিলিয়ে মাত্র ৭৭টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। নিজের খেলা শেষ টেস্ট সিরিজেও সেঞ্চুরি ছিল তাঁর।

আট টেস্টে ৩২ গড়ে রান তুলে পেয়েছেন একটি সেঞ্চুরি ও একটি হাফ সেঞ্চুরি। ৬ বছরের ক্যারিয়ারে ওয়ানডে খেলেছেন বেশি। ৫০ ওভারের ক্রিকেটে ৫৯ ম্যাচে ২৭ গড়ে ৯৭৫ রান আর বল হাতে পার্ট-টাইম অফ স্পিনে শিকার করেছিলেন ৩৫ উইকেট।

  • অলক কাপালি

বাংলাদেশের ইতিহাসেরই সবচেয়ে নান্দনিক ব্যাটারদের একজন তিনি। ২০০২ সালে সাদা পেশাকে অভিষেক হওয়া এই ক্রিকেটার বাংলাদেশের হয়ে শেষ টেস্ট ম্যাচটি খেলেছেন ২০০৬ সালে। দীর্ঘ চার বছরে ১৭ টেস্ট ম্যাচে থেমে আছে তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ার। এর মধ্যে দুই হাফ সেঞ্চুরিতে করেন ৫৮৪ রান।

বাংলাদেশের হয়ে ৬৯টি ওয়ানডে খেলে এক সেঞ্চুরি এবং পাঁচ হাফ সেঞ্চুরিতে রান করেছেন ১২৩৫। বল হাতে লেগ স্পিন ঘূর্ণিতে ২৪ টি উইকেট নিয়েছেন। টেস্টে তাঁর হ্যাটট্রিকও আছে, পাকিস্তানের বিপক্ষে। টেস্টে নেন ছয় উইকেট।

  • আনোয়ার হোসেন (উইকেটরক্ষক)

উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান, পুরান ঢাকার ছেলে। তাঁকে এক সময় মনে করা হত খালেদ মাসুদ পাইলটের উত্তরসুরী। ২০০২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের বাংলাদেশ সফরে একটা করে টেস্ট আর ওয়ানডে খেলার সুযোগ হয়। টেস্টে সর্বসাকুল্যে ১৪ রান করেছিলেন এই ওপেনার।

তবে, একমাত্র ওয়ানডেতে করেন ৪২ রান। অভিষেক ওয়ানডেতেই এই রান করা বাংলাদেশের জন্য তখন বিশাল ব্যাপার। তারপরও কেন সেটা তাঁর শেষ ওয়ানডে? কারণ, ৪২ রান করতে তিনি খেলেছিলেন ১০৭ বল! উইকেটরক্ষক হিসেবে অবশ্য তরুণদের মধ্যে সেরাই ছিলেন, তবে তাতে কি লাভ! স্বয়ং খালেদ মাসুদ পাইলট যে তখনও বহাল তবিয়তে খেলে যাচ্ছেন।

  • সোহরাওয়ার্দী শুভ

বাঁ-হাতি স্পিনার, ম্যাচ উইনিং বোলার। তবে, যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আসেন তখন সাকিব আল হাসান ও আব্দুর রাজ্জাকরা ছিলেন। বাইরে থেকে কড়া নাড়ছিলেন আরাফাত সানি, সোহাগ গাজী ও ইলিয়াস সানিরা। তাই, ক্যারিয়ার লম্বা হয়নি তাঁর।

আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ১ টেস্ট, ১৭ ওয়ানডে আর মাত্র ১ টি-টোয়েন্টি খেলেছেন শুভ। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে নিজের ঝুলিতে নিয়েছেব বল হাতে ১৮ উইকেট আর ব্যাট হাতে ব্যাট হাতে আছে ১১৩ রান। ওয়ানডেতে তার ইকোনমিটাও বেশ কম। মাত্র ৪.৫ ইকোনমিতেই বল করেছেন তিনি।

  • এনামুল হক জুনিয়র

বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয়ের নায়ক তিনি, প্রথম বাংলাদেশি বোলার হিসেবে টেস্টে এক ইনিংসে সাত উইকেট লাভ করেন।। অথচ, গোটা ক্যারিয়ার জুড়েই অবহেলার শিকার তিনি।

আসার যাওয়ার মধ্যে বাংলাদেশের হয়ে টেস্ট খেলেছেন ১৫ টি, তার বিপরীতে ওয়ানডে খেলার সুযোগ পেয়েছেন মাত্র ১০টি। পনেরো টেস্টে উইকেট পেয়েছেন ৪৪টি, ইনিংসে পাঁচ উইকেট পেয়েছেন তিনবার। ১০ ওয়ানডেতে উইকেট সংখ্যা ১৪, ইকোনমি বেশ ভাল ৪.৩৯।

  • নাজমুল হোসেন

বাংলাদেশের হয়ে ২০০৪ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় নাজমুল হোসেনের। এরপর ৮ বছরে জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন দুটি টেস্ট, ৩৮ ওয়ানডে এবং চার টি-টোয়েন্টি। ক্যারিয়ারে দুই টেস্ট খেলেছিলেন প্রায় সাত বছরের ব্যবধানে। পরবর্তী সাত বছরের ব্যবধানে তৃতীয় টেস্ট খেলা হয়ে উঠেনি তাঁর। জাতীয় দল থেকে ছিটকে গিয়েছিলেন তিনি।

মাত্র ২৫ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শেষ ম্যাচ খেলেন তিনি। এরপর ঘরোয়া ক্রিকেটে খেললেও আর জাতীয় দলে ফেরা হয়নি তাঁর। ২০১৮ সালে মাত্র ৩০ বছর বয়সেই ক্রিকেট থেকে বিদায় নেন নাজমুল হোসেন। টেস্টে নেন পাঁচ উইকেট। ওয়ানডেতেই বেশি সফল ছিলেন তিনি। ৩৮ ম্যাচ খেলে প্রায় ৩২ গড় নিয়ে ৪৮ উইকেট শিকার করেছেন তিনি।

  • তালহা ‍জুবায়ের

মাশরাফি বিন মুর্তজার সাথে ক্যারিয়ার শুরু তাঁর। অনেক ইনজুরির বাঁধা সত্ত্বেও মাশরাফি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছেন ২০২০ সাল অবধি। কিন্তু, পারেননি তালহা জুবায়ের। বাংলাদেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন ৬ টেস্ট এবং ৭ ওয়ানডেতে। আর শিকার করেন যথাক্রমে ১৪ এবং ৬ উইকেট।

২০০৩ সালের বিশ্বকাপ চলাকালীন সময়ে ইনজুরির কারণে ক্যারিয়ার প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিলো তাঁর। ২০০৩ বিশ্বকাপের পর ২০০৪ সালে জাতীয় দলে ফিরে ছিলেন কিন্তু পারফর্ম করতে না পারায় জাতীয় দল থেকে বিদায় নিতে হয় তাঁকে। এরপর দীর্ঘদিন ঘরোয়া লিগ খেললেও আর কখনো জাতীয় দলে ফেরা হয়নি তাঁর। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে মাত্র ২৭ বছর বয়সে ক্রিকেটকে বিদায় জানান তিনি।

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link