এক দশক পর হিসাবের খাতা নিয়ে সকলেই বসছেন। আমিও বসি। তবে দশক সেরা দল অনেকেই বানাচ্ছেন, তাই সেই পথ দিয়ে হাঁটছি না। শুরু করছি দশক সেরা পাঁচ টেস্ট ম্যাচ দিয়ে।
প্রথমেই বলে রাখি এই তালিকায় সব দেশের টেস্ট ম্যাচ রয়েছে। এই টেস্ট ম্যাচ গুলি বাছার প্রথম এবং প্রধান ক্রাইটেরিয়া হিসাবে দেখা হয়েছে ম্যাচের পরিস্থিতি, টানটান বিনোদন এবং দুই দলের গুণগত মান। তাহলে আর দেরি না করে শুরু করা যাক।
- অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড, ট্রেন্টব্রিজ ২০১৩
অ্যাশেজ সিরিজের প্রথম টেস্ট। তখনো ইংল্যান্ড জানেনা সেই বছরই ফিরতি এশেজে মিচেল জনসনের হাতে কিভাবে শাস্তি পেতে চলেছে তারা। তাদের দেশের মাটিতে তারাই চালকের আসনে এরকমই ধারণা নিয়ে শুরু হয়েছিল সেই টেস্ট। কিন্তু একেবারে শুরুতেই অস্ট্রেলিয়া নিদারুন আঘাত হানে, ইংল্যান্ডকে গুটিয়ে দেয় ২১৫ রানে। অস্ট্রেলিয়ার অনভিজ্ঞ ব্যাটিং লাইন-আপ অবশ্য ২১৫ রানের চাপেই একরকম শুয়ে পরে।
অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান এবং অধিনায়ক ক্লার্ককে অ্যান্ডারসন যে বলে আউট করেন সেটা এখনো চোখে ভাসে। ১১৭ রানে ৯ উইকেট, এই অবস্থায় যখন ইংল্যান্ডের ওপেনারদ্বয় কুক আর রুট সিডল, স্টার্ক, পাটিনসনদের পরের ইনিংসে কিভাবে খেলবো তাই নিয়ে ভাবতে শুরু করছেন, সব হিসেব উল্টে দিলেন প্রথম টেস্ট খেলতে নামা অ্যাশটন অ্যাগার।
ফিল হিউজকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার স্কোর পৌঁছে দিলেন ২৮০ রানে। ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংস ছিল ঘটনার ঘনঘটায় ভরা। স্টুয়ার্ট ব্রডের স্পষ্ট এজ করেও দাঁড়িয়ে থাকা এবং বেল এর ইংল্যান্ডকে ম্যাচে ফেরানো এবং নিজের ক্রিকেট জীবন বাঁচানো সেঞ্চুরি যার মধ্যে অন্যতম। দ্বিতীয় ইনিংসে ৩১১ তারা করতে নেমে ভালো শুরু সত্ত্বেও অস্ট্রেলিয়া ২৩১ রানে ৯ উইকেট হারিয়ে ফেলে।
কিন্তু এগারো নম্বর জেমস প্যাটিনসনকে সাথে নিয়ে ব্র্যাড হাডিন সেই ৮ বছর আগের এজবাস্টনের স্মৃতি ফিরিয়ে আনছিলেন। ১৫ রান বাকি থাকা অবস্থায় তৃতীয় আম্পায়ারের বিতর্কিত সিদ্ধান্তে আউট হন হাডিন। ডিআরএসের শিশুকালে হয়ে যাওয়া সেই ম্যাচ যদি আজ হতো, কি জানি হয়তো ব্র্যাড হাডিন সেই ম্যাচ অস্ট্রেলিয়াকে জিতিয়ে ফিরতেন।
- ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা, জোহানেসবার্গ ২০১৩
সচিন পরবর্তী প্রথম টেস্টেই ভারত গিয়ে পড়ে দক্ষিণ আফ্রিকার কড়াইয়ে। স্টেইন, মরকেল, ফিল্যান্ডার সম্বলিত আক্রমণের কাছে ভারত উড়ে যাবে, এমনটাই ভেবেছিলেন সকলে। কিন্তু কোহলির বিক্রমে দারুন শুরু করে ভারত। জানি না কোনো অজানা কারণে কোহলির সেই সেঞ্চুরি নিয়ে এতো কম আলোচনা হয়, কিন্তু সেটাই ছিল আমার দেখা কোহলির শ্রেষ্ঠ ইনিংস।
গতিশীল পিচে কোহলি যেভাবে দক্ষিণ আফ্রিকার আক্রমণকে ঘোল খাইয়েছিলেন, সেটা মনে পড়লে আজ শিহরিত হই। ভারতের ২৮০ রানের জবাবে দক্ষিণ আফ্রিকা ২৪৪ রানে গুটিয়ে যায়। চোট পেয়ে বেরিয়ে যাওয়া মরকেল বিহীন আক্রমণকে পিটিয়ে কোহলি ও পূজারা ভারতকে ৪০০ রান পার করিয়ে দেন। কোহলি দ্বিতীয় ইনিংসে ছিলেন পার্শ্বচরিত্রে, পূজারা ছিলেন নায়ক।
দু’জনের রান যথাক্রমে ৯৬ ও ১৫৩। ৪৫৮ তাড়া করতে নেমে দক্ষিণ আফ্রিকা ১৯৭ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে বেশ ফাঁপরে পরে যায়। কিন্তু এরপর ডিভিলিয়ার্স ও ডুপ্লেসির অনবদ্য যুগলবন্দী দক্ষিণ আফ্রিকাকে প্রায় জয়ের দোড়গোড়ায় পৌঁছে দেয়। একেবারে শেষ বেলায় অবশ্য ভারত বেশ কয়েকটি উইকেট তুলে নিয়ে ম্যাচের রাশ পুনরুদ্ধার করে।
সাত উইকেট চলে যাবার পর দক্ষিণ আফ্রিকা আর জেতার জন্যে ঝাঁপায় নি। যদিও শেষ ওভারে স্টেইনের মার গুলো ভারতীয় সমর্থকদের মনে যথেষ্ট ভীতির সঞ্চার করে। টেস্ট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ড্র হয়ে বেঁচে থাকবে এই টেস্ট ম্যাচ। অবশ্য ব্যক্তিগত ভাবে আমার কাছে এই ম্যাচ আরো বেশি তাৎপর্যপূর্ণ কারণ, শচীন উত্তর ভারতের টেস্ট ম্যাচ ব্যাটিং যে কোহলি-পূজারা-রাহানে ত্রয়ীর নিরাপদ হাতে রয়েছে তার প্রমান পাওয়া শুরু এই ম্যাচ দিয়েই।
- দক্ষিণ আফ্রিকা-অস্ট্রেলিয়া, কেপটাউন ২০১১
এই টেস্টের বিশদ বিবরণ প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। ক্রিকেটপ্রেমী মাত্রেই ১০ নভেম্বর ২০১১ কি কি ঘটেছিলো এক নিশাস্বে বলে ফেলতে পারবেন। ক্লার্কের অনবদ্য ১৫০, তারপর প্রথম ইনিংসে দক্ষিণ আফ্রিকার আশাতীত ভাবে ৯৬ রানে গুটিয়ে যাওয়া এবং সর্বোপরি, ১৮৮ রানের লিড নিয়ে প্রথম টেস্ট খেলতে নামা ফিলান্ডারের সামনে অস্ট্রেলিয়ার ৪৭ রানে বান্ডিল হওয়া।
স্মিথ এবং আমলার সেঞ্চুরি ১১/১১/১১ তারিখে দক্ষিণ আফ্রিকাকে একপেশে জয় দেন, কিন্তু তার আগের দিনের ঘটনাবলীর জন্যেই শুধু এই টেস্ট সর্বকালের অন্যতম সেরা টেস্ট হয়ে থেকে যাবে।
- দক্ষিণ আফ্রিকা-শ্রীলঙ্কা, ডারবান ২০১৯
দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথম ইনিংসে ২৩৫ রানে অল-আউট হয়ে গেলেও, স্টেন রাবাদার সামনে শ্রীলংকারও কেউ দাঁড়াতে পারেননি। ১৯১ রানেই শেষ হয়ে যায় তারা। দক্ষিণ আফ্রিকা শেষ ইনিংসে শ্রীলংকার সামনে ৩০৪ রানের লক্ষ্যমাত্রা রাখে। সাধারণ চিত্রনাট্য অনুযায়ী চললে, এই তালিকায় এই ম্যাচের জায়গা হয় না। কিন্তু ক্রিকেট দেবতা তাঁর প্রত্যেক ভক্তের জন্যেই একেকটা দিন বরাদ্দ রেখে দেন।
সেদিন কুশল পেরেরাও ব্রাডম্যান, লারা বা শচীন স্তরে উন্নীত হন। এটা সেরকমই একটা দিন ছিল। শেষ উইকেটে বিশ্ব ফের্নান্দো কে নিয়ে অনবদ্য জিতিয়ে ফায়ার আসেন কুশল। এরপর আগামী দেড় বছরে কুশলকে তার কাছাকাছি ফর্মেও দেখা যায়নি, আর যাবেও না। জাদু, মিরাকল যাই বলুন দশ বছরে এক-আধদিন হয়।
- অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড, লিডস ২০১৯
এই তালিকা শুরু হয়েছিল একটি অনবদ্য অ্যাশেজ টেস্ট দিয়ে, শেষ ও হচ্ছে তাই দিয়ে। প্রথম টেস্টে স্মিথের জাদুতে যাচ্ছেতাই হেরে যাওয়া ইংল্যান্ড, দ্বিতীয় টেস্ট ড্র করে এসে পৌঁছলো লীডস। ইংল্যান্ডের শুরুটা অবশ্য দারুন হলো। স্মিথ বিহীন অস্ট্রেলিয়া গুটিয়ে যায় ১৭৯ রানে। কিন্তু সেই রান প্রথম ইনিংসে ১১২ রানের লিড নেবার জন্যে যথেষ্ট ছিল। ইংল্যান্ড অসহায় আত্মসমর্পণ করে ৬৭ রানে।
এরপর ম্যাচ ও সিরিজ জিতে নেওয়াটা অস্ট্রেলিয়ার কাছে ছিল স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। ৩৫৯ রানের টার্গেট ইংল্যান্ডের মাটিতে শেষ ইনিংসে একরকম অসম্ভব। কিন্তু পাল্টা লড়াই শুরু করেন রুট। অধিনায়োকোচিত ইনিংসটি শেষ হয় চতুর্থ দিনের একদম শুরুতে।
এরপর প্রথমে বেয়ারস্টো এবং পরে টেইল এন্ডের ব্যাটসম্যানদের নিয়ে অভাবনীয় জিতিয়ে দেন কয়েক মাস আগে বিশ্বকাপ ফাইনালে একইরকম জাদুকরী ইনিংস খেলা স্টোকস। জ্যাক লেছ সম্ভবত জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি রান করেছিলেন সেদিন। অস্ট্রেলিয়া অবশ্যই বহু সহজ সুযোগ জলাঞ্জলি দিয়েছিলো, কিন্তু তাতে স্টোকসের কৃতিত্ব এক ইঞ্চিও কমে না।