২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপ ভোলার কথা নয় কোন ক্রিকেট ভক্তের। ইংল্যান্ড আর নিউজিল্যান্ডের মধ্যকার সেই নখ কামড়ানো উত্তেজনার ম্যাচে শেষপর্যন্ত জিতেছিল ইংলিশরা। অবশ্য সেই জয়ে এখনো বিতর্ক লেগে আছে; তবে বিতর্ক নেই এক জায়গায়, সেটি বেঞ্জামিন অ্যান্ড্রু স্টোকসের সেই নায়কোচিত কীর্তি। অপরাজিত ৮৪ রানের অবিশ্বাস্য ইনিংস খেলে ম্যাচ নিয়ে গিয়েছিলেন সুপার ওভারে। সেখান থেকেই বিশ্বকাপ জিতেছে ইংলিশরা।
ক্রিকেটের জনক হিসেবে পরিচিত ইংল্যান্ড, আর সেই ইংল্যান্ডকে বিশ্বকাপ শিরোপার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ ৩৪ বছর। এই লম্বা খরা কাটানোর নায়ক বেন স্টোকস আরেকবার স্তম্ভিত করলেন সমর্থকদের।
হুট করেই ঘোষনা দিলেন এই পঞ্চাশ ওভারের ফরম্যাটে তার সমাপ্তি ঘনিয়ে এসেছে। নিজের ঘরের মাঠ সিট ইউনিক রিভারসাইড স্টেডিয়ামে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে খেলার পরেই ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ইতি টানবেন স্টোকস।
অবসরের ব্যাপারে এই অলরাউন্ডার বলেন, এই সিদ্ধান্ত গ্রহন করাটা আমার জন্য বেশ কঠিন ছিল। কিন্তু এই ফরম্যাটে এখন আমি আমার শতভাগ দিতে পারছি না আর এই ব্যাপারটি মেনে নেয়া অবসরের সিদ্ধান্তের চেয়ে বেশি কঠিন। ইংল্যান্ড দলের জার্সি গায়ে জড়ানো প্রত্যেকের কাছ থেকেই সর্বোচ্চ চায় দল, আর তাই আমি সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
২০১১ সালে আয়ারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে ওয়ানডে অভিষেক হয়েছিল বেন স্টোকসের। এরপর থেকে প্রায় এক যুগের কাছাকাছি সময়টাতে ইংলিশদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন তিনি। এখন পর্যন্ত ১০৪ টি পঞ্চাশ ওভারের ম্যাচ খেলা বেন স্টোকসের নামের পাশে আছে ২৯১৯ রান, এছাড়া বল হাতে তিনি নিয়েছেন আরো ৭৪ উইকেট।
ইংল্যান্ড জাতীয় ওয়ানডে দলের অধিনায়ক হওয়ার রেকর্ডও আছে বেন স্টোকসের ক্যারিয়ারে। তাঁর নেতৃত্বেই পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করেছিল ইংলিশরা। তবে ২০১৯ বিশ্বকাপ স্টোকসের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় হাইলাইটস হয়ে থাকবে।
বিশ্বকাপের সেই আসরে উদ্বোধনী ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৭৮, আর সাথে অতিমানবীয় এক ক্যাচ। এরপর গ্রুপ পর্বে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’ হয়ে লড়েছিলেন। ৮৯ বলে ৮২ করেও সেদিন অল্পের জন্য জেতাতে পারেননি দলকে। তার পরের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও ছিলেন ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’।
আর ফাইনালের সেই কল্পনাতীত ইনিংস তো আছেই, যেটি হার মানায় অবাস্তব কোন চিত্রনাট্যকে। স্টোকসের ক্লান্তিহীন বামহাতটা বারবার ভগ্ন ইংলিশ ক্রিকেটকে টেনে নিয়েছে। তিনি হয়ে উঠেছেন প্রিয় বেন, স্যার বেন!
জো রুট সরে দাঁড়ানোর পর সম্প্রতি সাদা পোশাকে নেতৃত্বের ভার এসেছে বেন স্টোকসের কাঁধে। বর্তমানে ক্রিকেটের প্রাচীনতম ফরম্যাটে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে চাচ্ছেন বামহাতি এই ব্যাটার৷ বয়স ইতোমধ্যে ত্রিশের কোটা পার হয়ে গিয়েছে, তাই এই মুহূর্তে তিন ফরম্যাটে একসাথে খেলা চালিয়ে যাওয়া আর সম্ভব মনে হচ্ছে না তার।
সেজন্য বেছে নিলেন টেস্ট আর টি-টোয়েন্টি। আপাতত ইচ্ছে টেস্ট ক্রিকেটে নিজেকে উজাড় করে দেয়া। ব্রেন্ডন ম্যাককলাম আর বেন স্টোকসের জুটি ইংল্যান্ডকে যে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখাচ্ছে সেটি পূরণের পথে এগিয়ে যাওয়া স্টোকসের প্রধান লক্ষ্য। এর পাশাপাশি তারুণ্যের খেলা টি-টোয়েন্টিতে আরো ভাল করতে আগ্রহী তিনি।
সবকিছু মিলিয়ে ক্রিকেটের এই ব্যস্ত শিডিউলের যুগে বিশ্রামের পথ খুঁজে নিলেন বেন স্টোকস। ২০১১ সালে যেই যাত্রা শুরু হয়েছিল সেটির গন্তব্য নির্ধারণ করে ফেললেন তিনি। আর এই চলার পথে ইংলিশদের এনে দিয়েছেন বিশ্ব জয়ের গৌরব, বহুল আকাঙ্খিত সোনালী সেই ট্রফি। শুধুমাত্র ওয়ানডে ক্যারিয়ারেই এককভাবে স্টোকসকে ইংল্যান্ডের কিংবদন্তি বললে আপত্তি করার কিছু থাকবে না।
অথচ ইংলিশ ক্রিকেটের ‘ব্যাড বয়’ তকমায় ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যেতে পারতো বেন স্টোকসের। ব্রিস্টলের এক নাইটক্লাবে মারামারি করেছিলেন, দৌঁড়াতে হয়েছিল বিচারকের কাছে। দল থেকেও বাদ পড়েছিলেন। সবমিলিয়ে তিনি তখন অনিশ্চয়তার নৌকায় গন্তব্যহীন যাত্রী। ভাগ্যের সহায়তায় হোক কিংবা নিজগুনে স্টোকস ফিরে এসেছিলেন, এবং তাঁর পারফরম্যান্সেও পড়েনি কোন ভাটা।
প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই বেন স্টোকসের শূন্যস্থান পূরণ হয়ে যাবে, ইংল্যান্ডের একাদশে তার জায়গায় নতুন কেউ আসবে। কিন্তু ভক্তদের হৃদয়ে স্টোকসের শূন্যতা থেকে যাবে, তার জায়গা কেউই দখল করতে পারবে না। লর্ডসের সেই ফাইনালে হাত তুলে নিজেকে নির্দোষ দাবি করা কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে উড়ন্ত স্টোকসের মূহুর্তগুলো থেকে যাবে অনেকটা সময়।