‘আপনি যদি আমাকে জানতে চান, তাহলে আপনাকে আমার এবং উইলার্সের বিপক্ষে ফুটবল খেলতে হবে’ – একবার এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে এভাবে উত্তর দিয়েছিলেন বব মার্লে। মার্লের কাছে সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল, আপনাকে চেনার এবং জানার সর্বোত্তম উপায় কি?
বব মার্লে ছিলেন একাধারে জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী, গীতিকার, সুরকার এসব পরিচয়েই তিনি আমাদের কাছে বেশি পরিচিত। রেগি, স্কা, রক স্টেডির মত ব্যান্ডের শুরুটা তার হাত ধরেই। কিন্তু আপনি কি জানেন? ফুটবল মার্লের কাছে ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল মিউজিক।
বব মার্লে কখনোই ফুটবল থেকে দূরে ছিলেন না। কখনো সংগীত চর্চার সময় কোনো স্টুডিও সেশমের মাঝের সময়টায় অথবা মঞ্চে গান গাইতে উঠার আগে কিংবা বন্ধুদের সাথে পার্কে খেলতে যাবার আগে যখন সুযোগ পেয়েছে ফুটবলের সাথে সময় কাটিয়েছে। ফুটবলের প্রতি মার্লের ঝোকটা এতটায় তীব্র ছিল।
এই অনিন্দ্য সুন্দর খেলাটি তাকে মাঝে মাঝে সংগীত থেকে সাময়িক মুক্তি দিত সেই সাথে তার ব্যক্তিত্বকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলত।
১৯৮০ সালে এক সাক্ষাৎকারে মার্লে বলেছিলেন, ‘ফুটবলের আগে আমি আমার গানকে ভালোবাসি। যদি ফুটবলকে সর্বাধিক ভালোবাসতে চাই তাহলে সেটি বিপজ্জনক হতে পারে। আমি আগে সংগীতকে ভালোবাসি এরপর ফুটবল। গান এবং ফুটবল একসাথে চালিয়ে নেয়াও বিপদজনক। কারণ কখনোকখনো ফুটবল উগ্র হয়ে যায়। আমি গান করি শান্তির, ভালোবাসার । কেউ যদি আপনাকে কঠিনভাবে ট্যাকল করে তাহলে সেটি যুদ্ধ সমপর্যায়ের আবেগ।’
‘তাকে ফুটবল খেলতে দেখা আমার কাছে একটা যাদুকরী ব্যাপার মনে হত’ – বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মার্লের ব্যক্তিগত আলোচিত্রকর এবং বন্ধু মরিস শুরুটা এভাবেই করেছিলেন। এরপর মরিস আরো বলেন, ‘তিনি ফুটবল খেলার সময় আমি কখনই তার ছবি তুলতাম না কারণ আমি সত্যিই তার খেলা দেখতে চেয়েছিলাম, উপভোগ করতে চেয়েছিলাম। কারণ এটিই ছিল মার্লের আনন্দ এবং আয়েশের একমাত্র সময় তাই আমি সেই সময়টায় ক্যামেরা নামিয়ে রাখতাম।’
ব্রাজিলিয়ান ক্লাব সান্তোস এফসি এবং ইংলিশ ক্লাব টটেনহান হটস্পারের পার সমর্থক ছিলেন মার্লে। থ্রী লিটিল বার্ডের এই গায়কের পছন্দের ফুটবলার ছিলেন স্পার্সের আর্জেন্টাইন মিডফিল্ডার অসি আর্ডিলস, যিনি কিনা ১৯৭৮ সাল থেকে এক দশক ধরে এই ক্লাবের হতে খেলেছেন।
৭০-এর দশকের মাঝামাঝি লন্ডনের ব্যাটারসিয়া পার্কে একটি প্রীতি ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করা হয়েছিল। সেই ম্যাচে খেলেছিলেন বব মার্লে। সে ম্যাচের প্রসঙ্গ টেনে এনে মার্লের বন্ধু লেভি রুটস মার্লের ডিফেন্ডিং ফুটবলের বর্ণনা করেন এভাবে, ‘তিনি তার লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন, যখনই পায়ে বল নিয়ে দৌড় শুরু করতেন তখন তার একটাই উদ্দেশ্য ছিল প্রতিপক্ষকে পেছনে ফেলা এবং গোলে শট নেওয়া। এক কথায় বললে যে দু’টো কাজ তিনি ভালবাসতেন – দুটোতেই তিনি মাস্টার ছিলেন!’
১৯৭৭ সালে একটি ফুটবল ম্যাচে পায়ে আঘাত পান মার্লে। ধীরে ধীরে সেটি একটা সময় ক্যান্সারে রূপ নেয়। এই চার বছরে যা হবার হয়ে গেছে এরপরেই তিনি জানতে পারেন এই ক্যান্সার তার সমস্ত শরীরে বাসা বেধেছে। অবশেষে ১৯৮১ সালে ১১ মে মারা যান তৃতীয় বিশ্ব থেকে উঠে আসা প্রথম সুপার স্টার বব মার্লে।
মৃত্যু হচ্ছে সেটা যখন কেউ আর আপনার নাম নিচ্ছে না, বব মার্লের মত কিংবদন্তিরা এখানে আলাদা। জীবিত বব মার্লের চেয়ে মৃত বব মার্লেকে বেশি মানুষ মনে রেখেছে, অদূর ভবিষ্যতেও মনে রাখবে। মার্লে বেঁচে থাকবেন তার কর্মের মধ্য দিয়ে, কীর্তিমানের মৃত্যু নাই।
মার্লের ফুটবল প্রেম তাঁর পরিবারের পরের প্রজন্মেও ছিল!
২০১৮ সালে জামাইক্যান নারী ফুটবল দল রেগি গার্লস ইতিহাস গড়েন ফ্রান্স বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে। যে দলটার আর্থিক অবস্থা একটা সময় এতই নাজুক ছিল যে, খেলাটায় তাদের কাছে বিলাসিতা মনে হত সেই সময় এগিয়ে কেডেলা মার্লে।
পরিচয়টা না দিলে বোধহয় তার প্রতি উপাদান অন্যায় করা হবে হ্যাঁ এই কেডেলা মার্লে কিংবদন্তি বব মার্লের মেয়ে। যিনি ২০১৪ সাল থেকে দলটার দেখবাল করে আসছেন, বব মার্লে ফাউন্ডেশনকে সাথে নিয়ে। দায়িত্ব নেওয়ার সময় মারাত্মক আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়ে কাটাচ্ছিল রেগি গার্লস দলটা।
মার্লেরা ফুটবলকে ভালবাসতেন যেমন, তেমনি ফুটবলও তাঁদের দিয়েছে।
এর আগে ২০০৮ সালে গ্রীষ্মে কার্ডিফ সিটি একটি প্রীতি ম্যাচ খেলেছিল আয়াক্সের বিপক্ষে। ম্যাচ শেষে হওয়ার পরও আয়াক্স সমর্থকরা তাদের নির্ধারিত বসার জায়গায় স্থির ছিল যতক্ষণ না পর্যন্ত কার্ডিফ ভক্তরা স্থান ত্যাগ করে।
নিনিয়ান পার্ক স্টেডিয়ামের ঘোষক আলী ইয়ায়াসিন অসংখ্য আয়াক্স ভক্তদের শান্ত রাখার জন্য সংগীতের নির্দেশ দেন এবং বিশাল রেগা ভক্ত তখন বব মার্লের থ্রী লিটিল বার্ডে গানটি বেছে নিয়েছিলেন। গান শুরুর পর আয়াক্স ভক্তরা এতটায় বুদ হয়েছিলেন যে গানের তালে তালে তারা নাচতে শুরু করেন, কেউ আবার কড়াতালিতে ফেটে পরেন এরপর এই গানটি আয়াক্সের নিজস্ব সংগীতে পরিণত হয়। ২০১৮ সালে আয়াক্সের একটি ম্যাচে বব মার্লের ছেলে কি-মানি মার্লে উপস্থিত ছিলেন। ম্যাচের প্রথমার্ধের সময় ‘থ্রী লিটিল বার্ড’ গান পরিবেশনের জন্য সম্মানিত করা হয়।
যখনই কোনো স্টেজ শো থাকত না অর্থাৎ অবসর সময়ে তিনি এমন সব পোশাক পরতেন যেন ফুটবল খেলার জন্য তিনি প্রস্তুত এবং চাইলে এখনই খেলা শুরু করে দিতে পারেন।
জামাইকার জাতীয় দল থেকে শুরু করে ব্রাজিলের ট্রেডমার্ক হলুদ জার্সির প্রতি মার্লের প্রচণ্ড টান ছিল। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের জার্সি এবং ফুটবল ট্র্যাকসুটও পরিধানের জন্য ভীষণ পছন্দের ছিল। তাই বলতে গেলে সবসময় এসব পোশাকেই তার দেখা মিলত তার। এসব পোশাকের মধ্য দিয়েও ফুটবলের প্রতি বব মারের ভালোবাসা দারুণভাবে ফুটে উঠতো।
যুক্তরাজ্যে যখন মার্লে খেলত তখন দেখা যেত তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত আবৃত। মাথায় উলের টুপি, পায়ে মোজা আর অ্যাডিডাস কোপা মানডিলা ব্রান্ডের বুট। অন্যদিকে জামাইকাতে আপনি যখন মার্লেকে দেখবেন তখন ৭০-দশকের ক্লাসিক শর্টস আর কম্বো টি – শার্ট পরে মার্লে ফুটবল নিয়ে কারিকুরি করছে।