ব্রাজিলের আক্রমণে মধুর সংকট

‘মিশন হেক্সা’ এই এক স্বপ্নে বিভোর ব্রাজিলিয়ান ফুটবল সমর্থকরা। তবে সে স্বপ্নের দপদপে আগুনে ২০১৪ সালে বয়ে যায় জার্মান বন্যা। তবে সে স্বপ্ন যেন আবার নতুন করে বুনতে শুরু করেছে সেলেসাওরা। ইতোমধ্যে ২০২২ বিশ্বকাপের টিকিট কেটে ফেলেছে পাঁচ বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। অপেক্ষা শুধুই প্লেনে চড়ে বসবার। তবে তার আগে কোচ তিতেকে পড়তে হচ্ছে এক মধুর সমস্যা।

সাম্প্রতিক সময়ে ব্রাজিলের আক্রমণ ভাগে যেন খেলোয়াড়দের অভাব নেই। তা অবশ্য কোন কালেই ছিল না। তবে সমস্যাটা আরেকটু তীব্র হওয়ার পেছনে দায়ী  খেলোয়াড়দের ফর্ম। প্রায় প্রতিটা আক্রমণভাগের খেলোয়াড় রয়েছেন নিজেদের ক্যারিয়ারের ফর্মের তুঙ্গে। এমতবস্থায় কাকে রেখে কাকে নিয়ে কাতার যাবেন তিতে, তা যেন ভেবেই পাচ্ছেন না তিনি।

তিতের রাডারে থাকা আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের একটা ছোট্ট তালিকা থাকছে আজকের আয়োজনে।

  • নেইমার

প্রথমেই যে নামটা সবার আগে রয়েছে তিতে টেবিলে তা নি:সন্দেহে নেইমারের। ইনজুরি মুক্ত নেইমার যে ঠিক কতটা ভয়ংকর তা আর বলে দেওয়ার প্রয়োজন নিশ্চয়ই নেই। ২০১৪ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে নেইমারের ইনজুরির পর ঘটে গিয়েছিল ব্রাজিল ফুটবল ইতিহাসের সম্ভবত সবচেয়ে কাল এক অধ্যায়। ঘরের দর্শকদের সামনে জার্মানি স্রেফ ছেলেখেলা করেছিল ব্রাজিলের সাথে।

তবে এবার তিতেও হয়ত খুব করে চাইবেন নেইমার পূর্ণ সুস্থ হয়েই তাঁর সাথে হাজির হোক কাতারে। কেননা এই মুহূর্তে ব্রাজিলে নেইমারের থেকে ভাল মানের খেলোয়াড় নেই বললেই চলে। ব্রাজিলের হলুদ জার্সি গায়ে নেইমার ১১৬ ম্যাচে মাঠে নেমে করেছে ৭০টি গোল। অতএব জাতীয় দলের হয়ে নেইমার অপ্রতিরোধ্য বিধ্বংসী এক সত্ত্বা।

  • ভিনিসিয়াস জুনিয়র

রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে কি অসাধারণ এক সময় কাটাচ্ছেন ভিনিসিয়াস জুনিয়র। এখন অবধি লস ব্ল্যাঙ্কোসদের হয়ে এই মৌসুমে ২১টি গোল করেছেন তরুণ তুর্কি ভিনিসিয়াস। সেখানেই থেমে নেই ২০টি গোল সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছেনও তিনি। ফর্মের সর্বোচ্চ চূড়ায় রয়েছেন ভিনি। তাঁকে নিয়ে যেতে চাইবেন হয়ত তিতে। নেইমারের বেশ ভাল এক বিকল্প হতে পারবেন ভিনি।

দ্রুত ড্রিবিলিং করার পাশপাশি গতিও দারুণ রয়েছে তাঁর। মুহূর্তের মধ্যে প্রতিপক্ষের রক্ষণে চিড় ধরিয়ে বল নিয়ে হাজির হয়ে যেতে পারেন ডি-বক্সের সামনে। আর নিজের ফিনিশিং দক্ষতার বেশ উন্নতি ঘটিয়েছেন তিনি। ফর্মের শীর্ষে থাকা একজন খেলোয়াড়কে নিশ্চয়ই ফেলে রেখে যেতে চাইবেন না তিতে।

  • রিচার্লিসন

এইতো সেদিন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের খেলা দল এভারটন এফসিকে রেলিগেশন থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন রিচার্লিসন। ইনজুরির থাবায় বেশ ধুকতে হয়েছে তাঁকে। তবে দলের প্রয়োজনে তিনি যে কোন সময়ে নিজের সেরাটা উজাড় করে দিতে একদমই পিছপা হয়না।

আর তিতে তাঁকে দলে নেওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে তাঁর ‘ভার্সেটালিটি’। দুই উইংয়ের এর পাশপাশি একজন ‘নাম্বার নাইন’ অথবা ‘ক্রিয়েটিভ স্ট্রাইকার’ হিসেবে খেলতেও তিনি বেশ পটু।

  • গ্যাব্রিয়েল জেসুস

ফর্মহীনতায় একটা শঙ্কায় রয়েছেন গ্যাব্রিয়েল জেসুস। খুব সম্ভবত তিনি দল থেকে বাদ পড়েও যেতে পারেন। তবে একটা বিষয় লক্ষ্যনীয় যে তিনি কোচ তিতের একজন প্রিয় শীর্ষ। তিতে আমলেই ২০১৬ সালে গ্যাব্রিয়েল জেসুসের অভিষেক হয়েছিল।

তবে, তাঁর সাম্প্রতিক ফর্ম নিশ্চয়ই অন্তঃরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাছাড়া অন্যদিকে ম্যাথুয়েস কুনহা ও রবার্তো কুনহা ছাড়াও গ্যাব্রিয়েলের প্রতিদ্বন্দী এখন গ্যাব্রিয়েল বারবোসা। এখনও মাস দশেক বাকি জেসুসকে নিজেকে প্রমাণ করতে।

  • রবার্তো ফিরমিনো

ফুটবলারদের ক্যারিয়ারের প্রধান বাঁধা ইনজুরি। আর সে ইনজুরির হয়ত এবার তিতেকে বেশ ভোগাবে। শেষমেশ হয়ত এই যে মধুর সমস্যা না আবার পরিণত হয় তিক্ত অভিজ্ঞতায়।

কেননা তিতের আস্থাভাজন রবার্তো ফিরমিনো এবারের আসরে ছিলেন একেবারেই নিষ্প্রভ। কারণ ওই যে ইনজুরি। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠে ফিরমিনোকে প্রমাণ করতে হবে নিজেকে। প্রমাণ করেই উঠতে হবে কাতারের প্লেনে।

  • রাফিনহা

ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দল লিডস ইউনাইটেডের হয়ে এবারে আসরে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন রাফিনহা। রাইট উইংয়ের আক্রমণের জায়গাটা নিয়ে নিশ্চয়ই খুব একটা দুশ্চিন্তায় নেই তিতে।

কেননা রাফিনহার মত একজন প্রতিভাবান ও কার্য্যকর একজন খেলোয়াড়রের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে ব্রাজিলের বিশ্বকাপ দলে জায়গা করে নেওয়ার। ২৩ সদস্যের দলে তাঁকে জায়গা করে নিতে হলে বিশ্বকাপের আগের লিগ ম্যাচগুলোতে নিজের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখবেন।

  • অ্যান্টোনি 

ব্রাজিলে রাইট উইংয়ে আরও একজন প্রতিভাবান খেলোয়াড় রয়েছেন তিতের নজরে। ডাচ ক্লাব আয়াক্সের  আক্রমণের প্রধান অস্ত্র অ্যান্টোনি। ইতোমধ্যে তাঁকেও জাতীয় দলে এনে বাজিয়ে দেখিয়েছেন কোচ তিতে।

সেখানেও তিনি তাঁর প্রতিভার প্রতিফলন ঘটিয়ে কোচের ‘গুড বুক’-এ নাম লিখিয়ে ফেলেছেন। রাইট উইংটা আরও একটু শক্তপোক্ত করতে অ্যান্টোনি হয়ত হতে পারেন বেশ ভাল এক বিকল্প।

  • গ্যাব্রিয়েল বারবোসা

ব্রাজিল দলে খেলতে হলে যে ইউরোপের নাম করা ক্লাবেই খেলতে হবে এমন কোন বাঁধাধরা নিয়ম নেই কোচ তিতের বইয়ে। তিনি যেখানেই প্রতিভার খানিক ঝলক দেখতে পান সেখান থেকেই প্রতিভা আহরণ করবার চেষ্টা করেন।

সেজন্যেই ব্রাজিলিয়ান লিগে খেলা গ্যাব্রিয়েল বারবোসা সুযোগ পাচ্ছেন নিয়মিত। এ বছরে ব্রাজিল জাতীয় দলের খেলাতেও হয়ত দেখা যেতে বারবোসাকে। তবে কাতার বিশ্বকাপে তিনি যেতে পারবেন কি না তা বলে দেবে সময়।

  • ম্যাথুয়েস কুনহা 

২০২১ সালে দারুণ এক বছর কাটিয়েছেন কুনহা। অলেম্পিকে ব্রাজিলে হয়ে স্বর্ণ জেতায় তিনি করেছিলেন তিন গোল। তাছাড়া তাঁর প্রতিভার প্রতি মুগ্ধ হয়ে তাঁকে দলে ভিড়িয়েছেন স্প্যানিশ ক্লাব অ্যাতলেটিকো মাদ্রিদের কোচ ডিয়েগো সিমিওনি নিয়ে এসেছে স্পেনে। তাছাড়া তাঁর ফিনিশিং দক্ষতার বেশ একটা প্রশংসা ছড়িয়ে গেছে সমগ্র ইউরোপে। অতএব তিনিও হয়ত হেক্সা জয়ের মিশনে।

  • ফিলিপ কৌতিনহো

ইনজুরি কাটিয়ে মাঠে ফিরেছেন ফিলিপ কৌতিনহো ২০২১/২২ মৌসুমের মাঝামাঝি সময়ে। এ সময়ে তিনি বার্সেলোনা থেকে ধারে খেলতে অ্যাস্টন ভিলাতে গিয়েছেন আর নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ রেখেছেন।

বার্সেলোনায় যাওয়ার ভুল সিদ্ধান্তকে এখন কিছুটা আড়াল করতে কৌতিনহো পারফরম করার চেষ্টায় মশগুল। কেননা তাঁর মত সুদক্ষ খেলোয়াড়ের ফর্মে ফেরাটা ব্রাজিলের হেক্সা জয়ের জন্যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তিতেও নিশ্চয়ই চাইবে কৌতিনহোর মত একজন ‘প্লে-মেকার’ থাকুক দলে।

  • রদ্রিগো গোয়েজ

রিয়াল মাদ্রিদ কোচ কার্লো আনচেলত্তির তুরুপের তাস ২১ বছর বয়সী রদ্রিগো গোয়েজ। ‘সুপার সাব’ তকমাটা যেন ক্রমশ এঁটে যাচ্ছে তাঁর নামের পাশে।

এই বয়সেই বড় ম্যাচের সবচেয়ে কঠিন সময়ে দলকে জয়ের বন্দরে নিয়ে যাওয়াটা নিশ্চয়ই পরিপক্কতার পরিচয় বহন করে। কোচ তিতেও হয়ত রদ্রিগোকে ব্যবহার করতে পারেন একজন সুপার সাব হিসেবে। তাছাড়া লেফট উইং পজিশনেও বাড়তি এক বিকল্প হওয়া ছাড়াও রাইট উইংয়ে খেলতেও দক্ষ রদ্রিগো।

  • আর্থার ক্যাবরেল

ব্রাজিলের স্ট্রাইকিং পজিশনে সবচেয়ে বেশি প্রতিযোগিতা সবচেয়ে বেশি। আর সে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রয়েছেন আর্থার ক্যাবরেল। বাসেল এফসির হয়ে এই মৌসুমে ৩১ ম্যাচে ২৭ খানা গোল করেছেন। তবে এখন অবধি তাঁর গায়ে ওঠেনি ব্রাজিলের পাঁচ তারকা খচিত জার্সি। তিনি যদি বিশ্বকাপের আগেও নিজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেন তবে সেক্ষেত্রে হয়ত তিতে তাঁকে বিবেচনা করতে পারেন বিশ্বকাপ স্কোয়াডে।

এত সব খেলোয়াড়ের ভীরে তিতে মধুর সমস্যা রয়েছেন সে কথা ঠিক। তবে তিতিকে এখন হতে হবে খুব বিচক্ষণ। তিনি কাকে রেখে কাকে নিয়ে যাবেন কাতারে সে বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্ত হতে হবে নির্ভুল। একটু খানি ভুলে সমালোচনার ঝড় বয়ে যেতে পারে। এখন দেখবার পালা, মধুর এই সমস্যার ইতি ঘটিয়ে ব্রাজিল তাদের ‘হেক্সা মিশন’ শেষ করতে পারে কি না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link