লাহরের বৃষ্টিস্নাত একটি দিন। বৃষ্টির পানি গাদ্দাফি স্টেডিয়ামের লাল দেওয়াল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি) অফিসের বাইরেও অনেক পানি। তবুও সেই জায়গাটায় সাংবাদিক সহ টিভি রিপোর্টারদের বিস্তর ভিড়। সবাই একজায়গায় জড়ো হয়েছেন। কারণ পাকিস্তান অধিনায়ক বাবর আজম আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপকে সামনে রেখে মিডিয়ার সাথে কিছু সময় কথা বলবেন। ডজন খানেক ক্যামেরা আর রুম ভর্তি সাংবাদিকদের সামনে বাবর জানালেন বিশ্বকাপকে ঘিরে নিজেদের পরিকল্পনার কথা।
এবারের আসরে অন্যতম ফেবারিট হিসেবেই খেলবে পাকিস্তান। আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপকে সামনে রেখে নিজেদের সেরা প্রস্তুতিটাই নিয়েছে পাকিস্তান। অন্যান্য দলের মতোই বাবরের লক্ষ্য এবারের আসরে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ঘরে তোলা। অবশ্য এ নিয়ে নিজেদের পরিকল্পনার খানিকটা জানিয়েছেন তিনি। তবে, বিশ্বকাপের আগে কোচ পরিবর্তনে একটু অসুবিধে হতে পারে সেটাও বাবরে কথায় স্পষ্ট।
২০১৯ বিশ্বকাপের পর পাকিস্তানের কোচ হিসেবে দায়িত্ব নেন মিসবাহ উল হক। এর আগে কোচ মিকি আর্থারের অধীনে পাকিস্তান ছিলো এক নম্বর টি-টোয়েন্টি দল! ৩৭ ম্যাচের ৩০ টিতেই জয় পেয়েছিলো পাকিস্তান। অপরদিকে, ৩৪ ম্যাচে মাত্র ১৬ জয় পায় মিসবাহর অধীনে। বর্তমানে টি-টোয়েন্টিতে তিনে অবস্থান করছে বাবর আজমের দল।
এ ব্যাপারে অধিনায়ক বলেন, ‘যখনই নতুন ম্যানেজমেন্ট আসবে তাতে মানিয়ে নিতে কিছুটা সময়ের প্রয়োজন। আপনি একদিনের মাঝেই এর সাথে মানিয়ে নিতে পারবেন না। এটার জন্য সময়ের প্রয়োজন। আপনি যখনি নতুন একটি দল গঠন করবেন, আপনি সাথেই সাথেই (দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় ম্যাচে) এর ফল পাবেন না। আপনাকে সময় নিতে হবে। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য যত দ্রুত এর সাথে মানিয়ে নেওয়া যায়।’
তিনি আরো বলেন, ‘দুই বছর আগের সাথে এখনের সময়টা সম্পূর্ণ আলাদা। সবকিছুই পরিবর্তন হয়। এক সময় আমাদের আরেকটা ম্যানেজমেন্ট ছিলো, ভিন্ন কোচ ছিলো। তাদের মাইন্ডসেটও আলাদা ছিলো। সেদিক থেকে আমাদের এখন বেশ কিছু নতুন খেলোয়াড় আছে। একটু ভিন্ন টিম বলা চলে আগের তুলনায়।’
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের একসময় সেরা দল ছিলো পাকিস্তান। বর্তমান সময়েও আছে র্যাঙ্কিংয়ের সেরা তিনে। তবে সাফল্য পেতে পারফরম্যান্সে ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে চান বাবর। তিনি বলেন, ‘আমাদের রেকর্ড বেশ ভালো। এখানেই আমরা টি-টোয়েন্টিতে এক নম্বর ছিলাম। আমরা ব্যক্তিগত ও দলগত যে পারফরম্যান্স করেছি, এটা প্রমাণ করে আমরা সহজেই কন্ডিশনের সাথে মানাতে পেরেছিলাম। আমাদের রেকর্ড এবং ধারাবাহিকতা সেটাই প্রমাণ করে। এখন প্রায় সবাই পজিটিভ ক্রিকেট খেলে এবং আমাদেরকেও সেটা ধরে রাখতে হবে।’
আরব আমিরাতে খেলার প্রসঙ্গে বাবর বলেন ওই ভেন্যুতে তিনি সহজেই মানিয়ে নিতে পারবেন। ওই ভেন্যুই তাঁর জন্য বিশেষকিছু। সেখানেই তিনি র্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বরে উঠে এসেছিলেন। এছাড়া গেলো এক বছর ওপেনিংয়ে বেশ দুর্দান্ত ফর্মে আছেন বাবর ও মোহাম্মদ রিজওয়ান। রেকর্ডও কথা বলছে তাঁদের পক্ষেই।
বাবর বলেন, ‘আমি ওপেনার হিসেবে সেখানে (আরব আমিরাত) এক নম্বর হয়েছিলাম। আমি ওপেনিংয়ে ভালো করেছি। আমি সেখানেই খেলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। আমার এবং রিজওয়ানের সাম্প্রতি ফর্ম দেখলেই বুঝতে পারবেন। এখনো বছর শেষ হয়নি, তবুও রিজওয়ান এক বছরে সর্বোচ্চ টি-টোয়েন্টি রান সংগ্রাহকের রেকর্ড করে ফেলেছে। আর কি চান?’
চলতি বছর টি-টোয়েন্টিতে ১৪ ইনিংসে ৭ হাফ সেঞ্চুরি ও ১ সেঞ্চুরি করেছেন রিজওয়ান। ৫২ গড়ে ব্যাট করেছেন তিনি! বাবর ও রিজওয়ান মিলে ম্যাচ প্রতি গড়ে প্রতি ওভারে ৯.১৬ রান করে তুলেছেন! দুইজনের ওপেন করা ১০ ম্যাচের মাত্র একটিতে ৩৫ এর নিচে প্রথম উইকেটের পতন ঘটে। পরিসংখ্যানও বলছে সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানের ওপেনিং জুটিতে বাবর-রিজওয়ানই সেরা।
তিনি বলেন, ‘এর চেয়ে ভালো কম্বিনেশন বর্তমানে নেই। আমরা সবসময়ই একটা ভালো শুরু করতে চাই যাতে আমাদের পরে যারা ব্যাট করবে তাদের জন্য সুবিধা হয়। এটাই আমাদের মাইন্ডসেট! প্রায় এক বছর একসাথে ওপেনিংয়ে খেলার আমরা দু’জন দু’জনের খেলাটাও বুঝতে পেরেছি। সে যদি কাউকে খেলতে স্ট্রাগল করে তখন আমি সেটা কভার করি। আবার আমি যদি সমস্যা মনে করি সে তখন সেটা কভার করার চেষ্টা করে। আমরা এই জিনিস গুলো বেশ ভালোভাবে তৈরি করেছি। আপনি দেখে থাকবেন আমরা যখনই একসাথে ব্যাট করেছি বেশিরভাগ সময়ই বড় জুটি গড়েছি।’
দু’জনের মধ্যে বোঝাপড়াও আছে বেশ। দু’জনের পরিকল্পনাও এখন পর্যন্ত সার্থক। বাবরের মতে দু’জনেরই চেষ্টা থাকে সর্বোচ্চ বল খেলা এবং দ্রুত রান বের করা। বাবর বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি যদি আপনার কাছে মোমেন্টাম থাকে তাহলে আপনার সেটা ব্যবহার করা উচিত ঠিকভাবে। আমাদের মধ্যে যদি কেউ বল ভালো স্ট্রাইক করতে পারে তাহলে আমরা চেষ্টা করি পজিটিভ থেকে যতটা সম্ভব দ্রুত রান বের করা। এবং নিজেদের ফর্মে থাকার সুবিধাটা নেওয়া। সবসময়ই মাইন্ডসেট ঠিক রাখা উচিত। আমাদের পরিকল্পনা থাকে একজন অন্তত যাতে ইনিংসের সর্বোচ্চ বল খেলতে পারে।’
ওপেনিংয়ে সেরাটা দেখা গেলেও মিডল অর্ডার চিন্তার বিষয় পাকিস্তানের জন্য। একই সাথে ডেথ বোলিংয়েও দূর্বলতা বেশ কয়েক সিরিজ ধরেই। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমরা দুইটা জায়গায় স্ট্রাগল করছি। মিডল অর্ডারে ব্যাটিং এবং ডেথ ওভারে বোলিং। আমরা এই জায়গাগুলোতে বেশ কিছু পরিবর্তন এনেও দেখেছি। কিন্তু এটাই ক্রিকেট, আপনি যাকে নির্বাচক করবেন বা দলে নিবেন সে যে প্রত্যাশা অনুযায়ী ভালো খেলবে এমন নিশ্চয়তা নেই। উত্থান-পতন থাকবেই! আমরা তাদেরকে নির্বাচিত করেছি যারা সব ক্ষেত্রেই নিজের সেরা পারফরম করেছে। দলে টিকে থাকতে হলে অবশ্যই আপনাকে নিজের সেরাটা দিতে হবে। নাহলে বেশিরভাগ ম্যাচই বেঞ্চে কাটাতে হবে!’
পাকিস্তান সুপার লিগের (পিএসএল) এবারের আসরে প্রায় ৬০ এর কাছাকাছি গড়ে ৪৭৩ রান করেছে বাবর। তবে, স্ট্রাইক রেট নিয়ে হয়েছেন বেশ সমালোচনা। যদিও ১২৪ স্ট্রাইক রেট টি-টোয়েন্টির বিচারে খারাপ নয়, তবে নামটা যেহেতু বাবর আজম তাই সমর্থকদের প্রত্যাশার পারদটাও থাকে একটু উপরেই।
পাকিস্তান অধিনায়ক জানান, ‘আমি যদি ১০-১২ ওভার পর্যন্ত টিকে থাকতে পারি আমি আরো আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠি। এবং ডেথ ওভারে আরো আগ্রাসী ব্যাটিং করতে পারি। আমি সবসময়ই আমার লক্ষ্য থেকেও আরো উপরে যেতে চাই। এর মধ্যে স্ট্রাইক রেটে উন্নতির বিষয়টিও আছে। আমি প্রতিনিয়ত উন্নতি করতে চাই। যখন আপনি প্রোফেশনাল খেলা খেলছেন আপনি কোনো জিনিসে ১০০% ভালো হতে পারবেন না। আপনি যত উন্নতি করতে পারবেন আপনি তততাই ভালো খেলবেন।’
আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের লক্ষ্য নিয়ে তিনি বলেন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিকল্পনায় ম্যাচ বাই ম্যাচ এগোতে চায় পাকিস্তান। তবে ব্যক্তিগত লক্ষ্য শিরোপা জয়। তিনি বলেন, ‘আপনি বলতে পারবেন না আমরা কোথায় শেষ করবো। আমাদের ছোট ছোট লক্ষ্য আছে। প্রথমে ভারতের সাথে খেলা, তারপর নিউজিল্যান্ড এবং পরে আফগানিস্তান। আপনি যখন ছোট ছোট লক্ষ্য জয় করতে পারবেন, বড় লক্ষ্যগুলো এমনি পূরণ হয়ে যাবে। আমরা এই বিষয়ের উপরই আপাতত ফোকাস করছি। আপনি ভালো খেললে, সবকিছুই আপনার পক্ষে থাকবে। অধিনায়ক হিসেবে আমার লক্ষ্য বিশ্বকাপ জয়। প্রতিটা দলের লক্ষ্যই এটা, তবে আমরা সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়েছি। আপাতত শুধু ম্যাচ বাই ম্যাচ ভালো খেলাটাই আমাদের লক্ষ্য। আশা করি ফলাফল আমাদের পক্ষেই আসবে।’
– ইএসপিএন ক্রিকইনফো অবলম্বনে