২০১১ বিশ্বকাপ ফিরিয়ে আনবে ভারত?

এবার কি তবে একটা পুনরাবৃত্তি হবে? ২০১১ থেকে ২০২৩। মহেন্দ্র সিং ধোনি থেকে রোহিত শর্মা? গ্যারি কার্স্টেন থেকে রাহুল দ্রাবিড়? কিংবা ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম থেকে নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে উৎসবের মঞ্চায়ন?

২০১১ বিশ্বকাপের পর আবারো ভারতে বিশ্বকাপ ফিরছে। শিরোপাটা কি তবে ফিরবে? এক যুগের আক্ষেপ কি ঘুচবে? প্রশ্ন অনেকগুলো। তবে তার উত্তর হতে পারে একটিই—  বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফি।

বিগত বছরগুলোতে আইসিসি’র টুর্নামেন্ট মানেই ভারতের পাশে নিশ্চিত ফেবারিট তকমার শব্দযোগ। এবারেও স্বাগতিক হিসেবে রয়েছে ফেবারিটদের তালিকায়। তবে তীরে এসে তরী ডুবানোর ধারাবাহিক তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়ত পেয়ে বসেছে ভারতকেও। ফেবারিট, তবে কেন যেন সেই শব্দে এবারে কোনো অহমিকার ছাপ নেই। কারো কারো কাছে উচ্চাশাও নেই।

কেন এমনটা? দুই মাস বাদেই বিশ্বকাপ। অথচ দলটা এখন পর্যন্ত সেরা দলটা নিয়ে মাঠেই নামতে পারেনি। বলাই বাহুল্য, এখন পর্যন্ত তাদের বিশ্বকাপের সম্ভাব্য একাদশটাই চূড়ান্ত হয়ে ওঠেনি। অবশ্য এর পিছনে দুর্ভাগ্য হিসেবে ধাওয়া করেছে, একাধিক ক্রিকেটারের ইনজুরি।

জাসপ্রিত বুমরাহ বাইশ গজ থেকে দূরে রয়েছেন, প্রায় বছর গড়াতে চলল। মিডল অর্ডারের প্রাণ শ্রেয়াস আইয়ার, লোকেশ রাহুলরাও মাঠের বাইরে রয়েছেন বেশ কিছু দিন হলো। ভারতের মতো দল তাদের জন্য বসে না থেকে বিকল্প তৈরির দিকে এগোবে, সেটিই স্বাভাবিক।

কিন্তু, অনেক কাটা ছেড়া, পরীক্ষা নিরীক্ষা করেও তেমন আশা জাগানিয়া কিছু বের হয়নি। তাই টিম ম্যানেজমেন্টকে চোখ রাখতে হচ্ছে, তাদের ফেরার অপেক্ষাতেই।রোহিত শর্মার এই দলটা অবশ্য শিক্ষা নিতে পারে ২০১১ বিশ্বকাপের ভারত স্কোয়াডের কাছ থেকে।

বিশ্বকাপজয়ী ঐ স্কোয়াডটার সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল, টিম পারফরম্যান্স। সবাই ছিল টিম পারফর্মার। বিরেন্দ্র শেবাগ শুরুর ম্যাচেই তুলেছিলেন ঝড়। বাংলাদেশের বিপক্ষে ১৭৫ রানের ঐ ইনিংসটা তো সেবারের বিশ্বকাপেরই সেরা ইনিংস হয়ে আছে। শচীন টেন্ডুলকার পুরো বিশ্বকাপেই ছিলেন ধারাবাহিক।

ভারতের বিশ্বকাপ জয়ে  গৌতম গম্ভীর কেমন অবদান রেখেছিলেন, তা আর নতুন করে না বলাই ভালো। যুবরাজ সিং তো সেবারের বিশ্বকাপে হয়েছিলেন ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট। ব্যাটে, বলে, ফিল্ডিংয়ে সব খানে রেখেছিলেন সমান আধিপত্য। অধিনায়ক ধোনি খেলেছিলেন ফাইনাল। আর ফাইনালে অমন ইনিংসটি যথেষ্ট তাঁকে অমর করে রাখতে।

সুরেশ রায়না, ইউসুফ পাঠান কিংবা রবিচন্দন অশ্বিন নিয়মিত একাদশের ছিলেন না। তবে ঐ বিশ্বকাপে তাদেরও অবদান কম নয়। যেমন কোয়ার্টার ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অশ্বিনকে দিয়ে বোলিং শুরু করিয়েছিলেন। যার ফল মিলেছিল হাতেনাতে।

সুইপ করতে গিয়ে বোল্ড হয়ে ফিরে যান শেন ওয়াটসন। এ ছাড়া বোলিংয়ের পাশাপাশি স্লগে হিট করার ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন কিছু কার্যকরী ইনিংস খেলেছিলেন পাঠান, রায়না— দুজনই।

বোলিং ইউনিটে জহির খান ছিলেন সর্বেসবা। শহীদ আফ্রিদির সাথে যুগ্মভাবে তিনিই তো টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী বোলার ছিলেন। সাথে মুনাফ প্যাটেলও নিজের মিতব্যয়ী বোলিং দিয়ে দলকে দারুণ সহযোগিতা করেছিলেন। হরভজন সিংয়েরই বা অবদান কম কিসে? উইকেট কম পেয়েছেন। কিন্তু প্রতিপক্ষে চাপ ফেলতে তাঁর স্পিনের জুড়ি ছিল।

মূলত, সেবারের বিশ্বকাপে দলগত প্রচেষ্টাই ভারতকে এগিয়ে দিয়েছিল। রোহিত শর্মাকে ২০১১ এর পুনরাবৃত্তি ঘটাতে হলে দলকে সেই ১২ বছর আগের মতো একটা টিম হয়ে খেলতে হবে।

শেষ কয়েক বছরে ভারতের কোনো ট্রফি না জেতার মূল কারণটা যদি ব্যখ্যা করা যায়, ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ছন্দে ছিলেন সুরিয়াকুমার যাদব আর বিরাট কোহলি। এ ছাড়া কেউই তেমন ধারাবাহিক ছিলেন। আর দল হয়ে পারফর্ম না করার কারণেই তাঁর সেমিতেই বিদায় নিয়েছিল।

একই ভাবে ২০১৯ বিশ্বকাপেও ভারতের পরিণতি হয়েছিল এমন। রোহিত শর্মা ব্যাট হাতে রীতিমত রানবন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু দলের অন্য ব্যাটাররা ছন্দটা দেখাতে পারেনি। তাছাড়া, সেবার মিডল অর্ডার নিয়ে ভারতের বেশ কিছু বাজে সিদ্ধান্ত তো ছিলই এর মূলে।

মূলকথা হলো, ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয়, চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য একটা দলকে দল হয়েই পারফর্ম করতে হয়। শেষ কয়েকটা বিশ্বকাপের উদাহরণ টেনে আনলেই হয়। ২০০৭ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বলতে গেলে ১১ জনই পারফর্ম করেছিল। ম্যাথু হেডেন ঐ বিশ্বকাপে ৬৫৯ রান করেছিলেন।

তাঁর আরেক জুটি গিলক্রিস্ট তো একাই ফাইনালে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে দিয়েছিলেন। এ ছাড়া রিকি পন্টিং, অ্যান্ড্রু সাইমন্ডসরা কার্যকরী ইনিংস খেলেছিলেন। বোলিংয়ে গ্লেন ম্যাকগ্রার পাশাপাশি শন টেইটও দারুণ বল করেছিলেন।

এক বিশ্বকাপ বাদে ২০১৫ বিশ্বকাপের শিরোপাও যায় অস্ট্রেলিয়ার ঘরে। আর সেবারের মিশনেও দলগত নৈপুণ্যে শিরোপা জিতেছিল অজিরা। ব্যাটিংয়ে হাল ধরেছিলেন স্টিভ স্মিথ, ওয়ার্নাররা। আর বোলিংয়ে নজর কেড়েছিলে মিশেলে স্টার্ক, মিশেল জনসন আর ফকনাররা।

২০১৯ বিশ্বকাপ দিয়ে প্রথম বারের মতো ওয়ানডে বিশ্বকাপজয়ের স্বাদ পেয়েছিল ইংলিশরা। সেবারের বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক ব্যাটারদের সেরা ১০-এর মধ্যে ৪ জনই ছিলেন ইংল্যান্ডের। জো রুট আর জনি বেয়ারস্টো পেরিয়েছিলেন ৫০০ রান। আর স্টোকস, জেসন রয় পেরিয়েছিলেন ৪০০ রান। এর সাথে অধিনায়ক ইয়ন মরগান, জশ বাটলাররাও দারুণ কিছু ইনিংস খেলেছিলেন। ইংল্যান্ড বিশ্বজয়ের পথে এগিয়েছিল এভাবেই।

এর সাথে বোলিংয়ে দারুণ রসদ যুক্ত করেছিল জোফরা আর্চারের পেস আগ্রাসন আর ক্রিস ওকসের ক্যালকুলেটিভ বোলিং। আর এভাবে দলগত নৈপুণ্যেই সেবারের বিশ্বকাপ জিতেছিলে ইংলিশরা।

মোদ্দাকথা, এই সময়ের ক্রিকেটে এসে বৈশ্বিক কোনো টুর্নামেন্টে ফেবারিট তকমা আদৌতে বিশেষ কিছু যোগ করে না। উল্টো, সমর্থকদের প্রত্যাশার চাপটাই একটা দলকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দেয়। শেষ কয়েক বছরে, ভারতের হয়েছে এই দশাই। নামে ভারে, দারুণ শক্তিশালী দল গড়েও তাঁরা শিরোপা জিততে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ তাঁরা দল হয়ে খেলতে পারেনি।

বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে চাপ থাকবেই। তবে সেই চাপকে জয় করে দলগত পারফরম্যান্সের সম্মুখ গতিতে এগিয়ে যেতে হয়। এবারের বিশ্বকাপে ভারতকে এই পন্থায় অবলম্বন করতে হবে। তবেই হবে ২০১১ বিশ্বকাপের পুনরাবৃত্তি। ১২ বছর আগে মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ের গ্যালারির উৎসব এবার মঞ্চস্থ হতেই পারে আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে।

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link