নিষিদ্ধ গোলাপের তেজ

১.

ফুয়ের্তো অ্যাপাচের গ্যাঙ ওয়ারের বুলেটযুদ্ধ করা অপরাধীরা তখন একত্রিত হয়ে চোখ রেখেছে টিভির দিকে। ইস্টাডিও সাউসালিতো স্টেডিয়ামের কোনো এক শীতকালীন ভোরবেলা। পুরো ম্যাচ সাইডলাইনে কাটিয়ে টাইব্রেকারের সময় জাল থেকে কিছু দূরে বল রাখে ফুয়ের্তো অ্যাপ্যাচের হৃৎস্পন্দন।

সময় বোধকরি ২০১৫। বিপক্ষ জাল পাহারা দিচ্ছে সারা ম্যাচে মেসি-অ্যাগুয়েরো-বানেগাদের আক্রমণের নিষিদ্ধ দেওয়াল তোলা কলম্বিয়ান ডেভিড অসপিনা। বল মারতে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসে সেই আর্জেন্টিনিয়ান। মাথার উপর আগের কোপায় পেনাল্টি নষ্টের চাপ।

বলে পা চালাল, বল চুম্বকের মতো ছুঁয়ে নিল জালকে। নীল সাদা সমুদ্রে উত্তাল ইস্টাডিও সাউসালিত। ফুয়ের্তে অ্যপাচের অপরাধীরা গ্যাংওয়ার ভুলে আলিঙ্গনে মত্ত একে অপরের। একটাই নাম আওড়াচ্ছে তারা – Carlitos….! Carlitos…..! Carlitos….!

২.

ওল্ড ট্র‍্যাফোর্ডের ডান দিকে যে রাস্তাটা চলে গেছে, তাঁর পাশেই ইউনাইটেডের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীরা আকাশী রঙের একটা বিশাল পোস্টার আটকেছে। যার নামে পোস্টার তিনি হলেন কার্লোস আলবার্টো তেভেজ। সেই বছরেই ওল্ড ট্র‍্যাফোর্ডের লাল জার্সির দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি প্রত্যাহার করে পা বাড়িয়েছে ইত্তিহাদে। পোস্টারে বড় করে আকাশী ম্যানচেস্টারেরা লিখেছে – ‘ম্যানচেস্টারে স্বাগতম!’

কিছু রেড ডেভিল সেটাকে বিকৃত করে লিখে ফেলে – ‘ক্যারিয়ারের শেষ প্রান্তে স্বাগতম!’ নজর এড়ায়নি দলবদলের নায়কেরও। মাথায় ছিল অপমানটা। এফএ কাপের খেতাব জিতে সমর্থকদের একটা টিফো সে তুলে ধরেন, ওখানে লেখা – RIP Fergie। আপনারা বলবেন ঘৃণিত, নিষিদ্ধ। আমি বলি – ফুটবলের অভিমানী বিদ্রোহী!

৩.

১০ মাস বয়সে গরম জল ছিটকে গলার উপর থেকে বুকের মাঝখান অবধি, সৃষ্টি হয়েছিল ক্ষতের। ফুটবল সাম্রাজ্যের ‘কর্ণ’ হবার পর তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল এখনও আর্থিক স্বচ্ছলতা সত্ত্বেও সেই দাগ কেনো মেরামত করেননি। তিনি বলেছিলেন, ‘এই দাগ মনে করায় আমি কি ছিলাম আর এখন আমি কি। এই দাগ আমার গর্ব।’

আহা! পৃথিবীর নিষিদ্ধ ঘৃণিত এক মানুষের সাবলীল স্বীকারোক্তি যার প্রতিটা বর্ণের প্রত্যয়ে ‘সংগ্রাম’-এর ছায়া।

নিষিদ্ধ উপত্যকার রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় অপরাধের হাতছানি। আর্জেন্টিনার ফুয়ের্তো অ্যাপাচে। অপরাধের আঁতুরঘর। এরকম একটা পরিস্থিতিতে বাবা-মার পরিত্যক্ত এক সন্তান হয়ে বিশ্বে পা রাখার জন্য যে স্পৃহা লাগে সেই স্পৃহাই তাঁকে করেছিল ‘এল অ্যাপাচে’, করেছিল ‘ম্যান অফ পিপল’। যার পা পড়লে ফুটবলের উন্মাদনা সরিয়ে ফেলত ফুয়ের্তে অ্যাপ্যাচের অপরাধকে। যার পেনাল্টি শ্যুট আউটের গোলটা আর্জেন্টিনাকে সেমিতে নিয়ে যায়নি, তার থেকেও বড় কথা, বিভিন্ন গ্যাঙওয়ারকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল অপরাধের নেশাটা, নেপথ্যে গ্যাঙ লিডারদের সেই মিলিত সম্ভাষণ – ‘Carlitos!…Carlitos…!’

লিওনেল মেসির অনেক আগের ‘দ্বিতীয় ম্যারাডোনা’, বাতিস্তুতা-ম্যারাডোনার না ছুঁতে পাওয়া অলিম্পিকের স্বর্ণপদকটা নীল-সাদা রূপোর শহরে রেখে আসা ফুটবলের নিষিদ্ধ গোলাপ – কার্লোস আলবার্তো তেভেজ। পাহাড়ের খাদের মতো কেরিয়ারের একদিকে রয়ে গেছে অজস্র ঘৃণা, কখনও রেড ডেভিলদের অভিশাপ, কখনও বা রবার্তো ম্যানসিনির সাথে সংঘাত তাকে স্থান দেয় ঘৃণিত ফুটবলারের তকমা, আবার আরেকদিকে রয়ে গেছে ভালোবাসার সুউচ্চ পাহাড়, যে পাহাড় এক করে দেয় অপরাধসংঘাত, যে পাহাড়ের আগমনে গোটা বোকা জুনিয়র্স উদ্বেলিত হয়ে ওঠে জাতীয়তার স্লোগানে।

একদিকে জুটেছে ‘Where is Price,There is his Heart’ মন্তব্য, আবার অন্যদিকে সব্যসাচী হয়ে নিজের টাকা বিলিয়ে দিয়েছেন মালেশিয়ার সমাজকল্যাণে। একবার খবরের কাগজে বেরিয়েছিল – ‘The frequent Relocation is to Price his Heart away from is home।’ আসলে তাঁর হৃদয় পড়ে আছে বোকা জুনিয়রসের ওই সবুজে, যিনি জুভেন্তাসের সাদা-কালো জার্সির নীচেও বয়ে বেড়ান ফুয়ের্তো অ্যাপাচের নাম।

কিন্তু, ছেলেবেলায় টাকার বিনিময়ে তাকে কোরিয়েন্থাসে বিক্রি করে দেবার ক্ষোভ যেন প্রতিফলিত হচ্ছে সারাজীবনের অর্থতান্ত্রিক ক্যারিয়ারটাতে। আসলে কার্লোস তেভেজরা বিনয় নয়, জবাবে বিশ্বাসী। তাই তো ইংল্যান্ডের সর্বশ্রেষ্ঠ অধ্যাপকও রেহাই পায়নি তার বিদ্রোহী মননের হাত থেকে। সংবাদপত্রের খোদিত ‘অ্যান্টি-ইংলিশ ফুটবলার’-এর তকমাতে নেই কোনো আধুনিক টিকিটাকা, নেই শিল্পীর ডায়াগোনাল ক্রস কিংবা উইদাউট বল মুভমেন্ট। কিন্তু সেখানে আছে বলের সাথে লেগে থাকার ‘বিদ্রোহী’ মনন, লেগে আছে জোরালো শটে জাল ছিঁড়ে দেবার ধ্বংসাত্বক স্বীকারোক্তি – ‘আমাকে একা ছাড়বে, আমি সবাইকে নিয়ে ফিরবো। আমাকে টাকার বিনিময়ে বিক্রি করবে, আমি গুপ্তধন নিয়ে আসবো। আমাকে অপরাধ দেখিয়েছো, আমি বেছে নিয়েছি ফুটবলকে!

তিনি নির্ভয়ে অপরাধ জগতে হানা দেন নিজের অপহৃত প্রতিপালক কাকা সেগুন্ডো রাইমুন্ডো তেভেজকে উদ্ধার করতে। শক্তিশালী জার্মানিকে পরোয়া না করে ব্রেনগেমকে পাত্তা না দিয়ে উদ্যমের সাথে ঘোষণা করতে, ‘জার্মানরা দিবাস্বপ্ন দেখবে যদি ভাবে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে দেবে।’

ফুটবলের বাকি জগতের অ্যাড্রেনালিন একদিকে, আর কার্লোস তেভেজের অ্যাড্রিনালিন থাকবে অন্যদিকে। এক অন্য চরিত্র। এক নিষিদ্ধ গোলাপ যাকে চায়নি অনেকেই, চায়নি খোদ তার বাবা-মা, তবুও কাকার পদবী নিয়ে বিশ্বে সে দেখিয়েছিল ‘তেভেজ’ পদবীর জোরটা। তোমরা ‘তেভেজ’ বলো, আমি বাঙালি, তাই ‘তেজ’ বলি।

রোনালদো-নেইমারের আড়ালে জন্মদিনটা অবধি ভুলে যাওয়া হয়তো অন্ধকার অপরাধ জগতের ফুটবলময় চন্দ্রিল উপত্যকা তিনি। তবুও প্রতি অন্ধকারগলিতে জন্মাক এক একটা ‘তেজ’, যার উদ্ধত কণ্ঠ বলতে পারবে, ‘আমাকে অপরাধ দেখিয়েছো, আমি বেছে নিয়েছি ফুটবলকে!’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link