বিষাক্ত ফণায় নামে জ্যোৎস্না

ফাস্ট বোলারসুলভ উচ্চতা কিংবা দৈহিক গঠন, ভয়ংকর গতি কিংবা আক্রমণাত্মক শরীরী ভাষা কোনটাই ছিল না তাঁর। তবে নিজের দিনে তিনি ছিলেন টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানদের যম; প্রথম ওভারে উইকেট নেওয়াটাকে রীতিমতো অভ্যাসে পরিণত করেছিলেন যিনি! নতুন বলে বিষাক্ত সুইং আর নিখুঁত লাইন লেন্থ দিয়ে যিনি ভুগিয়েছেন সময়ের সেরাদেরকেও। বলছি শ্রীলঙ্কার ইতিহাসের অবিসংবাদিত সেরা ফাস্ট বোলার চামিন্দা ভাসের কথা।

বাঁ-হাতি মিডিয়াম পেসার ভাস ছিলেন একজন আদর্শ ‘নিউ বল বোলার’। ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ উইকেটই তিনি পেয়েছেন নতুন বলে। তাঁর ট্রেডমার্ক ডেলিভারি ছিল ডানহাতি ব্যাটসম্যানের ভেতরে ঢোকা লেট ইনসুইঙ্গার। তবে কনভেনশনাল সুইং বোলার হলেও ভাসের মূল শক্তিমত্তার জায়গা ছিল তাঁর অ্যাকুরেসি, কন্ট্রোল আর ব্যাটসম্যানকে রিড করবার ক্ষমতা।

কনসিস্টেন্ট লাইন অ্যান্ড লেন্থে টানা বল করে যেতে পারতেন ভাস। ফ্লাট পিচ থেকেও আদায় করে নিতেন সিম মুভমেন্ট। ব্যাটসম্যানকে বোকা বানাতে তাঁর কার্যকরী অস্ত্র ছিল অফ কাটার। যার কারণে সাবকন্টিনেন্টের স্পিন সহায়ক স্লো লো উইকেটেও ছিলেন দারুণ ইফেক্টিভ।

১৯৯০ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে তাঁর ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে হাতেখড়ি। একদিনের ক্রিকেটে ভাসের অভিষেক ১৯৯৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি, ভারতের বিপক্ষে। অভিষেক ম্যাচে ৮ ওভার বল করে ৪০ রান দিয়ে পেয়েছিলেন ওপেনার নভজোৎ সিং সিধুর উইকেট।

১৯৯৪ সালের ২৬ আগস্ট, ক্যান্ডিতে তাঁর অভিষেক টেস্টে প্রতিপক্ষ ছিল পাকিস্তান। সে ম্যাচে ৮০ রান দিয়ে উইকেটশূন্য ছিলেন তিনি। ১৯৯৫ সালে ডানেডিন টেস্টে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে ক্রিকেট বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল শ্রীলংকা। সে যুগে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে নিউজিল্যান্ডকে হারানোটা শ্রীলঙ্কার কাছে তো বটেই; বিশ্বের যে কোন দলের জন্যই ছিল অত্যন্ত কঠিন একটা কাজ।

উল্লেখ্য, দেশের বাইরে সেবারই প্রথম টেস্ট জয়ের মুখ দেখেছিল লংকানরা। আর ঐতিহাসিক এই অর্জনে ব্যাটে-বলে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন একুশ বছরের তরুণ চামিন্দা ভাস। বল হাতে দুই ইনিংসেই তিনি শিকার করেছিলেন ৫টি করে উইকেট (৫/৪৩ ও ৫/৪৭) আর ব্যাটিংয়ে নেমে দুই ইনিংসেই করেছিলেন ত্রিশোর্ধ্ব রান (৩৩ ও ৩৬)।

ম্যাচে ১০ উইকেট নিয়ে হয়েছিলেন ম্যাচ সেরা। আর দুই ম্যাচের সিরিজে মাত্র ১১.০৬ গড়ে ১৬ উইকেট নিয়ে জিতে নিয়েছিলেন সিরিজ সেরার পুরস্কারটাও। ১৯৯৬ বিশ্বকাপজয়ী শ্রীলংকা দলের নিয়মিত সদস্য ছিলেন ভাস; খেলেছেন ফাইনালসহ সবক’টি ম্যাচেই। ১০ ম্যাচে ২২ গড়ে তাঁর শিকার ছিল ১৫টি উইকেট। ইকোনমি মাত্র ৩.৬৭!

২০০০ সালে শারজায় অনুষ্ঠিত কোকাকোলা ট্রফির এক ম্যাচে মাত্র ১৪ রানে ৫ উইকেটের দুর্দান্ত এক স্পেলে ভারতের শক্তিশালী ব্যাটিং লাইনআপকে একাই ধসিয়ে দিয়েছিলেন ভাস।

সনাৎ জয়াসুরিয়ার ১৬১ বলে ১৮৯ রানের ‘টর্নেডো’ ইনিংসের ওপর ভর করে লংকানরা করেছিল ২৯৯ রান। জবাব দিতে নেমে ভাসের বিধ্বংসী বোলিংয়ের সামনে মাত্র ৫৪ রানেই অলআউট হয় ভারত।

২০০১ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হ্যাটট্রিকসহ মাত্র ১৯ রানের বিনিময়ে ৮ উইকেট নিয়ে গড়েছিলেন ওয়ানডে ইতিহাসের ব্যক্তিগত সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড (৮-৩-১৯-৮)। ভাসের বোলিং তোপে জিম্বাবুয়ে সেদিন গুটিয়ে যায় মাত্র ৩৮ রানে যা ওয়ানডেতে দলীয় সর্বনিম্ন রানের তৎকালীন রেকর্ড।

২০০১-০২ মৌসুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ৩ ম্যাচের টেস্ট সিরিজে ভাসের সংগ্রহ ছিল ২৬ উইকেট। সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব মাঠে সিরিজের শেষ ম্যাচে তিনি গড়েছিলেন অনন্য এক রেকর্ড। দুই ইনিংস মিলিয়ে একাই নিয়েছিলেন ১৪ উইকেট (৭/১২০ ও ৭/৭১)।

এশিয়ার মাত্র ২ জন পেসারের আছে এই কীর্তি। আরেকজন হলেন পাকিস্তানের কিংবদন্তী অলরাউন্ডার ইমরান খান। ২০০৩ বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি বোলার ছিলেন ভাস। মাত্র ১৪.৩৯ গড় আর ৩.৭৬ ইকোনমিতে ভাসের শিকার ২৩ উইকেট।

২০০৩ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিপক্ষে গ্রুপ পর্বের এক ম্যাচে হ্যাটট্রিকসহ মাত্র ৫ বলের মধ্যে নিয়েছিলেন ৪ উইকেট! ২৫ রানে ৬ উইকেট নিয়ে হয়েছিলেন ম্যাচসেরা। শুধু তাই নয়, ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম ও একমাত্র বোলার হিসেবে ইনিংসের প্রথম তিন বলেই হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেছিলেন ভাস।

২০০৪ সালে আইসিসি নির্বাচিত বর্ষসেরা টেস্ট এবং ওয়ানডে দুটি একাদশেই জায়গা করে নেন ভাস। ২০০৫ সালে দ্বিতীয়বারের মত আইসিসি মনোনীত বর্ষসেরা টেস্ট একাদশে স্থান দেয়া হয় তাঁকে।

২০০৬ সালে লর্ডসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ফলোঅনে পড়েও নিশ্চিত হারের হাত থেকে দলকে বাঁচিয়েছিলেন ‘ব্যাটসম্যান’ ভাস। নুয়ান কুলাসেকারাকে সাথে নিয়ে নবম উইকেট জুটিতে প্রায় ৫০ ওভারেরও বেশি সময় ‘অবিচ্ছিন্ন’ থেকে গড়েছিলেন ১১৫ রানের ‘ম্যারাথন’ এক জুটি! ১৩৩ বলে ৬৪ রান করে কুলাসেকারা আউট হলেও ভাস খেলেছিলেন ১৮৮ বলে ৫০ রানের হার না মানা এক ইনিংস।

২০০৭ সালের জুনে কলম্বো টেস্টে ‘প্রিয় প্রতিপক্ষ’ বাংলাদেশের বিপক্ষে হাঁকিয়েছিলেন ক্যারিয়ারের একমাত্র টেস্ট সেঞ্চুরি। ২০০৭ সালের অক্টোবরে ডাম্বুলায় ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে ইতিহাসের ‘কনিষ্ঠতম’ বোলার হিসেবে স্পর্শ করেন ৩০০ উইকেটের মাইলফলক। ভাসের ৩০০ তম শিকার হয়েছিলেন ইংলিশ ওপেনার অ্যালিস্টার কুক।

২০০৮ সালের মার্চে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে শ্রীলঙ্কার ‘প্রথম’ টেস্ট জয়টা এসেছিল ভাসের হাত ধরেই। বল হাতে দুই ইনিংস মিলিয়ে ভাস নিয়েছিলেন ৮ উইকেট (৩/৪৮ ও ৫/৬১) আর ব্যাট হাতে একটি ফিফটিসহ করেছিলেন ৬৭ রান।

২০০৮ সালে টেস্ট ইতিহাসের অষ্টম ক্রিকেটার হিসেবে ‘৩০০ উইকেট ও ৩০০০ রানের’ যুগলবন্দী অর্জন করেন ভাস। ‘বিরল’ এই ক্লাবের বাকি সদস্যরা হলেন ইমরান খান, কপিল দেব, স্যার রিচার্ড হ্যাডলি, ইয়ান বোথাম, শন পোলক, ড্যানিয়েল ভেটোরি ও শেন ওয়ার্ন।

২০০৮ সালে কলম্বোর প্রেমাদাসায় ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ‘বিদায়ী’ ম্যাচটি খেলেন ভারতের বিপক্ষে। সেই ম্যাচেই একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মাত্র ‘চতুর্থ’ বোলার (মুত্তিয়া মুরালিধরন, ওয়াসিম আকরাম এবং ওয়াকার ইউনুসের পর) হিসেবে ৪০০ উইকেটের মাইলফলক অর্জন করেন ভাস। যুবরাজ সিংকে বোল্ড করে নিজের ৪০০তম শিকারে পরিণত করেছিলেন তিনি।

ভাসের ক্যারিয়ারের শেষ টেস্টটি ছিল ২০০৯ সালের জুলাইতে পাকিস্তানের বিপক্ষে। কলম্বোয় অনুষ্ঠিত ম্যাচটি শেষ হয়েছিল অমীমাংসিতভাবে। ভাস নিয়েছিলেন ৪৩ রানে ১ উইকেট।২০১১ বিশ্বকাপের মূল স্কোয়াডে জায়গা না পেলেও ‘স্ট্যান্ডবাই’ তালিকায় রাখা হয়েছিল তাঁকে।

শুধু বল হাতেই নয়, লোয়ার অর্ডারে কার্যকরী ব্যাটসম্যান এবং ‘পিঞ্চ হিটার’ হিসেবেও ভাসের বেশ নামডাক ছিল। টেস্ট, ওয়ানডে ও টি২০ মিলিয়ে ব্যাট হাতে পাঁচ হাজারেরও বেশি রান সেই সাক্ষ্যই দেয়।

টেস্ট ক্যারিয়ারে একটি সেঞ্চুরির সাথে ১৩ টি ফিফটি আছে তাঁর। ব্যাটিং গড় ২৪.৩২!

খেলোয়াড়ি জীবন শেষে ভাস বেছে নিয়েছেন পেশাদার কোচিং ক্যারিয়ার। ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে বোলিং কোচের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০১২ সালে নিউজিল্যান্ড; ২০১৩,২০১৫ ও ২০১৭ সালে ‘তিন’ দফায় শ্রীলংকা, ২০১৬ সালে প্রথমে আয়ারল্যান্ড এবং পরে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বোলিং উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন ভাস।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভাসের বলে সবচেয়ে বেশিবার আউট হওয়া ব্যাটসম্যানদের তালিকাটা একটু দেখে আসি। সবচেয়ে বেশি ১৪ বার করে আউট হয়েছেন  সাঈদ আনোয়ার ও স্টিভেন ফ্লেমিং। ১২ বার করে শচীন টেন্ডুলকার, রিকি পন্টিং, ইনজামাম উল হক ও হার্শেল গিবস।

অন্যদিকে ১১ বার করে সৌরভ গাঙ্গুলি ও মার্কাস ট্রেসকোথিক। ১০ বার করে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট ও ক্রিস গেইল। মজার ব্যাপার হল, ক্রিস গেইল আর হার্শেল গিবস এই দুজনকে তিনি সর্বমোট ৭ বার করে ফিরিয়েছেন শূন্য রানে!

ঐতিহ্যগতভাবে শ্রীলঙ্কা বরাবরই স্পিননির্ভর দল। যেখানে বল হাতে আক্রমণের নেতৃত্বটা দিয়ে থাকেন স্পিনাররাই। এখানে পেসারদের মূল দায়িত্বটা থাকে স্পিনারদের যথাযথ সাপোর্ট দেয়া। চামিন্দা ভাসও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নন।

বল হাতে সবচাইতে ধারাবাহিক পারফরমারদের একজন হলেও ক্যারিয়ারজুড়ে তিনি ছিলেন ‘স্পিন জাদুকর’ মুরালিধরনের ছায়াসঙ্গী হয়ে। তবে এর মাঝেও নিজের জাত চেনাতে একদমই ভুল করেন নি তিনি।

মুরালির সাথে ভাসের কেমিস্ট্রিটা জমত দারুণ। টেস্ট ক্রিকেটের সফলতম বোলিং জুটিগুলোর একটা হচ্ছে এই ‘মুরালি-ভাস’ জুটি। দুজনে জুটি বেঁধে ৯৫ টেস্টে শিকার করেছেন ৮৯৫টি উইকেট!

১৯৯৪ সালে অভিষেক, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছেন ২০১১ সালে। মাঝখানে প্রায় দেড়যুগ সময় ধরে খেলেছেন অসম্ভব নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও ধারাবাহিকতাকে সঙ্গী করে। ক্রিকেটের তিন ফরম্যাট মিলিয়ে সাড়ে সাতশোরও বেশি উইকেট আর পাঁচ হাজারেরও বেশি রানের মালিক, কিংবদন্তি এই পেসারের নামটা কিন্তু বিশাল লম্বা! ওয়ার্নাকুলাসুরিয়া পাতাবেন্দিগে উশান্থা জোসেফ চামিন্দা ভাস!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link