ফুটবলের ‘ফরেস্ট গাম্প’

জীবনের অর্ধেকেরও বেশি সময় ফুটবল পায়ে রেখে কাটিয়েছেন, ফুটবলকে ধ্যান-জ্ঞান করেছেন, তবুও যদি তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, ফুটবল মাঠের কোন জায়গাটায় তাঁকে বেশি দেখা গিয়েছে, সে প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে থতমত খেয়ে যেতে হবে তাঁকে।

১৮ বছরেরও বেশি সময় ধরে ফুটবল খেলছেন, কখনও প্লে-মেকার, কখনও উইঙ্গার, কখনও ডিপ-লাইয়িং মিডফিল্ডার এবং কিংবা স্পেনের জার্সিতে ‘ফলস নাইন’ কিংবা উইথ ড্রন স্ট্রাইকার, কোনো জায়গায় পা পরেনি তাঁর? সেই সেস ফ্যাব্রিগাস একবার আফসোস করে বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয় গোলরক্ষক ছাড়া বাকি সব জায়গাতেই একটু না একটু খেলার অভিজ্ঞতা আছে।’

তবে যেখানেই থাকুন না কেন, ফুটবল মাঠের ঠিক জায়গায় ঠিক সময়ে তাকে খুঁজে পাওয়া যেত, হতে পারে সেটা বার্সেলোনার ক্যাম্পে কিংবা আর্সেন ওয়েঙ্গারের ছত্র ছায়ায়, অথবা ফ্রেঞ্চ রিভেরায়, ট্রফি কিংবা ট্যাক্টিক্স, প্রয়োজনে তাঁকে সবকিছুই হতে হয়েছে। যেখানে গিয়েছেন, নিজের মত করে সাজিয়েছেন নিজের পৃথিবী। সিনেমার রিল থেকে ফুটবলের পাতায় স্থান পাওয়া একবিংশ শতাব্দীর ফরেস্ট গাম্প যেন তিনি।

আর্জেন্টিনা থেকে লিওনেল নামের ছোট্ট একটা ছেলে যখন বার্সা একাডেমিতে পা রাখে, তখন সেস্কের বয়স মাত্র ১৩! বয়সের কাটা ১৬ তে পৌঁছুতে না পৌঁছুতেই আর্সেন ওয়েঙ্গারের হাত ধরে পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে, হয়ে যান ইনভিন্সিবলের সদস্য!

ইউরো-বিশ্বকাপ-ইউরো জিয়েছেন দোর্দণ্ড প্রতাপে, ইনিয়েস্তা-জাভি-বুস্কেটসের সাথে তার নামটাও যে খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে স্পেনের ইতিহাসে। বিশ্বজয়ী হওয়া গোলের কারিগর হয়ে এখনও লেখা আছে তারই নাম। ১৫ বছরের ক্যারিয়ারে তাঁর মাথার উপরে ছায়া হয়েছিলেন আর্সেন ওয়েঙ্গার, পেপ গার্দিওলা এবং হোসে মরিনহোর মতন মর্ডান ফুটবলের সেরা ট্যাক্টিশিয়ানরা।

কিন্তু সত্যি হচ্ছে বয়স বাড়ে, তিনিও বাড়ছেন। ৩৩ এ এসে বুড়ো হয়ে যাওয়া ফুটবল মায়েস্ত্রো আর যাই হোক, নিজেকে সেরা দাবি করতে পারেন না। নিজের সেরা খেলাটাও দিনের পর দিন চালিয়ে যেতে পারেন না, দিতেও পারেন না। তবুও ক্যারিয়ারের শেষ প্রান্তে এসে নিজের ক্যারিয়ারে সাফল্যের পেছনে ছোটা বন্ধ হয়নি, অন্তত বন্ধ হতে দেননি। দুই বছর আগেও শেষ দেখে ফেলা এএস মোনাকোকে নতুন করে পথ চেনাতে শুরু করেছেন সেস ফ্যাব্রিগাস!

৩৩ বছর বয়সী ফ্যাব্রিগাস এখন মাঠে নামা হয় বেশি বেঞ্চ থেকেই, ফ্রান্সের সর্বকনিষ্ঠ দলের দিক দিয়ে দ্বিতীয়তে থাকা মোনাকোর বয়সের গড় একাই বাড়িয়ে নিয়েছেন তিনি। তবে তার সাথে যুক্ত হয়েছে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা, গার্দিওলা, দেল বস্ক, মোরিনহো, ওয়েনঙ্গার; হেভি ওয়েট কোচদের অধীনে থেকে এত বছর যা শিখেছেন, সব বিলিয়ে দিচ্ছেন গাবেলস, পেলেগ্রি, ফ্লোরেন্তিনোদের মধ্যে। এক ঝাঁক তরুণ তুর্কির মধ্যে তিনি হয়ে গিয়েছেন ঝানু স্টেটসম্যান!

ফ্যাব্রিগাস নিজেও বড় হয়েছেন এই সিস্টেমের ভেতর দিয়েই। বার্সেলোনার জগৎখ্যাত ‘লা মাসিয়া’ সিস্টেম নিশ্চয় আপনাকে বলে দিতে হবে না, ছোট্টবেলা থেকে একই পদ্ধতিতে বড় হয়ে উঠেছেন সকলের সাথে, সেখান থেকে চুক্তির ফাঁক গলে তাঁকে নিয়ে লন্ডন পাড়ি জমিয়েছিলেন আর্সেন ওয়েঙ্গার।

আট বছর পর যখন বার্সেলোনায় ফেরত আসেন ফ্যাব্রিগাস, ততদিনে ইউরোপের সুন্দর ফুটবলের অধিকারী সেরা তিন দলেই নাম লেখানো শেষ তার। আর্সেন ওয়েংগারের জ্যাজ অ্যাটাকিং স্টাইল কিংবা স্পেন-বার্সায় টিকিটাকা, সব জায়গাতেই স্বাচ্ছন্দ্য ছিলেন তিনি।

এতটাই স্বাচ্ছন্দ্য যে ২০১২ ইউরো ফাইনালে তার উপরে ভরসা করেই ৪ ডিফেন্ডার, ছয় মিডফিল্ডার নিয়ে কোনো অ্যাটাক ছাড়াই নেমেছিলেন দেল বস্ক। ইতালির মতন আক্রমণে ভরপুর দলকেই এক হাল্লি গোল হজম করতে হয়েছিল সেদিন। ফ্যাব্রিগাস এমনই, দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পজিশনটাও কোচেরা বাজি রাখতে পারেন, শুধুমাত্র তার ফ্লুয়েডিটির কথা মাথায় রেখে।

ফ্যাব্রিগাসকে আরো বদলে দিয়েছিলেন অ্যান্তোনিও কন্তে। ইতালিয়ান ফুটবলে জুভেন্টাসের জয়যাত্রা শুরু করে দিয়ে এসেছিলেন চেলসিতে। হোসে মরিনহোর রেখে যাওয়া ফেব্রিগাসকে সেখানেই পেয়েছিলেন কন্তে। কন্তের হাতে পরবার আগ পর্যন্ত ফ্যাব্রিগাস ছিলেন প্লে-মেকার, পুরোটাই খেলতেন মাথা দিয়ে।

কিন্তু ফুটবল যত এগোচ্ছে, শুধু মাথা দিয়ে খেলা খেলোয়াড়দের প্রয়োজনীয়তাও কমছে তত। বেড়েছে মাথার পাশাপাশি গা লাগিয়ে খেলা খেলোয়াড়দের প্রাধান্য। কন্তে সেটাই করেছিলেন, ফ্যাব্রিগাসকে তুলে এনে বানিয়েছিলেন ফিজিক্যাল প্লেয়ার। শুধু মাথার উপর খেলতে থাকলে হয়তো আরো আগেই হারিয়ে যেতে হত তাকে, কিন্তু কন্তের বদলে দেওয়া ফিজিক্যাল ফ্যাব্রিগাস এখনও মাঠ দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন নিজের সেরাটা দিয়ে।

ফেব্রিগাস নিজের ক্যারিয়ারের ১৫ বসন্ত খেলেছেন মিডফিল্ডের ‘উজবুক’ হয়ে, তাঁর খেলার জায়গার অভাব ছিল তা নয়, ছিল; যে জায়গাতেই গিয়েছেন মানিয়ে নিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু নির্দিষ্ট ছিল না। টম হ্যাঙ্কসের ‘ফরেস্ট গাম্প’-এর মতো। গল্পের ভিড়ে তাঁর গল্পের অভাব হচ্ছে না। কিন্তু দিন শেষে, তার পরিচয়টাও নির্দিষ্ট না। তাই ক্যারিয়ারের পড়ন্তবেলায় এসে যখন কচিকাঁচাদের নিজের অভিজ্ঞতা বিলিয়ে দিচ্ছেন, সেখানেই যেন নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন তিনি।

ইউরোপের ‘ফরেস্ট গাম্প’, দৌড়ে চলুন যতটা পারেন, নিজের মতো করে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link