ভারতীয় দলে পালাবদলের হাওয়া

ইংল্যান্ড অধিনায়ক জস বাটলার যখন লং অনের উপর দিয়ে বলটাকে সীমানার ওপারে আছড়ে ফেললেন, তখন ক্যামেরায় এক মূহুর্তের জন্য ধরা পড়েছিল বিরাট কোহলির হতাশাপূর্ণ মুখ। কাকতালীয়ভাবেই ধারাভাষ্যকক্ষ থেকে রবি শাস্ত্রী বলে উঠলেন, সর্বশেষ! কোহলি।

ভারতের বিশ্বকাপ শেষ হবার পাশাপাশি কোহলির টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারেরও ইতি টেনে দিলেন ভারতের সাবেক এই কোচ? এবারের বিশ্বকাপে টপ অর্ডারে ব্যর্থদের একজন হিসেবে দায়টা তো কোহলির কাঁধেও বর্তায়। তাঁর পাশাপাশি রোহিত শর্মা এবং কোচ রাহুল দ্রাবিড়ের ক্যারিয়ারও এখন হুমকিতে। 

তরুণ এবং আক্রমণাত্নক মানসিকতার তরুণদের নিয়ে নতুন করে দল সাজানোর এটাই সেরা সময় ভারতের জন্য। নতুন দলটা হয়তো রাতারাতিই সাফল্য এনে দিতে পারবে না। কিন্তু পুরনো দলটাও তো বড় টুর্নামেন্টে বারবার ব্যর্থ। সুতরাং নতুনদের উপর বাজিটা ধরাই যায়। তাছাড়া খেলাধুলায় আবেগের স্থান নেই, সাফল্যের জন্য কঠিন সিদ্ধান্তটা নেয়া অনস্বীকার্য। 

এবারের বিশ্বকাপে ভারত কোনো ম্যাচেই নিজেদের সেরাটা দিতে পারেনি। কিন্তু ভাগ্যের সহায়তা এবং ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের কারণে সেমির আগে দুর্বলতাগুলো সেভাবে চোখে পড়েনি। পাকিস্তানের বিপক্ষে কোহলির অবিশ্বাস্য ব্যাটিংয়ের সুবাদে মাত্র আট বলে ম্যাচের চিত্রনাট্য বদলে জিতে যায় ভারত। আর বাংলাদেশ তো হেরেছে নিজেদের ব্যর্থতায়, হাতের মুঠোয় থাকা ম্যাচ স্রেফ চাপ সামলাতে না পেরে হেরে যায় সাকিব আল হাসানের দল।

সেদিন বৃষ্টিটা না থামলেই পরাজয় বরণ করতে হত ভারতকে। সত্যিকারের বড় পরীক্ষার ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সহজেই হেরে গিয়ে ভারত দেখিয়েছিল তাঁদের দলে দুর্বলতা প্রচুর। পার্থের গতিশীল পিচে প্রোটিয়া পেসারদের সামনে মুখ থুবড়ে পড়েছিল ভারতের বিখ্যাত ব্যাটিং লাইনআপ। একটা দিন বাজে যেতেই পারে, এটা ভেবেই হয়তো সেদিন পার পেয়ে গিয়েছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটারটা। কিন্তু সেই ব্যর্থতা থেকে ভারত বেরোতে পারেনি সেমিফাইনালেও। 

ম্যাচ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে রোহিত শর্মা হারের কারণ হিসেবে বলেন, ‘আমরা পরিকল্পনা কাজে লাগাতে পারিনি। যখন আপনার সাথে এরূপ ঘটবে, আপনি বুঝতে পারবেন বিপদে পড়েছেন।’ রোহিত অবশ্যই ঠিক বলেছেন, কিন্তু পরিকল্পনা কাজে লাগাতে না পারাই ভারতের ব্যর্থতাঁর একমাত্র কারণ নয়।

টি-টোয়েন্টিতে ভারতের সবচেয়ে বড় পারফর্মার হচ্ছেন অলরাউন্ডার হার্দিক পান্ডিয়া। তাঁর ৬৩ রানের ইনিংসের সুবাদেই সেমিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে লড়াকু সংগ্রহ পেয়েছিল ভারত। অন্যদিকে ব্যাটিংয়ে সুরিয়াকুমার যাদব ভারত তো বটেই বর্তমানে বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান। অথচ এই দুজনকে বেশিরভাগ ম্যাচে ব্যাটিং এ নামতে হয়ে ১৩ কিংবা ১৪ ওভারের পরে। এবারের বিশ্বকাপে বল হাতে নিজের সামর্থ্যের জানান দিয়েছেন তরুণ আর্শদ্বীপ সিং। কিন্তু তাঁর অফ ফর্মের দিনে যোগ্য সঙ্গ দিতে পারেননি কেউই। সেমিতে নিষ্প্রভ ছিলেন আর্শদ্বীপ, ভারতও হেরেছে ১০ উইকেটের বিশাল ব্যবধানে। 

তবে, এবারের বিশ্বকাপে ভারতের ব্যর্থতার সবচেয়ে বড় কারণ টপ অর্ডারের মন্থর ব্যাটিং। রাহুল, রোহিত, কোহলি তিনজনই বিস্ফোরক শুরুর বদলে খানিকটা ধীর গতিতে শুরু করতে পছন্দ করেন। আইপিএলে তিনজনই ভিন্ন দলে খেলায় তেমন সমস্যা না হলেও জাতীয় দলে হয়ে দাঁড়ায় বিপদের কারণ। কোচ এবং অধিনায়ক দুজনেই দল নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালালেও বিশ্বকাপে ভারত গিয়েছে সেই পুরনো দল নিয়েই।

ঋষাভ পান্তকে ওপেনিং এ খেলানোর সুযোগ থাকলেও সে পথে হাঁটেনি টিম ম্যানেজমেন্ট। তিন নম্বরে সুযোগ পেয়ে দারুণ এক সেঞ্চুরি হাঁকালেও এক সিরিজ পরেই ব্যাটিং অর্ডারে নিচে নামতে হয়েছে দীপক হুডাকে। হয়তো অস্ট্রেলিয়ার কন্ডিশনে হুডা সফল হতেন না, কিন্তু পারফর্ম করার পরও ব্যাটিং অর্ডারে অবনমন এটাই বার্তা দেয় টপ অর্ডারের নামগুলো অপরিবর্তনীয়। 

মোহাম্মদ শামিরও থাকার কথা ছিল না এবারের বিশ্বকাপ দলে। কিন্তু জাসপ্রিত বুমরাহর অপ্রত্যাশিত ইনজুরির কারণে একপ্রকার বাধ্য হয়েই তাঁকে দলে ডাকে টিম ম্যানেজমেন্ট। এমনকি টানা ব্যর্থতার পরও আক্সার প্যাটেল সুযোগ পেয়ে গিয়েছেন একাদশে, অথচ বেঞ্চে ছিলেন যুজবেন্দ্র চাহালের মত লেগস্পিনার।

অন্য সব দলেই যেখানে একাদশের নিয়মিত মুখ ছিলেন লেগস্পিনাররা, সেখানে চাহাল পুরো টুর্নামেন্টে সুযোগ পাননি কোনো ম্যাচেই। বলাই বাহুল্য লেগস্পিনার খেলানোর সাহসী সিদ্ধান্তের চাইতে রক্ষণাত্নক থাকতেই বেশি পছন্দ করেছেন কোচ এবং অধিনায়ক। 

অস্ট্রেলিয়াতে হ্যাটট্রিক থাকা সত্ত্বেও কোনো ম্যাচেই একাদশে জায়গা পাননি হার্শাল প্যাটেল। পাকিস্তান, ইংল্যান্ড দুই দলই যেখানে প্রাধান্য দিয়েছে গতিশীল পেসারদের, উমরান মালিককে বাদ দিয়ে ভারত হেঁটেছে  উল্টো পথে। 

সেমিফাইনালে হারের পর সুনীল গাভাস্কারও তাই দলে চাইছেন নতুন মুখ। তিনি বলেন, ‘হার্দিক পান্ডিয়ার নেতৃত্বে নতুন এক দল নিউজিল্যান্ড সফরে যাচ্ছে। অবশ্যই নির্বাচক কমিটির ইশারাতেই এমনটা ঘটছে। হার্দিক নিজের প্রথম আইপিএল মৌসুমেই শিরোপা জিতেছে এবং তাঁর অধীনে খেলোয়াড়দের উজ্জীবিত মনে হয়েছে। অনেকগুলো অবসরের ঘটনা ঘটতে পারে, ত্রিশোর্ধ্ব অনেকেই নিজের ক্যারিয়ারের শেষের শুরু দেখতে পেয়েছেন।

তাঁর সতীর্থ এবং ভারতের সাবেক কোচ রবি শাস্ত্রীও কথাতেও পরিবর্তনের সুর। শাস্ত্রীর ভাষ্যমতে, ‘দলে অপেক্ষাকৃত নতুনদের দরকার। ভবিষ্যতের জন্যই এই পরিবর্তনটা দরকার ভারতের।’

আইপিএলের সুবাদে ভারতের ক্রিকেট আঙ্গিনায় টি-টোয়েন্টি তারকার ছড়াছড়ি। তরুণ ক্রিকেটাররা মুখিয়ে আছেন নিজেদের সামর্থ্যের জানান দেবার। তাঁদের নিয়ে সাফল্যময় এক ভবিষ্যৎ হাতছানি দিচ্ছে। কিন্তু ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্ট কি সেই ডাকটা শুনতে পাচ্ছেন?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link