বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ড এক দুর্ভাগা টিম, আরেক দুর্ভাগা টিম হল দক্ষিণ আফ্রিকা! অনেক ভালো টিম নিয়েও বিশ্বকাপ অধুরাই থেকে গেছে এই দুটি টেস্ট খেলিয়ে দেশের। ১৯৯২ সালে নিউজিল্যান্ডের স্বপ্নের দৌড় সেমিফাইনালে থেমে গিয়েছিল ইনজামামের হাতে, আর গত দুই বিশ্বকাপে তো ওরা রানার আপ।
কিন্তু, আজকে যে ম্যাচ বা বলা ভালো যে বিশ্বকাপ হিরোর সম্পর্কে আলোচনা করবো, সেটা বিস্মৃতপ্রায়! ১৯৯৬ সালের শেষ কোয়ার্টার ফাইনাল অস্ট্রেলিয়া বনাম নিউজিল্যান্ড নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয়না। কিন্তু আলোচনার উপাদান কিছু কম ছিলনা এই ম্যাচে।
চেন্নাইয়ের চিপকের চিদাম্বরম স্টেডিয়ামে এটি ছিল প্রথম নৈশালোকে খেলা ক্রিকেট ম্যাচ! নিউজিল্যান্ড টসে জিতে ব্যাটিং নেয় কিন্তু তিন ওভারের মধ্যে বোর্ডে ২০ রান ওঠার আগেই দুই ওপেনার নাথান এস্টলে ও ক্রেগ স্পিয়ারম্যান ড্যামিয়েন ফ্লেমিং ও পল রাইফেলের বলে আউট হয়ে প্যাভিলিয়নে ফেরেন। অজানা কোনো কারণে সেদিন ম্যাকগ্রা বোলিং ওপেন করেননি, তিনি ফার্স্ট চেঞ্জ হিসেবে আসেন।
তিন নম্বরে নিজেকে প্রমোট করেন ৯৬ বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক ও উইকেটরক্ষক লি জার্মন (যিনি টেস্ট ও ওয়ান ডে উভয় ফরম্যাটেই অভিষেক ম্যাচেই অধিনায়ক হয়েছিলেন!)। এই ভদ্রলোককে নিয়েও খুবই কম কথা হতে দেখেছি!
কিন্তু এই ম্যাচে তিনি খেলেছিলেন এক ক্যাপ্টেনস ইনিংস। অন্যদিকে ৪ নম্বরে নামা স্টিফেন ফ্লেমিং মাত্র ৮ রান করে যখন ম্যাকগ্রার বলে আউট হলেন, দলের রান তখনো ৫০ পেরোয়নি। লি জার্মন কিন্তু অস্ট্রেলিয়ান বোলারদের তোয়াক্কা না করে আক্রমণ করে যাচ্ছিলেন।
এটা একটা নক আউট ম্যাচ এবং অস্ট্রেলিয়ার বোলিংকে মাথায় চড়তে দিলে যে এই ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের কোনো আশা থাকবে না, সে বিষয়ে লি পুরোপুরি অবগত ছিলেন এবং সেইজন্যেই বেনজির আক্রমণ করতে থাকেন তিনি অস্ট্রেলিয়ান বোলারদের। সঙ্গে পেয়ে যান পাঁচ নম্বরে নামা বোলিং অলরাউন্ডার ক্রিস হ্যারিসকে।
তিনিই আজকে আমার লেখার মূল চরিত্র। পাঁচ নম্বরে নেমে অধিনায়ককে সাহায্য করার বদলে তিনিই অস্ট্রেলিয়ান বোলিংকে আক্রমণ করার প্রধান দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। ৩ উইকেট ৪৪ রানে পড়ে যাবার পরে এরকম কাউন্টার অ্যাটাক ৯৬ সালে বিরল ছিল। সত্যি কথা বলতে ক্রিস হ্যারিসকে তার আগে আমি ব্যাট করতে দেখিনি সেভাবে আর তাঁর হাতে যে এতো স্ট্রোক আছে সেও আমার অজানাই ছিল।
প্রকৃত ফিয়ারলেস ক্রিকেট খেলে তাঁরা রান রেট ৬ এর কাছাকাছি রেখে দলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন। একটু উইড্থ দিলেই লফটেড ড্রাইভ আর শরীরে শর্ট বল করলে শর্ট আর্ম পুল করে বাউন্ডারির পর বাউন্ডারি কুড়োতে থাকেন হ্যারিস। একসময় রান রেট চলে যায় ৬ এর উপরে। শেন ওয়ার্নকে লি ও হ্যারিস দুজনেই বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে পেটাতে থাকেন। বাদ যাননি ম্যাকগ্রাও। তিনিও জার্মনের হাতে ভালোই ধোলাই খান।
বিশেষ করে মিড্ উইকেট দিয়ে স্টেপ আউট করে পুল করে ছয়টা বহুদিন মনে থাকবে। ১৬৮ রানের পার্টনারশিপ করে দলকে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দিয়ে ম্যাকগ্রাকে স্টেপ আউট করতে গিয়ে লং অফে ব্যক্তিগত ৮৯ রানের মাথায় ধরা পড়েন লি জার্মান।
কিন্তু, হ্যারিস চালিয়ে যান এবং ৯৬ বলে নিজের সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন। পরবর্তী কোনো ব্যাটসম্যানের সাহায্য না পাওয়ায় নিউজিল্যান্ডের স্কোর ৩০০ পার হয়নি, ২৮৬/৯ রানে তাদের ইনিংস শেষ হয়, কিন্তু ক্রিস হ্যারিস এক অলৌকিক ১৩০(১২৪) রানের ইনিংস খেলেন। আউট হন যখন দলের স্কোর ২৮২, এবং দলের অষ্টম উইকেট হিসেবে তাঁর পতন হয়।
২৮৭ রানের টার্গেট ৯৬ সালে মোটেও সহজ ছিলোনা, আমরা সকলেই এটাকে উইনিং স্কোর ভেবেছিলাম। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার শিল্পী ব্যাটসম্যান মার্ক ওয়াহ নিজের জাত চেনানোর জন্যে এই ম্যাচটিকেই বেছেছিলেন। অস্ট্রেলিয়া শুরুটা স্লো করলেও, মার্ক টেলর আউট হবার পরে ওয়াহ আর পন্টিং খেলা ধরেন।
উইকেটের চারদিকে কাট, পুল আর এলিগেন্ট ড্রাইভের ফুলঝুরি ছুটিয়ে মার্ক ওয়াহ ১১০(১১২) রানের এক ঝকঝকে ইনিংস উপহার দেন। রান রেট বাড়ানোর জন্যে এই ম্যাচে শেন ওয়ার্নকে চার নম্বরে তুলে আনা হয়েছিল এবং তিনি ১৪ বলে ২৪ করে নিজের কাজ করে দেন। স্টিভ ওয়ার সাথে তাঁর ভাই ৮৬ রানের পার্টনারশিপ করেন এবং দলের ১৯৩ রানের মাথায় মার্ক ওয়া নিজের সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন।
দলের রানে কতটা অবদান রেখেছিলেন সেটা এখন থেকে বোঝা যায়। স্টিভ সাধারণত নিজের ভাইয়ের কৃতিত্বে নির্লিপ্ত থাকতেন, কিন্তু এই সেঞ্চুরি দেখে নন স্ট্রাইকিং এন্ড থেকে তিনিও উচ্ছ্বসিত হয়ে মার্ক কে প্রশংসা করেন। ২১৪ রানের মাথায় আউট হলেও পোড়খাওয়া স্টিভ তখন জমে গেছেন উইকেটে। স্টুয়ার্ট ল কে সঙ্গে নিয়ে ৪৮ তম ওভারে জয় এনে দেন দলকে তিনি। মার্ক ওয়াহ প্লেয়ার অব দ্য ম্যাচ হন।
বিশ্বকাপে নক আউট এ পরাজিতকে কেউ মনে রাখেনা, তাই ক্রিস হ্যারিস আর লি জার্মনের হার্কিউলিয়ান এফোর্ট আজ অনেকটাই মানুষ ভুলে গেছে। পরবর্তীকালে হ্যারিস ফিনিশার হিসেবেও এমন বেশ কিছু অবিশ্বাস্য ইনিংস খেলেছিলেন।