একটি ব্লকবাস্টার সিনেমা জন্য আদর্শ কাহিনী কি হতে পারে? একটি চমকপ্রদ চিত্রনাট্য যা দর্শকমহলের হৃদয় ছুঁয়ে যায় এবং প্রতিটি অবিস্মরণীয় যাত্রার কাহিনী সিনেমাটিকে অভূতপূর্ব করে তোলে! প্রতিটি ব্যবসা সফল সিনেমা তৈরির জন্য চলচ্চিত্রকার এমন নিখুঁত গল্প অন্বেষণ করে থাকেন। প্রতিটি সফল চরিত্রের পিছনে একটি উজ্জ্বল কাহিনী আছে তা ক্রিকেটারদের অনেক জীবনীর মধ্যেও বিদ্যমান।
আমরা ২০০০ সালের দিকে শচীন টেন্ডুলকারের হাত ধরে ভারতে ক্রিকেটের পুনরুজ্জীবিত হওয়ার গল্প দেখেছি, রাচির রাস্তায় হেঁটে চলা মহেন্দ্র সিং ধোনির অধিনায়কত্বে ভারতকে তিনটি আইসিসি আয়োজিত ট্রফি জয় করতে দেখেছি। কিছু স্মার্ট চলচিত্রকার এই অনপ্রেরনামুলক চরিত্রগুলোকে ব্লকব্লাস্টার সিনেমায় পরিণত করেছে এবং আমরা সবাই দেখেছি সিনেমাগুলি বক্স-অফিসে কিভাবে আলোড়ন তুলেছে।
শুধু শচীন বা ধোনি নয়, এমন অনেক ক্রিকেটার আছেন যারা অনেক দুর্ভেদ্য বাঁধা জয় করে সফলতার শিখরে পৌঁছতে পেরেছেন। তাঁদের গল্পটা এতটাই হৃদয়গ্রাহী ও সংগ্রামী যে, তা দিব্যি সিনেমার গল্পকেও হার মানাতে পারে।
- সুরেশ রায়না (ভারত)
ভারতের সেরা খেলোয়াড়দের মধ্যে একজন, সুরেশ রায়নার শৈশবকালে এমনকিছু দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছিল, যা তাকে এক সময়ে আত্মহত্যা করার জন্য ভাবতে বাধ্য করেছিল। রায়নার সুখী জীবন ক্রমাগত বিভীষিকাময় লাগছিলো যখন সে ‘লখনৌ স্পোর্টস হোস্টেলে’ যোগদান করেছিল।
তার সিনিয়র এবং সঙ্গীরা তাকে বিভিন্ন সময়ে নানা উপায়ে অতিষ্ট করে তুলছিল। কনকনে শীতের রাতে রায়না যখন গভীর ঘুমে নিমজ্জিত থাকতো তখন তারা তার শরীরের উপর বরফ শীতল ঠাণ্ডা পানি ঢেলে দিতো, তার দুধের গ্লাসে ময়লা আবর্জনা নিক্ষেপ করতো এবং তাদের মধ্যে কয়েকজন রায়নার হাত মাটিতে রেখে তার হাতের উপর মুত্রত্যাগ করতো। কিন্তু ১৩ বছরের গরীব বালক রায়না কোন প্রতিবাদ করতে পারতো না কারন তারা ছিলো সংখ্যায় অধিক।
হোস্টেলের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার পরে মুম্বাই থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার পক্ষে খেলার জন্য একটি ফোন আসে, যেখানে তার সাথে প্রথমবারের মতো প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেটার প্রবীন আমরের সাক্ষাৎ হয়। তারপর ২০০৫ সালে তার জাতীয় দলে অভিষেক হয় এবং আইপিএল শুরু হওয়ার পর রায়না তারকা খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি আইপিএলে চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে অসামান্য নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন এবং ২০১১ সালে ভারতের বিশ্বকাপ জয়েও গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখেন।
বিষাদময় জীবনের যন্ত্রনা জয় করে সুরেশ রায়না এক সফল ক্রিকেটারের নাম; তার অধ্যবসায় তাঁকে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে পৌঁছতে সহায়তা করেছে।
- গ্লেন ম্যাকগ্রা (অস্ট্রেলিয়া)
কেউ যদি বলে শচীন টেন্ডুলকার ভালো ব্যাট করতে পারে না, তাহলে তা চরমভাবে বিদ্রূপাত্মক হবে? মানুষ উচ্চস্বরে হাসবে এবং একে একটি হাস্যকর কৌতুক হিসাবে গ্রহন করবে। প্রতিক্রিয়া একই হবে যদি কেউ বলে যে কিংবদন্তি গ্লেন ম্যাকগ্রাথ ভালো বল করতে পারে না, তবে এমন সময় ছিল যখন মানুষ এই অনুভব করতো যে সে খুব ভালো বোলার হতে পারবে না।
ম্যাকগ্রা দেখতে ছিলেন খুব ফ্যাকাশে এবং খুবই লিকলিকে গড়নের। তার বোলিং ছিল একেবারেই অগোছালো এবং ডেনিস লিলির মত ক্রিকেট বোদ্ধাও তাকে একটি ট্রেইনিং ক্যাম্পে দেখে বাতিলের খাতায় ফেলে দেয়।
১৬ বছরের কিশোর গ্লেন ম্যাকগ্রা অস্ট্রেলিয়ার ‘ব্যাগী গ্রিন ক্যাপ’ পাওয়ার জন্য ছিলো উদগ্রীব কিন্তু সে জানে যে তার স্বপ্ন ছোঁয়ার জন্য তাকে আরো যোজন যোজন পথ পাড়ি দিতে হবে, সে নিরবে প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম করতে থাকে এবং ম্যাকগ্রা তার লাইন-লেন্থ ঠিক করার জন্য একটি ৪৪ গ্যালন ড্রামের বিপক্ষে টানা বোলিং করে যেত।
একবছর কঠিন পরিশ্রমের পর ম্যাকগ্রা ডগ ওয়াল্টারের নজরে পড়ে, ফলে ক্রিকেট অধ্যায়ের এক নতুন ইতিহাস রচিত হয়। আকাশ চোপড়া একটি ঘটনাকে স্মরণ করিয়ে দেয় যখন ভারত সফরের সময় ম্যাকগ্রাথর একটি লেগ-সাইডের বলে আউট হয়েছিলো, যা তাকে বিস্মিত করেছিল।
ম্যাকগ্রা ব্যাক্তিজীবনে জেন ম্যাকগ্রার প্রেমে পড়েন এবং সারাজীবন তার সাথে কাটানোর ইচ্ছা পোষন করেন। পরবর্তীতে ২০০১ সালে তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয় এবং তাদের ঘর আলো করে আসে দুটি সন্তান। ২০০৮ সালে তার প্রিয় স্ত্রী স্তন ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যায়। তার প্রিয় স্ত্রী জেনের মত কেউ যেন বিদায় না নেয় তাই ম্যাকগ্রা পরিবার গঠন করে ‘ম্যাকগ্রা ফাউন্ডেশন’, যা তার স্ত্রী ও সে ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠা করে। ‘ম্যাকগ্রা ফাউন্ডেশন’ স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করে থাকে।
- মোহাম্মদ ইউসুফ (পাকিস্তান)
মোহাম্মদ ইউসুফ ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরু করেন ইউসুফ ইয়োহানা নামে, যার জন্ম পাকিস্তানের খুব দরিদ্র পরিবারে। তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের (বাল্মিকির) অন্তর্গত ছিল, যাদের অস্পৃশ্য বলে মনে করা হতো। মানুষ যেভাবে তাদের সঙ্গে আচরণ করেছিল সেটি অসহনশীল ছিল এবং তারা তাদের ধর্মকে খ্রিস্টধর্মে পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবুও তাঁদের আর্থিক সংগ্রামের শেষ হয়নি।
ইউসুফ ছিলেন অমিত প্রতিভার অধিকারী। কিন্তু তাঁর পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড এবং আর্থিক অবস্থা তার স্বপ্ন পূরণের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। ক্রিকেটের প্রতি তার অদম্য ভালোবাসা তাকে ভালো খেলায় সহায়তা করে কিন্তু তাদের পরিবারের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণ করার জন্য তার খেলা ছেড়ে দেয়া ছাড়া আর কোন বিকল্প ছিল না। সে সামান্য অর্থ আয়ের জন্য রিকশা চালানো শুরু করে কিন্তু তার জীবনে নাটকীয় মোড় নেয় যখন সে স্থানীয় একটি ক্লাবে খেলার সুযোগ পায়।
তার ধারাবাহিক পারফরমেন্স তাকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসে কিন্তু তার গোত্র ও ব্যাকগ্রাউন্ড কারনে যখন লাহোরের একটি দল তাকে প্রত্যাখান করে তখন তার ক্যারিয়ার আবার হুমকির মুখে পড়ে। তবুও তার ক্রিকেট প্রতিভা দিয়ে এইসব বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে। শেষ পর্যন্ত ইউসুফ ইয়োহানা হয়ে যান মোহাম্মদ ইউসুফ। পরবতীতে মোহাম্মদ ইউসুফ নিজের প্রতিভার সাক্ষর রেখে হন পাকিস্তানের সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান এবং তৈরি করেন লক্ষ মানুষের জন্য অনুপ্রেরণা।
- দিনেশ চান্দিমাল (শ্রীলঙ্কা)
দিনেশ চান্দিমালের জীবন একটি বড় অংশ অন্য সব ক্রিকেটারের মতই স্বাভাবিক এগিয়ে যাচ্ছিল। একজন প্রতিভাবান তরুণ ক্রিকেটার যে স্কুল ক্রিকেটে প্রচুর রান করে ৪০ বছরের সকল জাতীয় রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। ক্যারিয়ারের শুরুতে চান্ডিমাল ছিলেন একজন অফস্পিনার, যে কিনা চাকিং এর অভিযোগে অভিযুক্ত হন। তখন কোচ তাঁর দিকে কিপিং গ্লাভস ছুড়ে দেন এবং সেই থেকে কিপার হিসাবে তার ক্যারিয়ার গড়া শুরু।
কিন্তু তাঁর জীবনে বড় ধরনের বিপর্যয় আসে যখন দক্ষিন পূর্ব এশিয়া এবং সমগ্র শ্রীলংকায় সুনামী ভয়াবহ আঘাত হানে। সুনামির আঘাতে তাদের সকল সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং তাদের পরিবারের সকল কিছু সমুদ্রে ভেসে যায় এমনকি চান্দিমালের ক্রিকেট সরঞ্জামও। এই ভয়াবহ ট্র্যাজেডি কাটিয়ে উঠার জন্য চান্ডিমালের কিছু সময় লেগেছিলো কিন্তু খুব দ্রুতই নিজেকে ফিরে পান।
লক্ষ্যে অবিচল থাকার কারনে দিনেশ চান্দিমাল তাঁর অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌছতে পারেন এবং ২০১১ সালের ‘বক্সিং ডে’ তে তার টেস্ট অভিষেক হয় এবং সুনামির আঘাতে জর্জরিত পরিবারের মুখে হাসি ফুটাতে পারে। পরবর্তীতে দিনেশ চান্দিমাল শ্রীলঙ্কা দলের অধিনায়ক নির্বাচিত হন। একটা সময় তাকে কুমার সাঙ্গাকারা বা মাহেলা জয়াবর্ধনের যোগ্য উত্তরসুরী মনে করা হত।
- যুবরাজ সিং (ভারত)
যুবরাজ সিং এর শৈশব আনন্দদায়ক ছিল না। শৈশবকালে যুবরাজ মানষিকভাবে খুব বিপর্যস্ত ছিলো কিন্তু সব বাঁধা দূর করে যুবরাজ ১৯ বছর বয়সে ভারতে জাতীয় দলে সুযোগ পায় এবং তার পর থেকে দলের জন্য অসংখ্য ম্যাচ জয়ী ইনিংস খেলেন।
অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফের সাথে তার মাঠের বাকযুদ্ধ অনেকে এখনো ভুলতে পারেনি, ওই ম্যাচে স্টুয়ার্ট ব্রডের উপর নির্মমভাবে ছড়াও হন যুবরাজ, যার ফল পরপর ছয় বলে ছয় ছক্কা, যা এখনো ক্রিকেট বিশ্বে অনন্য নজির হয়ে আছে। কোয়ার্টার ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৭০ রানের অসাধারণ ইনিংস এবং ব্রেট লি কে মারা ১১৯ মিটার লম্বা ছক্কা, এরকম অসংখ্য স্মরণীয় স্মৃতি আছে ভারতের হয়ে।
যুবরাজকে সবাই ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা সীমিত ওভারের খেলোয়াড় হিসাবে মুল্যায়ন করতে শুরু করে। তার অসাধারণ অলরাউন্ড পারফরমেন্সে ‘টিম ইন্ডিয়া’ ২০১১ সালে বিশ্বকাপ জিতেছিলো। পরবর্তীতে সবাই জানতে পারে যে ওই সময়ে তার শরীরে বাসা বেঁধেছিল এক মরনব্যাধি টিউমার এবং যুবরাজ তখন চিকিৎসা না করে দেশের হয়ে বিশ্বকাপ খেলার সিদ্ধান্ত নেন।
অতঃপর মরনব্যাধি ক্যান্সারের সাথে দীর্ঘ সময় ধরে সংগ্রামের পর আবার ক্রিকেটে ফিরে এসে ২০১৭ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেন ১৫০ রানের এক নয়নবিরাম ইনিংস। যুবরাজের ফিরে আসার গল্প হার মানায় সব কল্পকাহিনীকেও এবং তার জন্য যুবরাজ সবার স্যালুট পাওয়ার যোগ্য।