১৯৭৫ সালের প্রথম বিশ্বকাপ ফাইনালের কথা। টসে হেরে ব্যাট করতে নেমে অস্ট্রেলিয়াকে ২৯২ রানের দুরহ টার্গেট ছুঁড়ে দিয়েছিল ক্লাইভ লয়েড বাহিনী। ক্লাইভ লয়েড নিজে খেলেছিলেন ৮৫ বলে ১০২ রানের এক অসাধারণ অধিনায়কোচিত ইনিংস।
জবাবে ব্যাট করতে নেমে ভালোই লড়াই চালাচ্ছিল অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু পাঁচ পাঁচটা রানআউট আর কিথ বয়েসের আগুন ঝড়ানো বোলিং অসহায় করে দিল অস্ট্রেলিয়াকে। স্কোরবোর্ডে ২৩৩ রান জমা করেই ফিরে গেলেন নয়জন ব্যাটসম্যান। কিন্তু শেষ উইকেট জুটিতেই টানটান উত্তেজনা সৃষ্টি করে ফেললেন শেষ দুই ব্যাটসম্যান।
এক রান, দুই রান করে আসে- আসে- স্কোরবোর্ডে ৩৩ রান জমা করে ফেললেন এই দুই উদ্বোধনী বোলার। শেষ দুই ওভারে দরকার ২৬ রান। উইকেটের এক প্রান্তে তাকে সীমানার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্ট্যাম্প লক্ষ্য করে বল ছুঁড়লেন ফ্রেডেরিক্স।
কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট। বল চলে গেল দর্শকদের মাঝে। এই অপ্রত্যাশিত-লাভজনক পরিস্থিতির সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইলেন না তিনি। ইচ্ছেমতো দৌড়াতে লাগলেন উইকেটের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। তিন রান নেওয়ার পর থেমে যেতে চেয়েছিলেন তার সতীর্থ। কিন্তু তিনি শান্ত হলেন আরো অনেকক্ষণ দৌড়ানোর পর।
শেষপর্যন্ত বল উদ্ধার করা সম্ভব হল। তিনি আম্পায়ার টম স্পেনসারের কাছে জানতে চাইলেন তিনি কত রান পাচ্ছেন? এতবার দৌড়ানোর পরও তাকে মাত্র দুই রান দেওয়া হবে শুনে তিনি ভয়ানক চটে গেলেন। ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, ‘অসম্ভব, আমরা সারা দুপুর ধরে এই উইকেটের এপার-ওপার করছি।’
ডিকি বার্ডও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসলেন। তাকে জিজ্ঞাসা করলেন তারা আসলে কয় রান নিয়েছেন। তিনি তখনো তাঁর এতখানি পরিশ্রম বৃথা যাবে, এটা ভাবতেই পারছিলেন না। বললেন, ‘এটা তো তোমাদেরই গোনার কথা। কিন্তু আমি ১৭ রানের মতো নিয়েছি।’ যদিও এই দুই পেসারের ঐ দৌড়গুলো শেষপর্যন্ত গোনায় আসেনি। তাদেরকে দেওয়া হয়েছিল মাত্র চার রান। ম্যাচটাও জিতে নিয়েছিল ক্যারিবীয়রাই।
জেফ থমসনের সাথে সেদিন ক্রিজে ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের অন্যতম সেরা পেসার ডেনিস লিলি।
১৯৪৯ সালে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার সুবিয়াকো নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ডেনিস লিলি। ছোটবেলা থেকেই ডাকাবুকো লিলি ছিলেন চরম আগ্রাসী। মাঠে প্রতিপক্ষকে ছাড় দিতেন না বিন্দুমাত্র। হোক না পাড়ার ক্রিকেট, গতি দিয়ে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানের নাভিশ্বাস তুললেই তার যত শান্তি।
১৯৭০ মৌসুমে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক তার। নিজের প্রথম মৌসুমেই ৩২ উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি হন। সে বছরই অ্যাশেজের ষষ্ঠ টেস্টে স্বপ্নের ব্যাগি গ্রিন ক্যাপটাও পেয়ে যান লিলি। অভিষেক টেস্টের প্রথম ইনিংসেই তুলে নেন পাঁচ উইকেট। তবে বিশ্বকে লিলি বোধহয় তার উত্থানের জানান দেন পরের বছর বিশ্ব একাদশের বিপক্ষে।
পার্থের সেই ম্যাচে একাই গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন বিশ্ব একাদশকে, ২৯ রানে নিয়েছিলেন আট উইকেট। উইকেটের নামগুলো পড়ুন তাতেই বুঝেই যাবেন তার মাহাত্ন্য ; গ্যারি সোবার্স, ক্লাইভ লয়েড, রোহান কানহাই, সুনিল গাভাস্কার, জহির আব্বাস!
সত্তরের দশকে ফাস্ট বোলিংয়ের মুকুটহীন সম্রাট ছিলেন তিনি। দুধর্ষ গতি আর সুইং দিয়ে আলোড়ন তুলেছিলেন পুরো ক্রিকেটবিশ্বে। গতি দিয়ে ব্যাটসম্যানদের উইকেটে আঘাত হানা যেন তার কাছে ছিল এক প্রকার ছেলেখেলা। বড় চুল, সোনার চেইন, বিশাল গোঁফ নিয়ে বল হাতে ছুটে আসছেন লিলি ভেবেই রাতের ঘুম হারাম হয়ে যেত ব্যাটসম্যানদের।
বলের উপর ছিল তাঁর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। ইতিহাসের অন্যতম কমপ্লিট বোলার ছিলেন তিনি, ক্যারিয়ারে কখনো নো বল করেননি। যদিও অনেক কম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন। ৭০ টেস্ট আর ৬৩ ওয়ানডেতেই সীমাবদ্ধ তার ক্যারিয়ার। ৩৫৫ টেস্ট উইকেটের সঙ্গে নিয়েছেন ১০৩ ওয়ানডে উইকেট। অভিষেকের পর দাপটের সাথে খেলে গেছেন ১৩ বছর।
টেস্ট ক্যারিয়ারে ম্যাচে দশ উইকেট নিয়েছেন সাতবার। টানা চার ইনিংসে নিয়েছিলেন পাঁচ উইকেট। ‘কট বাই রডনি মার্শ বোল বাই লিলি’ তো ইতিহাস হয়ে আছে ক্রিকেটে। লিলির বলে ৯৫ বার উইকেটের পেছনে ক্যাচ নিয়েছেন এই উইকেটকিপার। সিডনিতে নিজের শেষ টেস্টেও নিয়েছিলেন আট উইকেট।
আশির দশকে লিলি-ভিভের দ্বৈরথ ছিল ক্রিকেটের সেরা আকর্ষণ। ১৯৭৫-এ তাদের প্রথম দেখা। সেই অস্ট্রেলিয়া সফরে ৫-১-এ হেরেছিল উইন্ডিজ। লিলি নিয়েছিলেন ২৭ উইকেট। ২৩ বছরের তরুণ ভিভকে ৫ বার আউট করেছিলেন। সেই সিরিজে ৮ বার ভিভকে পরাস্ত করেন লিলি। ১৯৮০-৮১ মৌসুমে বক্সিং ডে টেস্টে আবারো জ্বলে ওঠেন লিলি। মেলবোর্নে তিনি প্রথম ইনিংসে ২ রানে রিচাডর্সকে বোল্ড করেন।
৮৩ রানে ৭ উইকেট নিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে ম্যাচে ফিরিয়েছিলেন লিলি। তার অসামান্য বোলিং নৈপুণ্যে ৫৮ রানে সেই টেস্ট জিতেছিল অস্ট্রেলিয়া। টেস্টে মোট ৯ বার রিচার্ডসকে আউট করেন লিলি। হয়তো সে কারণেই ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি বলেছেন, ‘একমাত্র লিলিই আমার রাতের ঘুম কেড়ে নিতে পেরেছিল।’
কেবল ২২ গজে ক্রিকেটীয় পারফরম্যান্স নয়, লিলি বারবার বিতর্কিত হয়েছেন মাঠে মেজাজ হারিয়ে। জাভেদ মিঁয়াদাদের সাথে একবার মাঠেই মারামারি বাঁধার উপক্রম করেছিলেন।
সুত্রপাত ঘটেছিলো লিলির ইনসুইঙ্গার বল লেগ সাইডে খেলে রান নিতে গিয়ে লিলির সাথে ধাক্কা লাগার মধ্য দিয়ে। সেদিন মেজাজ হারিয়ে লিলি মিয়াঁদাদকে লাথি মেরে বসেন! ব্যস, মিয়াঁদাদও মেজাজ হারিয়ে ব্যাট দিয়ে মারতে যান লিলিকে। এই ঘটনায় অবশ্য পার পাননি লিলি, তাকে গুনতে হয়েছিলো ২০০ ডলার জরিমানা। পাশাপাশি একবার অ্যালুমিনিয়ামের ব্যাট নিয়ে খেলতে নেমে সমালোচনার শিকার হয়েছিলেন। তবে এই বিতর্কিত কাণ্ডগুলো আড়াল হয়ে গিয়েছে বল হাতে তার দারুণ পারফরম্যান্সের সুবাদে।
ক্রিকেট থেকে অবসর নেবার পর জড়িয়ে পড়েন ভারতের এমআরএফ পেস অ্যাকাডেমির সাথে। তার লেখা বই ‘দ্য আর্ট অব পেস বোলিং’ ক্রিকেটবিশ্বের নতুন পেস বোলারদের জন্য বাইবেলস্বরূপ। নিজে ছিলেন ইতিহাসের সেরা পেসার, এখন প্রশান্তি খুঁজে পান ভবিষ্যতের গতি তারকাদের গড়ে তোলার কাজে। কার্য্ত, শুধু সেকালেই নয়, একালেও আছেন লিলি!