প্রকৃতিতে এখনও কালবৈশাখী আসেনি। তবে প্রকৃতির রুদ্ররূপ ধারণের আগেই দেশের ক্রিকেট পাড়া সর্বংদেহী রূপে চলেছে। কারণটা যথারীতি সাকিব আল হাসান। কারণ, তিনি অনলাইন বেটিং সাইট বেটউইনারের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান বেটউইনার নিউজের সাথে অ্যাম্বাসেডর হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। এই ঘটনার পরই রূদ্রমূর্তি ধারণ করে বিসিবি। কারণ, ক্রিকেট বা দেশের আইন – কোথাও বেটিংয়ের কোনো জায়গা নেই। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি হয়ে উঠছে ঘোলাটে হওয়ার সাথে সাথেই সাকিব অবশ্য বেট উইনারের সাথে চুক্তি বাতিল করেন।
তবে, সাকিবের এমন সাকিবীয় রূপে বিতর্ক তৈরি করার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। ক্যারিয়ারের ঊষালগ্ন থেকেই বিতর্কের সাথেই ওঠাবসা সাকিবের। ধারণা করা হয়, সেটাই সাকিবকে আমাদের সবার কাছে ঠিক ‘সাকিব’ বানিয়েছে। নতুন এই ট্রাজিকে সাকিবের ‘সাকিব’ হয়ে ওঠার সেই পুরনো গল্পগুলোতে চোখ বুলিয়ে নিলে কেমন হয়?
- বিদঘুটে টিভি পর্দায়
এশিয়া কাপের ২০১৪ আসরের ঠিক আগ মুহুর্তে, বাংলাদেশের সাথে শ্রীলঙ্কা দলের ওয়ানডে সিরিজ চলছিল। সাকিবের এই ঘটনাটা ঘটে সেই সিরিজেরই দ্বিতীয় ওয়ানডেতে। মিরপুরে শ্রীলঙ্কার দেওয়া ২৯০ রান চেজ করার সময় সাকিবের রান যখন ২৪, তখন লং অফে উড়িয়ে মারতে গিয়ে নিজের উইকেট ছুঁড়ে আসেন তিনি।
আর এরপরই ধারাভাষ্য কক্ষে থাকা ধারাভাষ্যকারেরা সাকিবের এই উইকেট ছুঁড়ে আসার সমালোচনা করতে থাকেন। সেই ঘটনার ঠিক ১০ ওভার পর, টিভি ক্যামেরাটা বারবার সাকিবের দিকে ফেরানো হচ্ছিল। সাকিব চাচ্ছিলেন না তাকে লাইভ দেখানো হোক, কিন্তু ক্যামেরাম্যান তাকে বারবারই ফোকাস করছিলেন। আর ঠিক তখনই ক্যামেরার সামনে অশালীন অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করেন সাকিব। এ ঘটনায় সাকিবকে এশিয়া কাপের দুই ম্যাচ সহ মোট তিন ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় আর সাথে ৩৮০০ ডলার জরিমানা তো আছেই!
- নিদাহাসে নো বল
নিদাহাস ট্রফির ষষ্ঠ ম্যাচের ঘটনা, বাংলাদেশ সেদিন শ্রীলঙ্কার সাথে জিতলেই সোজা চলে যেত ভারতের সাথে ফাইনালে। ঠিক তখন ইসুরু উদানার করা শেষ ওভারে দুই বলই শোল্ডারের ওপর দিয়ে চলে যায়। এতে লেগ আম্পায়ার নিয়মমাফিক নো বলও ডাকেন। কিন্তু খুবই অবাক করা ব্যাপার হল, নো বল ডাকলেও কিছুক্ষণ পরই সেটা তিনি বাতিল করে দেন।
শেষ ওভারে মাত্র ১২ রান লাগায় আর স্ট্রাইকে মাহমুদুল্লাহ থাকায় বাংলাদেশের জয়ের বেশ সম্ভাবনা ছিল এটা বলা যায়। আর এসময় আম্পায়ারের আচরণে মাঠের বাইরে ক্ষেপে যান সাকিব, তিনি সোজা মাহমুদুল্লাহকে ক্রিজ ছেড়ে চলে আসতে বলেন। তবে দলের সাথে থাকা খালেদ মাহমুদ মাহমুদুল্লাহকে ক্রিজেই থেকে যেতে বলেন। পরে অবশ্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয় আর সাকিবকে ম্যাচ ফি’র ২৫% জরিমানা করেই ছেড়ে দেওয়া হয়।
- বিপিএল হতাশা
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের ২০১৫ এডিশনের ঘটনা। সাকিব সেবার খেলেছিলেন রংপুর রাইডার্সের হয়ে। বিপিএলেরই এক ম্যাচে রংপুর রাইডার্স মাঠে নেমেছিল মুশফিকের সিলেট সুপারস্টার্সের বিপক্ষে। শুরুতে ব্যাট করে মাত্র ১১০ করায় ম্যাচটা প্রথম ইনিংসেই হেরে বসে রংপুর। ছোট লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ম্যাচের ১৩ ওভারেই ৬৪ রানে পাঁচ উইকেট হারিয়ে ফেলে সিলেট, আর ঘটনাটা ঠিক এ সময়েরই।
রংপুরের থিসারা পেরেরার করা এক ডেলিভারিতে মুশফিক লাইন মিস করলে তা সোজা চলে যায় উইকেটরক্ষকের হাতে আর তখনই আউটের আবেদন করেন রংপুরের খেলোয়াড়েরা। রংপুরের আবেদনে আম্পায়ার তানভীর আহমেদ সাড়া না দিলে ক্ষিপ্ত হয়ে যান সাকিব আল হাসান , তিনি রীতিমত আম্পায়ারের দিকে তেড়ে আসেন অশ্রাব্য কথা বলতে থাকেন। এমনকি ধারাভাষ্যকারেরা অবধি বলছিল সাকিব আম্পায়ারের সাথে এমন ভাবে কথা বলতে পারেন না। পরে অবশ্য সে ম্যাচ জিতে নেয় সিলেট, তবে ম্যাচ শেষে সাকিবকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা সহ এক ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
- সমর্থকের বিবাদ
২০১৮ সালের ঘটনা এটা। বাংলাদেশ সেবার উইন্ডিজ আর আমেরিকা সফরে গিয়েছিল টেস্ট, ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলতে। আমেরিকাতেই সাকিবরা যে হোটেলে উঠেছিল সেখানের লবিতে সাকিবকে দেখা যায় এক সমর্থকের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়তে। দ্রুতই সেটার ছোট্ট একটা ভিডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়ে ইন্টারনেটের সবখানে। সাকিবকে নিয়ে ফের শুরু হয় আলোচনা সমালোচনা।
তবে, জল বেশিদূর গড়াবার আগেই সাকিব রাতে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে ঘটনার ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। সেখানে তিনি লেখেন, তিনি খুব ক্লান্ত ছিলেন আর রুমে ফিরতে চাইছিলেন। তখনই সেই সমর্থক তাঁর কাছে অটোগ্রাফ চান আর তাঁর হাত ভর্তি থাকায় তিনি অটোগ্রাফ দিতে পারেননি। আর তখনই ঐ সমর্থকের সাথে অযাচিত বিবাদ লেগে যায়। তিনি দাবি করেন, ভিডিও ক্লিপ পুরো ঘটনাটা তুলে ধরেনি । সাথে অবশ্য সাকিব এটাও সবাইকে বোঝার অনুরোধ করেন যে ক্রিকেটাররাও রক্তমাংসে গড়া মানুষ!
- প্রস্তাব গোপন
দুর্দান্ত একটা বিশ্বকাপ কাটানোর পর দেশে ফিরে সাকিব মনোযোগী ছিলেন তাঁর এই অমানুষিক পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে। আর তখনই আইসিসি বোমার মত বিস্ফোরণ ঘটাল সাকিবকে জড়িয়ে ফিক্সিং ইস্যুতে খবর প্রকাশ করে।
সাকিবের ব্যাপারে আইসিসির অভিযোগ ছিল, জুয়াড়ির প্রস্তাব বারকয়েক পেয়েও তিনি আইসিসিকে তা জানাননি। আইসিসির কোড অব কন্ডাক্ট অনুযায়ী আইসিসি তখন সাকিবকে এক বছরের স্থগিত নিষেধাজ্ঞাসহ দুই বছরের নিষেধাজ্ঞা দেয়। সে শাস্তি কাটিয়ে সাকিব অবশ্য ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরেছেন, একটা গোটা সিরিজও খেলেছেন। কিন্তু সাকিবের এই ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব গোপন রাখার কাণ্ড দেশের ক্রিকেটে বড়সড় একটা ধাক্কা হয়েই আসে।