কাঠফাটা রোদ্দুর, শরীর জ্বালিয়ে দেওয়া গরমে বাংলাদেশে এখন জাতীয় লিগের খেলা চলছে।
ঠিক এমন সময়ে পৃথিবীর আরেক প্রান্তে বরফ জমা তাপমাত্রায় কাঁপতে কাঁপতে ব্যাট-বল হাতে নিজেদের ঝালিয়ে নিচ্ছেন কয়েক জন ক্রিকেটার। বাইরে বরফ জমে গেছে। তাই জিমনেসিয়ামের মধ্যে একটু জায়গা করে মার্বেলের মেঝেই চলছে ক্রিকেট অনুশীলন।
কারা এরা? এরা ফ্রান্স জাতীয় দলের ক্রিকেটার। ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কার কিছু মানুষ মিলে ধিকি ধিকি করে টিকিয়ে রেখেছেন ফ্রান্সের ক্রিকেটকে।
খেলার জায়গা নেই, খেলে পয়সা নেই, খেলার সময়ও নেই; এর মধ্যেই কোনোক্রমে টিকে থাকার লড়াই। সেই টিকে থাকাটাও খুব ভালোভাবে নয়। বিশ্ব ক্রিকেটে ফ্রান্সকে তো খুজেই পাওয়া যায় না। ইউরোপেও সেরা দশ দলের মধ্যে থাকতে কষ্ট হয় তাদের।
বোঝাই যায়, ক্রিকেটের কী হাল এখানে। সাদা চোখে ব্যাপারটা খুব বিস্ময়কর কিছু নয়। ইউরোপের এই অংশে ক্রিকেটের প্রভাব এমনিতেই কম। ফলে ফ্রান্সের অবস্থা এমন হবে, তাতে আর অবাক হওয়ার কী আছে? কিন্তু ফ্রান্স চিরকাল এমন ছিল না ক্রিকেটে।
আপনি শুনলে তাজ্জব হবেন, অনেক ক্রিকেট ঐতিহাসিক মনে করেন, ক্রিকেটের জন্মই হয়েছে আসলে এই ফ্রান্সে! হ্যা, ইংল্যান্ডে নয়; প্রথম ক্রিকেট বিষয়ক কোনো নথির খবর এই ফ্রান্সেই পাওয়া যায়।
১৪৭৮ সালের একটি নথিতে দেখা যায়, ফ্রান্সের একটি গ্রামে ‘ক্রিকুয়েট’ নামে একটি খেলা চলছিল, যাতে ব্যাট ও বল ব্যবহৃত হয়েছে। এরপরের দুই শতকের ফ্রান্সে ক্রিকেটের ভুরি ভুরি নির্দশন এখনও টিকে আছে। ওয়ালপল লিখেছেন, তিনি ১৭৬৬ সালে বিপুল দর্শক আগ্রহের মধ্যে প্যারিসে ক্রিকেট অনুষ্ঠিত হতে দেখেছেন।
১৭৮৯ সালে এমসিসি তাদের প্রথম আর্ন্তজাতিক সফরে ফ্রান্সে যাবেই বলে ঠিক ছিল। কিন্তু এরই মধ্যে ফরাসি বিপ্লব শুরু হয়ে যাওয়ায় সে সফর বাতিল হয়। আর ফ্রান্সে এই নতুন সংষ্কৃতির উদ্ভবই একরকম ছিটকে দেয় ক্রিকেটকে। আধুনিক যুগে এই জাতিটি আর সেভাবে এই খেলায় আগ্রহ দেখায়নি।
১৯০০ সালে ইতিহাসে প্রথম ও একমাত্র অলিম্পিকে ক্রিকেট ছিলো ইভেন্ট হিসেবে। সেই ইভেন্টে ফ্রান্স জাতীয় ক্রিকেট দল অংশ নিয়েছিলো। যদিও সেটা ছিলো নিতান্তই ব্রিটিশদের নিয়ে গড়া একটা দল। ফ্রান্সে বসবাসরত ব্রিটিশরা স্টান্ডার্ড অ্যাথলেটিক ক্লাব চালাতেন। আর এই ক্লাবের খেলোয়াড়রাই জাতীয় দলের হয়ে লন্ডন অলিম্পিকে খেলতে গিয়েছিলেন। একমাত্র ম্যাচ খেলেছিলো তারা ব্রিটেনের বিপক্ষে; সেই ম্যাচে হেরেছিলো।
১৯৮৭ সালে আইসিসির সদস্যপদ পেয়েছে ফ্রান্স। ১৯৮৯ সালে এমসিসি ফ্রান্স সফরেও গিয়েছিলো।
ফ্রান্স ২০০১ সালে একটা আইসিসি ট্রফিও খেলেছে। এখন তারা আইসিসির লোয়ার ডিভিশন চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেয়। আর কিছু না হোক কয়েকটি ক্লাব আছে প্যারিসে। সবই চলে বিট্রিশ ও উপমহাদেশীয়দের উদ্যোগে। খেলোয়াড়রাও তাই। কিন্তু স্থানীয়দের আগ্রহহীনতা ও খেলার মাঠের স্বল্পতা খেলাটিকে এখনও ভিনগ্রহের ব্যাপার করে রেখেছে।
এখনও দেশটিকে ক্রিকেটারের সংখ্যা দুই হাজারের কম। ফ্রান্স কী তাহলে এভাবেই তাদের খেলাটিকে ভুলে থাকবে? নাকি একদিন ক্রিকেটেও ফিরে আসবে ফরাসি বিপ্লব। কে জানে! আমরা না হয় আরেকটা ফরাসি বিপ্লবের অপেক্ষাতেই দিন কাটাই।