এক সময় এখনকার মত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এতো ব্যস্ততা ছিলো না। বিশেষ করে এই উপমহাদেশের ক্রিকেটে। এখনকার দিনের মত শক্তিশালী কোনো সফর এই উপমহাদেশে হত না। এখানে খেলতে আসতো বিভিন্ন আমন্ত্রণমূলক দল।
এটা করা হত মূলত এই উপমহাদেশে ক্রিকেটের প্রচারের জন্য। আর সাথে টেস্ট ম্যাচ গুলো খেলা হত স্টেডিয়াম ভর্তি দর্শকের সামনে।
১৯৭১ সালের শুরুর দিকে একটি কমনওয়েলথ দল পাকিস্তানে এসেছিলো। এই দলের বেশির ভাগ সদস্য ছিলো ইংল্যান্ডের। পাকিস্তান সফরে এই দলের খেলার কথা ছিলো তিনটি চার দিনের ম্যাচ। এর দুই বছর আগে ইংল্যান্ড দলের পাকিস্তান সফরে তিন টেস্টের সিরিজ খেলার কথা ছিলো। কিন্তু রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে সেই সিরিজটি বাতিল করা হয়।
কমনওয়েলথ দলের যখন পাকিস্তান সফরে আসার কথা তখন পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমস্যা বেশ গভীরে। সাথে সারা বিশ্বের নজর আছে এই বিষয়ে। এছাড়াও আগের বছরই একটা ঘূর্নিঝড় আঘাত হেনেছে পূর্ব পাকিস্তান এবং ভারতের বাংলা অংশে। এই ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে পাঁচ লক্ষ লোক মারা যায়।
১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে এই ঘূর্নিঝড়ে আক্রান্তদের সাহায্যার্থে একটি চ্যারিটি টেস্ট ম্যাচ আয়োজন করা হয় পাকিস্তান এবং রেস্ট অফ ওয়ার্ল্ড দলের মধ্যে। এই কমনওয়েলথ দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মিকি স্টুয়ার্ট। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন সারে ও ইংল্যান্ডের কিংবদন্তি মিকি স্টুয়ার্ট, যিনি আরেক কিংবদন্তি ও সাবেক ইংলিশ অধিনায়ক অ্যালেক স্টুয়ার্টের বাবা।
কোনো ঘটনা ছাড়াই করাচিতে প্রথম টেস্ট অনুষ্ঠিত হয়। যখন পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড ঘরের মাঠে কোনো ক্রিকেটারকে অর্থ দিতে অস্বীকৃতি জানায়, সেই মুহূর্তে দল থেকে মোশতাক মোহাম্মদকে সরিয়ে নেওয়া হয়। তবুও পাকিস্তান দল বেশ ভালোভাবে ম্যাচ জিতে নেয়। দ্বিতীয় টেস্টে দুই দলের মুখোমুখি হবার কথা ছিলো তখনকার পূর্ব পাকিস্তান ( বর্তমান বাংলাদেশ) এর রাজধানী ঢাকাতে।
ঢাকা শহরের অবস্থা ছিলো বেশ উত্তাল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। তবে কেন্দ্রীয় সরকার এই নির্বাচন মেনে নিতে চায় নি। রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের থেকে স্বাধীনতার দাবি করছিলো।
এই সময়ে ক্রিকেটাররা ঢাকায় এসে রাজনৈতিক উত্তেজনা বুঝতে পেরেছিলো। প্রথম তিন দিন বেশ ভালো ভাবেই সমর্থকরা মাঠে খেলা দেখছিলো। এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই ম্যাচে পাকিস্তানের পক্ষে খেলতে নেমেছিলেন রকিবুল হাসান।
তখনকার সময়ে তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রথম বর্ষের ছাত্র। তিনি দুই ইনিংসেই ব্যর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু মাঠে তাঁর উপস্থিতি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
এই ম্যাচে রয় ভার্জিনের সেঞ্চুরিতে প্রথম ইনিংসে লিড নেয় আন্তর্জাতিক একাদশ। আজমত রানার সেঞ্চুরিতে ম্যাচের চতুর্থ দিনে মধ্যাহ্ন বিরতির সময়ে ম্যাচ ড্র করার সুযোগ ছিলো।
কিন্তু খেলা চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেন এবং সামরিক শাসন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। দুই দিন পরেই ঢাকাতে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার কথা ছিলো, এই সময়ে জাতীয় পরিষদ বসবে না বলে ঘোষণা দেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান।
এই ঘোষণায় বিক্ষোভে ফেটে উঠে ঢাকার রাজপথ। এই উত্তেজনা এসে পড়ে ঢাকার স্টেডিয়ামে। এই উত্তেজনার কারণে খেলা বন্ধ করতে বাধ্য হয় ম্যাচ আয়োজকরা।
দর্শকরা আইয়ুব খানের ঘোষণার কিছুক্ষণের মধ্যে মাঠে নেমে আসে এবং পুরো ঢাকা শহর জুড়ে এই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এই উত্তেজনার কারণের খেলা বন্ধ করতে বাধ্য হয় কতৃপক্ষ।
এই উত্তেজনার বিষয়ে রকিবুল হাসান বলেন, ‘ছাত্র এবং রাজনীতিবিদরা উত্তেজিত ছিল। তাঁরা স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলো। আমরা যখন হোটেলে ফিরছিলাম তখন বিভিন্ন জায়গায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। তখন থেকেই আমরা জানতাম এটাই এই সিরিজের শেষ।’
ইংল্যান্ডের সাবেক উইকেট রক্ষক জন মুরে জানান, এক মিনিটে সব কিছু হয়েছিলো। তিনি বলেন, ‘আমি জানতাম আমরা সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছি। আমরা অন্ধকার রাস্তা দিয়ে বিমান বন্দরে যাই। আমরা লাহোরে আসার শেষ বিমানে করে লাহোরে চলে আসি।’
এই দিন সন্ধ্যায় বিক্ষোভকারীদের ছত্র ভঙ্গ করতে টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। পরের দিন সকালে প্রায় হাজার খানিক বিক্ষোভকারী বিমানবন্দরের রাস্তা বন্ধ করে বিক্ষোভ করে।
বিক্ষোভকারিদের সরাতে নিরাপত্তা বাহিনী গুলি করলে একজন মারা যান এবং সাত জন আহত হন। সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়ে ঢাকাকে অচল করে দেওয়া হয়েছিলো। এই সময় ঢাকা শহরে চুরি এবং ডাকাতি বেড়ে গিয়েছিলো।
বিখ্যাত ক্রিকেট সাময়িকী উইজডেন এই সফরকে কাভারেজ দিচ্ছিলো। তাঁরা শুধু এই ম্যাচের বিস্তারিত স্কোর বোর্ড দিয়েছিলো। তাঁরা খেলা পরিত্যক্ত হবার কারণ হিসেবে স্কোর বোর্ডে লিখে দেয়, ‘চতুর্থ দিনের খেলা পরিত্যক্ত করা হয়েছে। কারণ দর্শকরা মাঠে আক্রমণ করেছিলো।’
যদিও অস্থিরতা বেড়েই চলছিলো তাঁর মধ্যে লাহোরে তৃতীয় টেস্ট অনুষ্ঠিত হয়। কোনো ধরনের সমস্যা ছাড়াই লাহোরে এই টেস্ট শেষ হয়। যদিও কমনওয়েলথ দলের বেশিরভাগ সদস্য দেশে ফিরে যাবার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলেন।
তৃতীয় টেস্টে রকিবুল হাসানের পরিবর্তে দলে নেওয়া হয় আফতাব গুলকে। আফতাব গুলের টেস্ট অভিষেক হয়েছিলো আরো দুই বছর আগে। তিনি ছিলেন পাকিস্তানের বড় ছাত্রনেতাদের মধ্যে একজন। তাকে দলে নেওয়া হয়েছিলো যাতে পাকিস্তানে উত্তেজনা কিছুটা কমে। এই টেস্টেই অভিষেক ঘটে পাকিস্তানের তারকা ক্রিকেটার ইমরান খানের।
রকিবুল হাসান কলকাতায় যান, ট্রেনিং নিয়ে দেশের জন্য যুদ্ধ করেন। দেশে ফিরে এসে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়কের দায়িত্ব নেন তিনি। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তাঁর পরিবারের ছয় জন সদস্যকে হত্যা করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। এছাড়াও পূর্ব পাকিস্তান দলে তাঁর ওপেনিং সঙ্গী আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েলকেও হত্যা করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী।
সব ঠিক থাকলে হয়তো রকিবুলের সাথে জুয়েল ওপেন করতে নামতেন বাংলাদেশের হয়ে। কিন্তু, তা হয়নি। তবে, রকিবুল ঠিকই খেলেছেন বাংলাদেশের জার্সিতে, আন্তর্জাতিক ম্যাচে। টেস্ট খেলার সামর্থ্য যার ছিল, সেই রকিবুল ১৯৮৬ সালের এশিয়া কাপে খেলেন দু’টি ম্যাচ।