সমালোচনা আর অপমান এক নয়!

বিভিন্ন সময়ে দেশের ক্রিকেটে সাফল্য এনে দেওয়ায় তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল, এটি অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। কিন্তু পারফর্মিং আর্টের ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তিই সমালোচনার উর্ধ্বে কিংবা ঈশ্বরতুল্য নন।

বর্তমান সময়ের একটি বেশ আলোচিত বিষয় হল,সিনিয়র ক্রিকেটাররা যথাযথ সম্মান পাচ্ছেন কি না, তাদের বিকল্প আছে কি না, বিকল্প না খুঁজে তাদের বাদ দেওয়ার চিন্তা করে তাদের অপমান করা ইচ্ছে কি না ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট কথাবার্তা। এই বিষয়ে আমার একান্ত ব্যক্তিগত কিছু মতামত পেশ করছি।

যেহেতু তাদের নিয়ে আলোচনাটা ক্রিকেট সম্বন্ধীয়,তাই ক্রিকেটীয় স্পিরিটের বিচারে কোনটি সমালোচনা,আর কোনটি অপমান সেটি বোঝা যাক।

ধরুন,আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে একজন ওপেনার টানা তিনটি ম্যাচে ডাক মারছেন বা টানা দশটি ম্যাচে সিঙ্গেল ডিজিটে আউট হয়েছে। এখন আমি যদি বলি, ‘এমনই তো হইবো,অমুকের জোরে দলে আসছে!’ বা ‘ও অমুক কোটার খেলোয়াড়।’ এটা কোনোভাবেই সমালোচনা নয়, বরং ব্যক্তি আক্রমণ ও চরম অপমান। কিন্তু কেউ যদি বলে, ‘তার সামর্থ্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের উপযুক্ত না, অতএব তাঁকে পরিকল্পনার বাইরে রাখা উচিত বলে মনে করি!’ -খেলোয়াড়টি সিনিয়র বা জুনিয়র যেই হোন না কেন, তাঁর সামর্থ্য,মেধা যদি আসলেও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের হয়ে থাকে,তবুও উক্ত ব্যক্তির মন্তব্য অযৌক্তিক নয়, বরং স্বাভাবিক!

আমাদের ক্রিকেটের পাঁচজন সিনিয়র যাদের পঞ্চপাণ্ডব বলেও আখ্যায়িত করা হয় তাদের ব্যাপারে সরাসরিই আসি এবার।

বিভিন্ন সময়ে দেশের ক্রিকেটে সাফল্য এনে দেওয়ায় তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল, এটি অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। কিন্তু পারফর্মিং আর্টের ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তিই সমালোচনার উর্ধ্বে কিংবা ঈশ্বরতুল্য নন। আপনি ভাল করলে যেমন গুণগান গাওয়া হবে, খারাপ করলে সমালোচনা হবে, সেটাই স্বাভাবিক। আপনি যতদিন পারফর্ম করবেন, দ্য স্টেজ ইজ ইওরস। যখন আগের মতোন পারবেন না, মঞ্চে আপনি থাকার যোগ্যতা রাখেন কি না বা সসম্মানে বিদায় দেওয়ার সময় এসেছে কি না সেটা নিয়ে আলোচনা হবে-এটাই স্বাভাবিক।

শুরু করছি মাহমুদুল্লাহ রিয়াদকে দিয়ে। মাশরাফি একবার একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ বাংলাদেশের ক্রিকেটের স্বার্থে নিচে ব্যাট করে কয়েক হাজার রান স্যাক্রিফাইস করেছেন। আমি পুরোপুরিই সহমত।মাশরাফির বক্তব্যের সত্যতা মেলে, চার নম্বরে ব্যাট করে ২০১৫ বিশ্বকাপে তার ব্যাক টু ব্যাক হান্ড্রেডের মধ্য দিয়েই। এ বাদে দীর্ঘ ক্যারিয়ারে রিয়াদ অনেকবার বাংলাদেশ দলের হয়ে সময়োপযোগী নক খেলেছেন, যা বাংলাদেশ ক্রিকেটে তাকে হয়তো অমরত্বও দেবে।

ওয়ানডে ক্রিকেটে তার এই অবদানের জন্য আমি আমরণ রিয়াদ ভাইকে সম্মান করবো অন্তরের অন্ত:স্থল থেকে।কিন্তু প্রিয় খেলোয়াড়টি যখন প্রায় প্রতি সিরিজে একাধিক ক্যাচ মিস করবেন, ছয়-সাত নম্বরে ব্যাট করেও কুইক ফিনিশিং এনে দিতে ব্যর্থ হবেন,তখন দলের স্বার্থে কি তার অবস্থান নিয়ে নতুন করে ভাবাটাই স্বাভাবিক নয়? যদি আমি ব্যক্তি-খেলোয়াড়ের উর্ধ্বে দলের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দেই। আমি যদি ক্রিকেটীয় সামর্থ্যের বিচারে রিয়াদকে বাদ দিয়ে চিন্তা করার কথা বলি,তবে কি তার প্রতি আমার অন্তরের শ্রদ্ধা ধুয়েমুছে যায়? অবশ্যই নয়!

আসি তামিমের বিষয়ে। তামিম ইকবালের সবচেয়ে বড় সমালোচনা হয় শর্টার ভার্সনে তার স্ট্রাইক রেট নিয়ে। ২০০৭ এ জহির খানকে ডাউন দ্য উইকেটে উড়িয়ে মারা ছক্কাটা ভুলতে পেরেছেন? কিংবা লর্ডসে এক বঙ্গসন্তানের দাপুটে সেঞ্চুরি! চাইলেও পারবেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের আইকনিক দৃশ্যগুলো হতে এগুলো মুছে দিতে। আমি ড্যাশিং তামিমের অনেক বড় ভক্ত।

তাঁর ব্যাটিংয়ের ধরণ বদলানোও একটা সময় পর্যন্ত আমাদের পজিটিভ রেজাল্ট এনে দিয়েছে। কিন্তু যখন ৩৫০+ টার্গেটে ব্যাট করা একটি দলের ওপেনার হিসেবে নেমে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বল খেলে তিনি ১০০’র নিচে স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করবেন, সেই ম্যাচের জন্য হলেও আমি তাকে সমালোচনা করবো। এর জন্য তার অতীত রেকর্ড ধুয়ে মুছে যায় না,বা তার প্রতি আমার সম্মান কমে না। বরং ব্যক্তি তামিমের অপমান হয় তখন যখন বলা হয় ‘সে চাচার জোরে খেলে’।

তামিমের ক্রিকেটমাঠের পারফরম্যান্সের সমালোচনা করা যতোটা প্রাসঙ্গিক, এই ধরনের অপমানমূলক বক্তব্য ততোটাই নিন্দনীয়। কিন্তু কেউ যদি তামিম ইকবালের টেকনিক্যাল গলদ নিয়ে কথা বলে, আর সেটা যদি ক্রিকেটীয় দিক দিয়ে সঠিক হয়, সেটা অবশ্যই আলোচনার যোগ্য; একইভাবে ক্যারিয়ার রেকর্ড ও স্ট্রাইক রেট বিবেচনায় নিয়ে কেউ যদি তামিম ইকবালের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অযোগ্যতার কথা তোলে, সেটা তার ১৫-১৬ বছরের ক্রিকেটীয় অর্জনকে বিন্দুমাত্র খাটো করে না।

মুশফিকুর রহিম আমাদের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাটার, টেকনিক্যালি ও রেকর্ড বিচারেও।টেস্টে দেশের হয়ে প্রথম ডাবল হান্ড্রেড করা মুশি ক্রিকেটীয় নিবেদন, ডিসিপ্লিন ও মাঠের পারফর্মেন্স দিয়ে (টেস্ট ও ওয়ানডে ক্রিকেটে) বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের ডায়েরিতে উজ্জ্বলভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কিন্তু সেই মুশফিক যখন ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে দৃষ্টিকটু শট খেলে আউট হয়ে যাবেন, অতীত ইতিহাসের ধুয়ো তুলে তার সমালোচনা না করাটাই বরং ক্রিকেটীয় দৃষ্টিতে অস্বাভাবিক।

এক ফরম্যাটের পারফরম্যান্স দিয়ে অন্য ফরম্যাটে মুশফিকের সমালোচনা করাটা যেমন অনুচিত, অনাকাঙ্ক্ষিত; তেমনি এক ফরম্যাটে ভাল করলেই তাকে সব ফরম্যাটেই খেলিয়ে যাওয়ার দাবী তোলাও অযৌক্তিক বাচ্চাসুলভ আচরণের বহি:প্রকাশ!

মাশরাফি বিন মুর্তজা। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই মানুষটিকে খুবই বিশেষভাবে সম্মান করি। মাঠ ও মাঠের বাইরে তার এটিটিউড ও বলিষ্ঠভাবে লিড করার ক্ষমতা পটেনশিয়াল বাংলাদেশ ওয়ানডে দলকে নেক্সট লেভেলে নিয়ে গিয়েছে, এ কথা অস্বীকার করা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু ২০১৯ বিশ্বকাপে ম্যাশের ম্যাচ ফিটনেস ও পারফরম্যান্স নিয়ে আজও সমালোচনা হয় ,সেটা হওয়াই স্বাভাবিক।

তার জন্য মাশরাফি নিজেকে কখনো ডিফেন্ড করেন নি,করবেন ও না। পেস বোলিংয়ে বাংলাদেশের উঠতি ছেলেমেয়েদের কাছে প্রথম বাংলাদেশি আইডল কিন্তু মাশরাফিই। কিন্তু মাশরাফির অনেক বড় ভক্ত হওয়া সত্ত্বেও অবসর নিয়ে টালবাহানা, বিদেশি কোচদের ঢালাও সমালোচনা – এগুলো আমায় ব্যথিত করে। একসময় পেস বোলিংকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়া ম্যাশে মুগ্ধতা জানালেও বর্তমান ম্যাশের মাঠের বাইরের অনেক বক্তব্যই তীব্র সমালোচনাযোগ্য এবং সেক্ষেত্রে আমি তার মন্তব্যের বিরোধিতা করবো,এটাই বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাধারণ ভক্ত ও শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে আমার জন্য স্বাভাবিক।

এতে নড়াইল এক্সপ্রেসের প্রতি ভক্ত হিসেবে আমার কৃতজ্ঞতা ও সম্মানের জায়গায় এক বিন্দুও ভাটা পড়বে না,তা বলতে পারি। কিন্তু ম্যাশের সমালোচনা করতে গিয়ে কেউ যদি তার রাজনৈতিক পরিচয় টেনে তাকে ছোট করতে চান,ঢালাওভাবে তার অতীত অবদানকে অস্বীকার করতে চান, সেটা খেলোয়াড় মাশরাফির প্রতি চরম অপমান বটে!

সাকিব আল হাসানকে নিয়ে বরাবরই মাঠের থেকে মাঠের বাইরে সমালোচনা বেশি হয়। মাঠের পারফরমেন্সে বরাবরই বাংলাদেশ দলে সাকিব অনন্য অসাধারণ। তবুও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ম্যাচে তার দায়িত্বজ্ঞানহীন শট খেলা নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে সমালোচনা যেমন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মাঠের সাকিবের শ্রেষ্ঠত্বে আঁচড় ফেলে না, তেমনি দেশের ক্রিকেট ফেলে আইপিএল খেলতে যাওয়া নিয়ে বাংলাদেশের একজন সমর্থক তার খারাপ লাগার জায়গাটা প্রকাশ করতেই পারে। কিন্তু সাকিব একটি ম্যাচে খারাপ করলেই ‘সাকিব দেশের জন্য খেলে না, টাকার জন্য খেলে’ ইত্যাদি নানান রকম কথা+পরিবার ও ব্যক্তিজীবন টেনে সমালোচনা খেলোয়াড় সাকিবের প্রতি প্রত্যক্ষ অপমানই বটে!

প্রতিটি দেশেই বিভিন্ন সময়ে তাদের দেশের জন্য আইকনিক ক্রিকেটার এসেছেন। যাদের ব্যক্তিগত অর্জনে তাদের দল লাভবান হয়েছে, ক্রিকেটবিশ্বে তাদের অবস্থান মজবুত করেছে। গ্রেটরা এসেছেন, গেছেন, তাদের রেশ রেখে গেছেন;পরবর্তী প্রজন্ম ক্রিকেটকে সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছে,নতুন গ্রেট তৈরি হয়েছে। সময় আসলে নতুনদের জন্য জায়গা ছেড়ে দেওয়াটা শুধু ক্রিকেট নয়, বরং প্রকৃতিরই নিয়ম। আমাদের সিনিয়র ক্রিকেটাররাও তার ব্যতিক্রম নন।

এতদিন একসাথে খেলেও দেশের জন্য বড় কোন ট্রফি এনে দিতে পারেন নি, তাদের নিয়ে এই সমালোচনা ও ভক্তদের আক্ষেপ যেমন স্বাভাবিক; নিজেদের প্রাইম টাইমে আমাদের অনেক ম্যাচ জেতানোর কৃতিত্বের ভাগও তাদের পুরোটাই প্রাপ্য। কিন্তু প্রত্যেক খেলোয়াড়ের-ই ক্যারিয়ারের একটি সময় আসে,যখন সে তাঁর সেরাটা ফেলে আসে।জাতীয় দলকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য টিম.ম্যানেজমেন্ট তার জায়গায় তরুণ খেলোয়াড়কে সুযোগ দেবে, এটাই বাস্তবতা।যা সংশ্লিষ্ট খেলোয়াড়,দর্শক,মিডিয়া-সকলেরই স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়া বাঞ্চনীয়।

অবশ্যই দেশের ক্রিকেটে তাদের অবদানের জন্য প্রাপ্য সম্মান থেকে যে কোন পর্যায়ে তাদের বঞ্চিত করার চেষ্টা করা অনুচিত।কিন্তু তার জন্য মাঠের পারফরম্যান্স ছাড়াই যতদিন তিনি খেলতে চাইবেন,ততোদিনই তাকে দল বহন করবে, এটা অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্যও বটে। সবচেয়ে ভাল হয় সময়ের প্রয়োজন ও নিজের সামর্থ্য বিবেচনা করে সঠিক সময়ে খেলোয়াড়ের সরে যাওয়া। অন্যথায় নির্বাচকদেরই সরাসরি দলীয় পরিকল্পনার ব্যাপারে খেলোয়াড়কে অবহিত করে সামনে তাকাতে হবে। যে জায়গাটায় বিসিবি বরাবরই অপেশাদার,তা তারা নিজেরাও বোধ হয় অস্বীকার করবেন না।

ক্রিকেট এমনই একটি খেলা,যেখানে আপনার মাঠের পারফরম্যান্স দিয়েই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে।তেমনি নির্দিষ্ট খেলোয়াড়ের প্রতি আচরণে সংশ্লিষ্ট বোর্ড এবং টিম ম্যানেজমেন্ট মাঠের পারফরম্যান্সকে অগ্রাধিকার দেবে, এটাই কাম্য। ক্রিকেটমাঠে কারো দিন ফুরিয়ে এলে সেটা বলা বা তা নিয়ে আলোচনা করা তাই অপমানজনক কিছু হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত নয়। আপনার দেশের ক্রিকেটকে সামনের দিকে আরেক ধাপ এগিয়ে যেতে নতুনেরা প্রবীণদের ফেলে যাওয়া অর্জনকে অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়ে একসময় তাদেরকেও ছাপিয়ে যাবেন,এটাই তো আপনার কাম্য হওয়া উচিত, তাই নয় কি?

একটি দেশের ফ্যানবেইজ হিসেবে নিজেদের আরও পরিপক্কভাবে বিকশিত হতে অপমান ও সমালোচনার পার্থক্য বুঝতে শেখাও বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে আমাদের জন্য জরুরী। আমাদের দর্শকদের তো খেলার সময় দ্বাদশ খেলোয়াড় বলে বিভিন্ন সময় আখ্যায়িত করা হয়।

তাই কোনো খেলোয়াড়ের প্রতি ব্যক্তিগত পছন্দ বা দুর্বলতা থাকলেও ভক্ত হিসেবে দলের ভালোর জন্য তাকে হাসিমুখে বিদায় দেওয়ার চর্চাটার স্বাভাবিকীকরণও সময়ের দাবী। কারণ ব্যক্তিপছন্দের উর্ধ্বে মাঠে দলের উজ্জ্বল পারফরম্যান্সই তো সেই দেশের সাপোর্টারের মৌলিক প্রত্যাশা হওয়া উচিত! ব্যক্তি ক্রিকেটারের প্রতি সম্মান অক্ষুণ্ণ রেখে ক্রিকেটীয় আলোচনা-সমালোচনায় যদি ভালো কিছু হয়, তবে তা চলুক নাহ!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...