টটেনহাম হটস্পার। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের পাওয়ার হাউজ, শিরোপার অন্যতম দাবিদার। অধিনায়ক হিসেবে লন্ডনের প্রসিদ্ধ এই ক্লাবটিকে চারটি মেজর ট্রফি জেতানো ব্ল্যাঙ্কফ্লাওয়ার সম্পর্কে ব্রিটিশ ক্রীড়া সাংবাদিক নরম্যান গিলারের বলা উক্তিটি একেবারে যথার্থ! গিলার বলেন, ‘ড্যানি হচ্ছে টটেনহামের কবি।’
হ্যারি কেইনকে নিয়ে ফুটবলবাসীর মাতামাতির অন্ত ছিল না। গত কয়েক মৌসুম টটেনহামে থেকে দারুণ পারফর্ম করে যাচ্ছেন। ক্লাব লাভবান হচ্ছে, তিনি লাভবান হচ্ছেন। গেল বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার বাগিয়ে নেওয়া হ্যারি কেইন বর্তমান, এক মৌসুম আগে সেরা ফুটবলারের তকমা পাওয়া লুকা মড্রিচ অতীত।
এই অতীত-বর্তমানের মানে বুঝতে কষ্ট হচ্ছে? দু’জনই টটেনহামে খেলেছেন, কেইন খেলে যাচ্ছেন। ট্রান্সফার মার্কেটে একশো মিলিয়নের ট্রানজেকশন প্রথম দেখার সৌভাগ্য হয়েছে গ্যারেথ বেলের কল্যাণে, এক্স টটেনহাম লেফটব্যাক কাম উইঙ্গার ছিলেন যিনি। এরা হালফিলের তারকা। টটেনহামের মহাতারা এরা কেউই নন, নব্বইয়ের দশকে ক্লাব মাতানো ইংলিশ কিংবদন্তী গ্যারি লিনেকারও নন। ভদ্রলোকের নাম ‘রবার্ট ড্যানিশ ব্ল্যাঙ্কফ্লাওয়ার’, টটেনহামের সফল সময়ের সৌভাগ্যবান দলপতি ছিলেন যিনি।
ড্যানি ব্ল্যাঙ্কফ্লাওয়ার। ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯২৬, উত্তর আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্টে জন্ম। ড্যানির মা ছিলেন নারী ফুটবলার। গর্ভে থাকতেই হয়ত ফুটবলের সঙ্গে সখ্য হয়ে যায়। কে জানে মাতৃগর্ভে মারা লাথিগুলি বল ভেবেই দিতেন কি না! ১৯৪৬ সালে পেশাদার ক্যারিয়ার শুরুর পর শেষের আগপর্যন্ত আয়ারল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন ৫৬ ম্যাচ। ১৯৫৮ বিশ্বকাপে তাঁর নেতৃত্বেই আইরিশরা কোয়ার্টার ফাইনাল খেলে।
১৯৫৮ এবং ১৯৬১-র বর্ষসেরা ফুটবলার নির্বাচিত হওয়া ড্যানি প্রথম আইরিশ হিসেবে দেশের হয়ে পঞ্চাশোর্ধ ম্যাচ খেলার অসামান্য গৌরব অর্জন করেন। টটেনহামে আসার আগেই প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজেকে। ইংলিশ লিগ দাপিয়েছেন বার্নলি, অ্যাস্টন ভিলার জার্সি গায়ে। ১৯৫৪ সালে ভিলা থেকে ৩০,০০০ পাউন্ডে স্পার্সে আসা ড্যানি পরের দশ মৌসুমে নিজকে উজাড় করে দেন ক্লাবের জন্য। ‘৫৪-‘৬৪, এক দশক, ৩৮২ ম্যাচ।
১৯৬০-৬১ মৌসুমে কোচ বিল নিকোলসনের অধীনে যে স্বপ্নযানে চড়ে টটেনহাম সাফল্যের সপ্তচূড়ায় বসত গড়ে, তাতে প্রধান সহযাত্রী ছিলেন অধিনায়ক ব্ল্যাঙ্কফ্লাওয়ার।
‘আমাদের ভালো একটা দল আছে এবার। এই মৌসুমে আমরা ডাবল জিততে পারি!’ – মৌসুম শুরুর আগে ব্ল্যাঙ্কির করা সেই প্রেডিকশন এখনো অন্যতম সফল প্রেডিকশন হয়ে রয়েছে। দূরদর্শিতার পরিচয় তিনি তখন থেকেই দেয়া শুরু করেন। টটেনহামের সেরা ৫০ ক্লাব কিংবদন্তির যে জরিপ করা হয়েছে সেই তালিকায় ব্ল্যাঙ্ক ২২ নম্বরে থাকতে পারে ঠিকি তবে যোগ্য দলপতি হিসেবে তিনি থাকবেন উপরের দিকে।
মাঠের বাইরে বিল আর মাঠে ড্যানি মিলে সেবার এফএ কাপ জিতিয়ে ঘোচান দশ বছরের শিরোপাখরা, যা ছিল চার দশক পর তাদের এফএ কাপ জয়! তাতে সীমাবদ্ধ না থেকে দূর্বার নেতৃত্বগুণে ১৯৬০/৬১ মৌসুমে লিগের প্রথম ১১ ম্যাচ অপরাজিত রাখেন দলকে, সেই রেকর্ড আজ অবধি স্পার্সের দখলে! এতেই ক্ষান্ত দেননি। তাঁর হাত ধরে হোয়াইট হার্ট লেনে ১৯৬৩ সালে আসে প্রথম ইউরোপিয়ান কাপ।
অধিনায়ক হিসেবে লন্ডনের প্রসিদ্ধ এই ক্লাবটিকে চারটি মেজর ট্রফি জেতানো ব্ল্যাঙ্কফ্লাওয়ার সম্পর্কে ব্রিটিশ ক্রীড়া সাংবাদিক নরম্যান গিলারের বলা উক্তিটি একেবারে যথার্থ! গিলার বলেন, ‘ড্যানি হচ্ছে টটেনহামের কবি।’ আসলেই তাই। দলনেতার কবিতায় মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ছয় দশক আগে মাঠে যে ইতিহাসের বীজ বুনেছিল তাঁর সতীর্থরা, এতদিন পর আজ তা বিশাল ছায়াবৃক্ষ হয়ে রয়েছে ক্লাবের সাফল্য উদ্যানে।