বাংলাদেশের প্রথম হাটতে শেখা তার হাত ধরে। বছরের পর বছর হারতে থাকা একটা দলকে প্রথম জিততে শিখিয়েছিলেন তিনি। ভারত, অস্ট্রেলিয়া, তখনকার জিম্বাবুয়ে, শ্রীলঙ্কার মত দলের বিপক্ষে ওয়ানডে জিতিয়েছেন বাংলাদেশকে। ২০০৭ বিশ্বকাপে তার হাত ধরে এসেছে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ঐতিহাসিক জয়।
২০০৫ সালে তার হাত ধরে প্রথম টেস্ট ম্যাচ ও সিরিজ জেতে বাংলাদেশ। আশরাফুল-মাশরাফিদের সেরাটা বের করেছেন তিনি। তার হাত ধরে যাত্রা শুরু করেছেন সাকিব, তামিম, মুশফিকরা। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ এই ডেভনিল হোয়াটমোর।
এতোদিন পর বাংলাদেশে তার জীবন ও ক্রিকেট নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন হোয়াটমোর খেলা ৭১-এর সাথে।
বাংলাদেশ পর্বের অতি বিতর্কিত, অতি গর্বের এবং অতি প্রাপ্তির সব ঘটনা নিয়ে কথা বলার পাশাপাশি শ্রীলঙ্কা নিয়েও কথা বলেছেন এই প্রবীন কোচ।
আপনার জীবন কেটেছে অস্ট্রেলিয়ার মত উন্নত একটা দেশে। ঢাকায় এসে কেমন লাগতো? এখানকার ট্রাফিক, ভিড়।
আমি যখন বাংলাদেশে গেলাম, তার আগে চার বছর শ্রীলঙ্কায় কোচিং করিয়েছি। উপমহাদেশের জীবন যাত্রা সম্পর্কে আমার একটা ধারণা ছিলোই। ফলে ঢাকায় আমার মানিয়ে নিতে খুব একটা সমস্যা হয়নি। বরং আমি সর্বান্তকরণে উৎসাহী ছিলাম কাজ শুরু করার জন্য। ফলে সেটা উপভোগ করছিলাম।
প্রথম যখন বাংলাদেশে এলেন, দল তখন নিয়মিত হারছে। সেই সময় কী হতাশ লাগতো?
না। সত্যি কথা বলছি, না। আমার কাজ ছিলো খেলোয়াড়দের মানসিক ও টেকনিক্যাল দিকে আরও শক্তিশালী করে তোলা। ফলে আমি ফলাফল নিয়ে হতাশায় ভুগিনি। আমাকে যে সমর্থন (বোর্ড থেকে) দেওয়া হচ্ছিলো, তাতে আমি খুব স্বাচ্ছন্দ্য ছিলাম।
জয়ের জন্য কী অধৈর্য্য হয়ে পড়েছিলেন? অতো হারতে থাকা একটা দলকে মোটিভেট করতেন কিভাবে?
আমি তো সবসময়ই জয় চাওয়া মানুষ। ফলে কখনো কখনো, বিশেষ করে যখন আমার মনে হতো যে, এই ম্যাচটা আমাদের জেতার খুব সম্ভাবনা ছিলো, সেরকম ম্যাচ হেরে গেলে একটু হতাশ লাগতো। আরেকটা ব্যাপার ছিলো। আমি আসলে ম্যাচের রিভিউ করার সময় বিবেচনা করতাম যে, কতটা এফোর্ট আমরা দিয়েছি বা দেইনি। ফলাফলের চেয়ে এই বিষয়টায় বেশি গুরুত্ব দিতাম।
অবশেষে ২০০৪ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জয়। খুব আবেগী হয়ে পড়েছিলেন?
খানিকটা। প্রথম জয় তো সবসময়ই খুব আনন্দের, তাই না! তবে আমি আরও বেশি বেশি ওরকম জয় আসা করতাম। হ্যা, একটু ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম। জয়ের স্বাদ পাওয়ার ফলে একটু নিজের ওপর নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলেছিলাম।
পরের বছর প্রথম টেস্ট ও প্রথম টেস্ট সিরিজ জিতলো আপনার দল। দলের পারফরম্যান্সে অবাক হয়েছিলেন?
আবারও বলি এখানে-(জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে) প্রথম টেস্ট জয়টা কিন্তু আমাকে খুব একটা বিষ্মিত করেনি। আমার মনে হয়, ওটা আমাদের প্রাপ্যই ছিলো। তবে পরের ম্যাচটা খুব সন্তোষজনক ছিলো। শেষে যে ম্যাচটা ড্র করলে আমমরা সিরিজ জয় নিশ্চিত করতে পারতাম, ওই টেস্টটা যেভাবে ড্র করেছিলাম আমরা, তা খুব তৃপ্তির ছিলো। বিশেষ করে আমরা প্রথম ইনিংসে অনেক পিছিয়ে ছিলাম। এরপর আমাদের চতুর্থ ইনিংসে পাঁচ সেশনের ওপর ব্যাট করতে হতো। আমরা সেটা করেছিলাম এবং সিরিজ জিতেছিলাম।
২০০৭ বিশ্বকাপ। ইন্ডিয়াকে হারিয়ে সুপার এইট। তারপর তখনকার এক নম্বর দল দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানো। ওই সময়ের আনন্দটা মনে করতে পারেন?
অবশ্যই। ২০০৭ সালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপের সবকিছু আমি মনে করতে পারি। ভারতের বিপক্ষে জয়টা আসলে আমাদের সুর ঠিক করে দিয়েছিলো। আমরা অন্য যে কোনো দলের চেয়ে আগে ক্যারিবিয় অঞ্চলে পৌছেছিলাম। আর খুব ভালো প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। ওখানে আমরা বেশ কিছু ম্যাচ খেলেছিলাম বিশ্বকাপের আগে। বিসিবিকে এ জন্য ধন্যবাদ জানাতে হয়। সুপার এইটে ওঠার পর দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানোটা খুব তৃপ্তির ব্যাপার ছিলো। ওটা ছিলো সুপার এইটে আমাদের প্রথম ম্যাচ। প্রথম ম্যাচেই পয়েন্ট পেয়েছিলাম সেরা দলটার বিপক্ষে। আশরাফুল ওই ম্যাচে অসাধারণ খেলেছিল।
২০০৭ বিশ্বকাপে শাহরিয়ার নাফিসকে ড্রপ করা কী সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল?
দেবব্রত, এই ব্যাপারটা আমি ঠিক মনে করতে পারছি না। ফলে মন্তব্য না করি।
কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়াকে হারানোটা কী ফ্লুক ছিলো?
অবশ্যই না। আমরা তখন এমন একটা দল ছিলাম যে, কন্ডিশনটা পক্ষে থাকলে যে কোনো দলকে হারাতে পারতাম। অস্ট্রেলিয়াকে কম রানে আটকে রাখার ক্ষেত্রে দল অসাধারণ পারফরম করেছিলো। এরপর রান চেজ করার সময় ব্যাটসম্যানরা যে কমিটমেন্ট দেখালো, সেটা ছিলো ট্রিমেন্ডাস।
বাংলাদেশ থেকে আপনার চলে যাওয়ার সময়টা দেশের মানুষের জন্য শকিং ছিলো। কেনো চলে গেলেন? কী হয়েছিলো আসলে?
আমার মনে পড়ে, আমি ২০০৭ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ ছেড়ে গেলাম। আমার যাওয়ার কারণ এটা ছিলো না যে, আমি খুশি ছিলাম না। আমি ভালো ছিলাম। আমি আসলে চিন্তা করছিলাম যে, আমি হয়তো ভারতের পরবর্তী কোচ হবো। কিন্তু সেটা হয়নি। চিন্তাটা সুবিবেচনার ছিলো না। সম্ভবত, ওটা একটা ভুল ছিলো। আমি আরেকটা মেয়াদ অন্তত বাংলাদেশে কাটাতে পারতাম। আমি কাউকে কষ্ট দিতে চাইনি। সাধারণ মানুষ, প্রশাসন, খেলোয়াড়; কাউকে না।
আপনাকে বিদায় জানাতে বোর্ডের কেউ এলেন না। নিজে নিজে সংবাদ সম্মেলন করলেন। বোর্ডের সাথে সম্পর্কটা কী নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো?
আমার ধারণা, বিসিবির সঙ্গে আমার সম্পর্ক খারাপ হয়নি। আমি নিজে নিজে সংবাদ সম্মেলন করেছিলাম, কারণ কয়েক জন সাংবাদিক আমাকে এটা করতে বলেছিলেন। অনেকে কথা বলতে চাচ্ছিলেন। বিসিবির সাথে আমার সম্পর্ক ঠিক ছিলো। এখনও বিসিবিতে আমার বেশ কয়েক জন বন্ধু আছেন।
২০০৬-০৭ সালে বাংলাদেশকে নব্বইয়ের শ্রীলঙ্কার সাথে তুলনা করা হচ্ছিলো। বলা হচ্ছিলো, আপনি একটা ট্রফি এনে দিতে পারবেন বাংলাদেশকে। আপনার কী মনে হয়, আসলেই আমরা সেই উন্নতিটা করেছিলাম?
আমি ঠিক নিশ্চিত না যে, আসলেই আমরা সেই উন্নতিটা করেছিলাম কি না। তবে আমরা ধারাবাহিকভাবে আরও আত্মবিশ্বাসের সাথে পারফরম করতে শুরু করেছিলাম। সাকিব বা মুশফিকের মতো তরুন খেলোয়াড়রা কেবল মাত্র দলে যোগ দিয়েছিলো। দলটা শক্তিশালী হয়ে উঠছিলো।
আপনার সময়ে একটা বড় ব্যাপার ছিলো মাশরাফি। আপনি তাঁকে খুব আদর করতেন বলে জানা যায়। তার মধ্যে বিশেষ কী ছিল?
মাশরাফি একজন স্পেশাল খেলোয়াড় ছিলো। সে তারা পুরো ক্যারিয়ার ইনজুরির সাথে লড়াই করে বিশ্বস্ততার সাথে পারফরম করেছে। তার জায়গায় হলে অন্য অনেকেই খেলা ছেড়ে দিতো। কিন্তু সে ওখান থেকে এসে সাফল্যের পথে হেটেছে। আমার আফসোস, ও হয়তো আরও ভালো ব্যাটিং করতে পারত। কিন্তু সে ব্যাটে একজন আন্ডার পারফরমার হয়ে রইলো।
মাশরাফিকে আপনি অনেক ছাড় দিয়েছেন বলেও অভিযোগ আছে। এটা কী সত্যি?
এটা তো আমার জানা নেই, দেবব্রত।
হাবিবুল বাশার কত ভালো অধিনায়ক ছিলেন?
হাবিবুল অবশ্যই ভালো অধিনায়কও ছিলো। সে সবসময় খুব আক্রমণাত্মক স্টাইলে ব্যাট করত। ও চাইতো প্রতিপক্ষের ওপরে চাপটা ফিরিয়ে দিতে। আমার যতদূর মনে পড়ে, ওর ভালো টেস্ট গড় ছিলো। হাবিব অধিনায়ক হিসেবে খুব শ্রদ্ধেয় ছিলো দলের মধ্যে। আর ও অধিনায়ক হিসেবে সময়ের সাথে সাথে অনেক উন্নতি করেছিলো। সে তার গঠনমূলক মন্তব্য দিয়ে নিজেকে ভালো নির্বাচক হিসেবেও প্রমাণ করেছিলো।
*হাবিবুল বাশার অধিনায়ক হিসেবে পদাধিকার বলে তখন নির্বাচক ছিলেন।
আশরাফুল আপনার সময়েই সেরাটা দেখাতে পেরেছেন। এই ক্রিকেটার তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারলেন না। আপনার কী মনে হয়, কেনো বিশ্বসেরাদের একজন হতে পারলো না আশরাফুল?
প্রথমেই বলবো, সে নিজের জন্য, দেশের জন্য এবং বিশ্ব ক্রিকেটের জন্য একটা লজ্জার কাজ করেছে, যখন শুনলাম যে, সে ক্রিকেটের সাথে অন্যায় করেছে। আশরাফুলের প্রতিভা নিয়ে তো সন্দেহ নেই। পুরো শক্তির ভারতের বিপক্ষে চট্টগ্রামে সে যখন ডাবল সেঞ্চুরি (আসলে ১৫৮) করলো, সেটাই ওর প্রতিভার স্বাক্ষী দিয়েছিলো। অসাধারণ একটা ইনিংস ছিলো।
রানার কথা মনে আছে?
রানার কথা কখনো ভুলতে পারি! মানজারুল ইসলাম রানাকে কখনো ভোলা সম্ভব না। বিশ্বকাপ চলা অবস্থায় ওর মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর আমরা পুরো দল খুব ভেঙে পড়েছিলাম। আমি রুমে ফিরে খুব ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম। একটা দারুন সম্ভাবনাময় প্রতিভার কী ট্রাজিক সমাপ্তি! আমি বাংলাদেশে গেলেই চেষ্টা করি, সময় করে ওর কবরের কাছ থেকে ঘুরে আসতে।
এখন বাংলাদেশের খেলার খবর রাখেন? ২০০৭ সাল থেকে কতদূর এগোতে পেরেছে দলটা?
হ্যা। খোজ রাখি। সময়ে সময়ে বাংলাদেশের খেলার ফলাফল খোজ নেই। এর মাঝে তারা কিছু অসাধারণ সিরিজ জিতেছে। শুধু ঘরের মাটিতে জিতছে, সেটা বলা যাবে না। তারা শ্রীলঙ্কায় গিয়ে শ্রীলঙ্কাকে (টেস্টে) হারিয়েছে। এখন তারা নিউজিল্যান্ডে স্ট্রাগল করে আসলো। তবে আমার ধারণা, ওরা দ্রুত ঘুরে দাড়াবে।
বাশার, ম্যাশ বা অন্য কারো সাথে যোগাযোগ আছে?
সত্যি বলতে, নেই। মাঝে মাঝে সোশাল মিডিয়ায় একটু হ্যালো হয়। কিংবা আমি ঢাকায় গেলে কথা হয়।
শ্রীলঙ্কা নিয়ে একটু জিজ্ঞেস করি। একটা মিডিওকোর দলকে ১৯৯৬ সালে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করলেন কী করে?
ওই দলটার আসলে খেলোয়াড়দের ওই সামর্থ ছিলো। বিশেষ করে কন্ডিশন পক্ষে থাকলে ওদের বড় সিরিজ জেতার ক্ষমতা ছিলো। আমার ভূমিকাটা ছিলো ওদের প্রস্তুত করা এবং পারফরম্যান্সের জন্য স্বাস্থ্যকর একটা পরিবেশ তৈরি করা। আসলে খেলোয়াড়রাই তো কোচ তৈরি করে।
বলা হয়, ডেভ হোয়াটমোরের ভেতরে ম্যাজিক আছে!
আহ! আসলেই যদি আমার মধ্যে ম্যাজিক থাকতো, খুব ভালো হতো। দু:খজনকভাবে এরকম কিছু নেই। কোচের আসলে অনেক কিছু করার আছে। তাকে আসলে নিয়মিত ফলাফল পাওয়ার পাশাপাশি অনেক দীর্ঘ মেয়াদের বিষয়ের প্রতি মহান দায়িত্ব হিসেবে অনেক যত্ন নিতে হয়। অনেক বড় দায়িত্ব।
শেষ প্রশ্ন। বাংলাদেশ আবার কখনো আপনার সার্ভিস চাইলে আপনি ফিরে আসবেন?
আমি কখনো ‘নেভার’ বলি না, দেবব্রত।